সেদিন হঠাৎ করেই বিজুদার সাথে দেখা। বিজুদা মানে আমাদের কলেজের সেই বিজু দা। অনেকেই যাকে কান’দা বলে ডাকতো। মানে অলিভার কানের কান। প্রায় ছ-ফিটের মতো লম্বা, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী এই লোকটি অসাধারন গোলকিপার ছিল। পাখির মতো উড়ে তার বল ধরাকে অনেকে অলিভার কানের সাথে তুলনা করতো। এলাকায় ব্যাপক সুনাম ছিল তার। জেলায় বড় ধরনের প্রতিযোগীতা হলে আশেপাশের থানা থেকেও তার ডাক পড়তো। তাঁকে ভাড়া করে নিয়ে যেত গোলকিপিং করার জন্য। আমি বিজুদা কে ডাক দিলামঃ-
: বিজু দা!! এই বিজুদা ??
বিজুদাকে কখনও অবাক হতে দেখিনি আমি! তিনি কখনও উচ্ছাস-আবেগ প্রকাশ করতেন না। ছোটবেলায় আপনভূবনে বিরাজ করতে করতে রাস্তা দিয়ে ধীর গতিতে হাঁটতেন। পিছন থেকে কেউ ডাকলে ফিরে তাঁকাতেন, থামতেন এবং হাত বাড়িয়ে হেন্ডশেক করতেন। অপেক্ষা করতেন কিছু জিঙ্গেস করে কি-না! জিঙ্গেস করলে জবাব দিতেন না হয় চুপচাপ হাঁটতেন।
আমার ডাকে সেই চেনা ভঙ্গিতে পিছন ফিরে তাঁকালেন এবং মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন।
:বিজুদা কেমন আছেন??
: ভাল আছি। তুমি!! তুমি কেমন আছো??
: এই তো ভাই, আছি মোটামুটি। অনেক দিন পর আপনার সাথে দেখা।
: হুমম, প্রায় তের বছর পর। তুমি কলেজ ছাড়ার পর আর তোমার সাথে দেখা হয়নি।
রাস্তার পাশেই একটা চায়ের দোকান ছিল। ওদিকে ইঙ্গিত করে বিজু ভাই বললেনঃ-
-চলো বসি। চা খাই।
দোকানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বিজুদা নানা কথা জিঙ্গেস করলেন। কোথায় আছি, কি করি, বিয়ে শাদী করেছি কি-না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বিজুদার প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসলাম।
বিজুদাকে অনেক কথাই জিঙ্গেস করার ছিল। কিন্তু যেহেতু ফুটবল বিশ্বকাপ চলছে তাই বিজুদার ফুটবল ক্যারিয়ার বিষয়ক প্রশ্নটাই আগে করলাম।
: আপনার খেলার কি খবর বিজুদা? কোন ক্লাব-টাবে কি এখন খেলছেন?
: হুম খেলছি।
: কোন ক্লাবে??
: ফ্যামিলি ক্লাবে!! তোমার ভাবি গ্লাস, প্লেট ছুড়ে আর আমি ধরি। বাজারের ব্যাগে (হাতে থাকা ব্যাগটির দিকে তাঁকিয়ে) কিছু ঘাটতি পড়লে ব্যাগ সুদ্ধ ছুড়ে মারে আর সেইটাও আমি ধরি!
এই বলে বিজুদা হেসে উঠলেন। বিজুদা বাদে অন্য কেউ কথাটা বললে রসিকতা ভেবে আমি হয়তো হেসে উঠতাম। কিন্তু বিজুদার কথায় আমি হাসতে পারলাম না। কারণ আমি জানতাম ফুটবল লোকটার স্বপ্ন ছিল। তার তার ইচ্ছা ছিল সে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলবে। তার একথায় স্বপ্ন ভাঙার ইঙ্গিত আছে, একটি তীক্ষ্ণ বেদনা আছে। আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করলামঃ-
- রোটন ভাই, নয়ন ভাইয়ের কি খবর? তারা কি খেলাধুলা করে নাকি তারাও ছেড়ে দিয়েছে??
রোটন ভাই, নয়ন ভাই বিজুদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রোটন ভাই ছিলেন ডিফেন্ডার। তিনি যখন ডিফেন্সে থাকতেন বিজুদাকে অলস দাড়িয়ে থাকতে হতো। কারণ তখন গোল পোস্টে সহজে বল আসতে পারতোনা। তাই রোটন ভাইকে বিজুদা মাঝে মাঝে বলতেনঃ-
“তুই কখনও আমার দলে খেলবিনা। তোর সাথে খেললে আমার ক্যারিয়ার চাঙ্গে উঠবে! তুই যদি খেলতেই চাস তবে আমার প্রতিপক্ষের হয়ে খেলবি!!”
রোটন ভাই পাল্টা জবাব দিতোঃ-
“আমি আছি বলেই তো তুই এখনও বেঁচে আছিস! তোর সুন্দর চেহারাটার দিকে মেয়েরা এখনও তাঁকায়। আমি না থাকলে বল ফিরাতে ফিরাতে আর প্লেয়ারদের ধাক্কা খেতে খেতে শুকিয়ে পাট কাঠি হয়ে যেতি!!”
“আমার এত মাইয়া প্রেম নাই! ওরা তাঁকালেই কি আর না তাঁকালেই কি!! আমার ফুটবলার হওয়া চাই, পৃথিবীর সেরা ফুটবলার” জবাব দিতেন বিজু দা।
রোটন ভাই অসাধারন শর্ট্ নিতে পারতেন। দলের পক্ষের কোন কর্নার কিক বা ফ্রি কিক নেয়ায় রোটন ভাইয়ের জুড়ি ছিলনা। ডি বক্সের বাইরে থেকে মারা শর্ট্ গোল পোস্টের উপরের বার ছুই ছুই করে অনায়াসেই গোল পোষ্টে ঢুকিয়ে দিতে পারতো সে।তাই তাকে অনেকে রবার্তো কার্লোসের সাথে তুলনা করতো।
আর নয়ন ভাইতো নিজেকে ম্যারাডোনাই ভাবতেন!! আকার আকৃতিতে দেখতে ম্যারাডোনার মতো এই লোকটি মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে সবগুলো খেলোয়াড় টপকে বিদ্যুৎ গতিতে গোলপোষ্টের দিকে ছুটে যেতে পারতেন। গোল পোষ্টে বলটি দিয়েই তারপর ফিরতেন। নয়ন ভাইয়ের পায়ে বল দেখলে পুরো মাঠের চারদিকের দর্শকরা দাড়িয়ে যেতো এবং উত্তেজনায় চিৎকার করতে থাকতো।
এই তিনজনের কম্বিনেশনে আমাদের থানা ফুটবলটি হয়ে উঠেছিল অসম্ভব শক্তিশালী। বিজুদা, নয়ন ভাই আর রোটন ভাই এক দলে থাকলে সেই দলকে হারায় সেই সাধ্য আমাদের থানা তথা আশেপাশের থানায়ও কোন দলের ছিলনা!
রোটন ও নয়ণের কথা জিঙ্গেস করায় বিজুদা উত্তর দিলেনঃ-
-রোটন ডিফেন্সে আছে আর নয়ন তো এখনও মিডফিল্ডার।
:তার মানে তারা ফুটবলটাকে ধরে রেখেছে! কোন ক্লাবে খেলে ভাই?? আমি আগ্রহ নিয়ে জিঙ্গেস করলাম।
বিজুদা মুচকী হাসলেন। আর বললেনঃ-
-নারে ভাই! জীবন বাঁচাতে একজন ডিফেন্সে চাকরী করে আর একজন সংসার বাঁচাতে স্ত্রী ও মায়ের মাঝামাঝি থেকে মধ্যস্থতা করে। একূল-অকূল দুকুল রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করে।
: “খুব কষ্ট পেলাম ভাই কথাগুলো শুনে! আপনাদেরকে ফুটবলার হিসাবে ভাল জায়গায় দেখতে পারলে ভালো লাগতো”।
বিজুদা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। কিছু বলা থেকে বিরত থাকতে চান। কিন্তু আমি কিছু একটা শুনতে চাচ্ছি বুঝতে পেরে তিনি বলতে শুরু করেনঃ-
-“তোমার আমার ভাল লাগায় কিছু যায় আসেনা। যারা দেশ চালায় তাদের প্ল্যানিং এর উপর আমাদের ভাগ্য নির্ভর করে। বাংলাদেশের ষোলকোটি মানুষের প্রাণের খেলা ফুটবল। বিশ্বকাপ আসলে মানুষজনের উন্মাদনা দেখলেই বুঝা যায় তারা ফুটবলকে কতোটা ভালবাসে! তোমার কি মনে হয় যে তারা ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা দেশটাকে ভালবাসে? যে দেশের ভাষা,কৃষ্টি,ধর্ম্ কোন কিছুতে আমাদের মিল নাই সে দেশের জন্য আমার কেন এত মরিয়া??এই যে মেসি মেসি করে বা নেইমার নেইমার করে তারা জীবন দেয়; তারা কি ব্যাক্তি মেসি বা ব্যাক্তি নেইমারকে ভালবাসে?? কখনই না! তারা ভালবাসে ফুটবল! তারা ভালবাসে পায়ের জাদু দেখতে! যদি আমাদের দেশের ফুটবলপ্রেমীরা উপযুক্ত সুযোগ পেতো, যে ব্যায় ক্রিকেটে হয় সেরকম ব্যায় যদি ফুটবলে হতো তবে এই ফুটবলের প্রতি ভালবাসাই তাদের পায়ে শক্তি যোগাতো!! হয়তো এরকম কয়েকজন মেসি বা নেইমারের জন্ম এই বাংলাদেশেই হতো। ফুটবলের প্রতি এত ভালবাসা যে দেশের মানুষের সে দেশের সরকার ফুটবলের প্রতি এতটা উদাসীন; হয়তো এটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল!!”
বিজু ভাই থামেন এবং দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। আমি কি বলবো! কিছু বলতে না পেরে বিজুদার মুখের দিকে তাঁকিয়ে থাকি।
-“সবই কপাল!! বুঝছো সবই কপাল! জীবনে ভুল স্বপ্ন দেখেছিলাম তাই সবকিছু ভুল হলো”। বিজুদা আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
আমি ফুটবল খেলোয়াড় না! ফুটবল দেখতে ভালবাসলেও ফুটবলের অন্ধভক্ত না। হয়তো সে জন্যই ব্রাজিলের খেলা ভাল লাগলেও ব্রাজিলের পতাকা উড়াতে পছন্দ করিনা। তাই বিজুদার কষ্টটা হয়তো খুব বেশী গভীর ভাবে উপলদ্ধি করার ক্ষমতাও আমার নেই। তবে আমার কাছে মনে হলো বিজুদার এ কথা গুলো দেশের প্রতিটা ফুটবল প্রেমীর মনের কথা। প্রতিটা ফুটবল প্রেমীই হয়তো এভাবে মনে ক্ষোভ পুষে রেখেছেন। একসময়কার প্রত্যেক উদীয়মান ফুটবলারই হয়তো বিজুদার মতোই এখন ফ্যামিলি ক্লাবে খেলেন। জীবন বাঁচিয়ে সংসার ঘুচিয়ে রাখার তাগিদে তারা তাদের স্বপ্নকে জলাঞ্জলী দিয়েছেন। কি জানি! ক্রিকেটের এই দেশে আর কিছুদিন পরে হয়তো ফুটবলের প্রতি মানুষের এ ভালবাসাও নিশ্চিন্হ হয়ে যাবে।