প্রায় দু-কাঠা জায়গা জুড়ে একটি উঁচু টিলা। টিলার একদম মাথায় সুতিয়া নদীর কুল ঘেষে শতবর্ষ পুরোনো তেঁতুল গাছ। তেঁতুল গাছটি থেকে একটু সামনে নদীর ধারে পোড়া মাটি,আধপোড়া কাঠ ও কয়লার ছড়াছড়ি। মাঝে মাঝে দু-একটা আধপোড়া বুকের হাড়,পায়ের হাড় মাটির ভিতর থেকে বের হয়ে এদিক সেদিক পড়ে আছে। ওখান থেকে নদীর ভাটিতেও মাঝে মাঝে হাড় পাওয়া যায়। সেগুলো যে এই শ্বশান ঘাট থেকে ভেসে যাওয়া হাড় তা নিয়ে কারও বিতর্ক্ থাকেনা। শ্বশান ঘাটটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে নদীর পাড় ঘেসে পুর্ব-পশ্চিমে একটি পায়ে হাঁটার রাস্তা বড়হগঞ্জ বাজার থেকে পাঁচকিলোমিটার দুরবর্তী কৃষ্ণপুর গ্রামের দিকে চলে গেছে। রাত তো দুরের কথা আছর ওয়াক্তের পর আর এই রাস্তা দিয়ে কেউ চলা ফেরা করেনা। সবাই জানে সন্ধার পর এদিক দিয়ে গেলে জ্যান্ত ফিরার সম্ভাবনা নেই। সন্ধার পর চলাফেরার নিষেধাজ্ঞা জারির আগে প্রায়ই নাকি এখানে লাশ পাওয়া যেত। সর্বশেষ ত্রিশ বছর আগে শ্বশানঘাটে কোরবান আলী ও তার ছেলের লাশ পাওয়া যায়। কোরবান জেলে প্রতিদিন রাতে সুতিয়া নদীতে মাছ ধরতো। সে জাল ফেলতো আর তার বার বছরের ছেলে মনা এক হাতে হারিকেন এবং অন্য হাতে মাছ রাখার ঝুড়ি নিয়ে সাথে সাথে থাকতো। সেদিন ছিল শুক্রবার দিবাগত রাত। কোরবান শ্বশানের পশ্চিমের বড়হগঞ্জ ঘাট থেকে জাল ফেলতে ফেলতে কৃষ্ণপুরের দিকে যাচ্ছিল। মাছের নেশায় ভুত হয়ে কখন যে শ্বশানঘাটে চলে আসে তা খেয়ালই করেনি। পরদিন সকালে গ্রামের মানুষ গিয়ে দেখে কোরবান আলী মাথার অংশ নদীর পানিতে উপুর হয়ে পড়া। বাম হাতের অনামিকায় জালের রশি বাধা এবং জালটি নদীতে ছড়ানো। আর তার ছেলে মনার দেহের অংশবিশেষ এবং হাড়গোড় তেঁতুল গাছের চারদিকে ছড়ানোছিটানো ! আশেপাশে ছোটবড় মাছের প্রচুর ছিন্ন মস্তক্ও দেখতে পায় গ্রামের মানুষজন। তারপরদিনই বড়হগঞ্জ বাজার থেকে বের হওয়ার পথে এবং কৃষ্ণপুর গ্রামের প্রবেশপথে রাস্তায় পাশে বাঁশের বেড়া বানিয়ে রাখা হয়। সন্ধা হলেই গ্রামবাসী বেড়া টেনে রাস্তা আটকানো দেয় যাতে কেউ রাস্তায় ঢুকতে না পারে।
এই শ্বশানঘাটের আধমাইল দক্ষিনে অরহপুর গ্রামে রাজনের বাড়ী। শাওন মাসের এক বিকেলে সে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে নদীর ধারে বেড়াতে আসে। আছরের আযানের সাথে সাথে রাজন বন্ধুদের তাড়া দেয় ফিরে যাওয়ার জন্য। কারণ জানতে চাইলে রাজন শ্বশানঘাটের অতীতের ঘটনাগুলো বলে। বন্ধুদের কয়েকজনের বাড়ী তাদের পাশের গ্রামে। রাজনের কথাগুলো সবাই বিশ্বাস করলেও এদের মধ্যে অধিক সাহসী রুস্তম একেবারে হেসে উড়িয়ে দেয়। এটি গ্রামের ভীতু মানুষের মিথ্যে ভয় বলে ব্যাঙ্গ করে। ব্যাপারটি রাজনের গায়ে লাগে। রাজন বলে উঠেঃ-
“তোর এত সাহস আজ রাত বারটার সময় একা একা আয়না এই শ্বশান ঘাটে! দেখি কেমন বাপের বেটা!!”
“আসতে পারলে কি দিবি?” আত্ত্ববিশ্বাসের সাথে বলে রুস্তম।
“তুই যা চাস তাই দিব”পাল্টা জবাব দেয় রুস্তম।
তর্কের একপর্যায়ে সত্যি সত্যি রুস্তম আর রাজনের মধ্যে বাজী হয়ে যায় অন্য বন্ধুদের সাক্ষী রেখে। সিদ্যান্ত হয় রাত ১২টার দিকে রুস্তম শ্বশান ঘাটে আসবে আর অন্যরা গ্রামের শেষপ্রান্তে অপেক্ষা করবে। রুস্তম যে শ্বশান ঘাটে এসেছিল তার প্রমাণ স্বরুপ তাঁকে একটা বাঁশ পুতে রেখে যেতে হবে শ্বশানঘাটে। রাজনসহ অন্য বন্ধুরা সকালে এসে সেটি তুলে নিবে। যেই কথা সেই কাজ। রাত বারটা বাজার সাথে সাথে রুস্তম এক হাতে বাঁশ অন্য হাতে হারিকেন নিয়ে শ্বশান ঘাটের দিকে রওনা হয়।
তখন ঘোর অমাবস্যা। হারিকেনের আলোয় আশেপাশের যতটুকু আলোকিত হয় ঠিক ততটুকুই দেখা যায়, এর বাইরে কিচ্ছু দেখা যায়না। চারদিক শুনশান নিরব। আশেপাশ কোন বাড়ীঘর না থাকায় কোন জনমানব নেই,আলো নেই, শব্দ নেই। কেবল এক কিলোমিটার দুরবর্তী বড়হগঞ্জ বাজারে দু-একটি হারিকেনের আলো টিম টিম করে জ্বলছে। রুস্তম তার হাতের হারিকেনের আলোর উপর ভরসা করে তেঁতুল গাছের নীচে এসে দাড়ায়। তেতুল গাছে মনে হয় পাখির বাসা আছে, দু-একটি পাখি কিচির-মিচির করে ডেকে উঠেছে। বাঁশ পুততে হলে নরম মাটি দরকার। তাই রুস্তম নরম মাটির খুজে তেঁতুল গাছ পিছনে ফেলে নদীর ধারের দিকে এগোয়। এমন সময় নদীর মাঝখানে টস করে একটা শব্দ হয়। রুস্তম আঁতকে উঠে! নদীর দিকে তাঁকায়,কিন্তু অন্ধকারে কিছু দেখা যায়না। হয়তো বড় কোন মাছ লাফ দিয়েছে। যাহোক দেরী করা ঠিক হবেনা। তাড়াতাড়ি বাঁশটি পুতে বিদায় নেওয়া উচিত,কারণ রুস্তমের গা ছমছম করছে! সে নিজেকে যতটা সাহসী মনে করেছিল সে আসলে ততটা সাহসী না! তার ভিতর এখন ভয় কাজ করছে। হারিকেনটা একটা জায়গায় রেখে রুস্তম একটু নীচে নেমে নরম জায়গা খুজে বাঁশ পুততে উদ্ধত হয়। দুর্ভাগ্য রুস্তমের! বাঁশের নাড়া লেগে হারিকেনটা গড়িয়ে নদীর পানিতে পড়ে নিভে যায়। কি আর করা!! অন্ধকারে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে একটা নরম জায়গা দেখে হেইয়ো করে সে বাঁশটি পুতে দেয়। রুস্তমের মুখে বিজয়ের হাসি!!
এদিকে গ্রামের কিনারে বন্ধুরা অপেক্ষা করছে। সবার ভিতর টানটান উত্তেজনা। আজকে হয়তো একটা অপপ্রচারের মৃত্যু হতে যাচ্ছে নতুবা সেটি আরও পোক্ত হতে যাচ্ছে।অরহপুরে তারা যে জায়গাটায় দাড়িয়েছে সেখান থেকে শ্বশানঘাট বিশ মিনিটের পথ। যেতে বিশমিনিট,আসতে বিশ মিনিট।গভীর রাত এবং অন্ধকার বলে হয়তো আরও বিশ মিনিটি সময় বেশী লাগতে পারে। তাই একঘন্টা সময় তারা অনেকটা হালকা মেজাজেই থাকে! এক ঘন্টা পার হতেই তাদের উৎকন্ঠা বাড়তে থাকে। সময় গড়িয়ে যায়। এক ঘন্টা পাঁচ!দশ! ত্রিশ এমন করতে করতে দু-ঘন্টা পার হয়েছে! রুস্তমের ফেরার লক্ষন নেই! যাওয়ার সময় হারিকেনের আলোটা আস্তে আসতে দুরে যাচ্ছিল এখন সেটি এগিয়ে আসছেনা। রাজন পাড়ার মুরুব্বীদের ডাকে,ঘটনা খুলে বলে! সবাই এমন আহাম্মকি এবং আত্ত্বঘাতী সিদ্যান্ত নেযার জন্য রাজন এবং তার বন্ধুদেরকে ধমকাতে থাকে। রাজন তার বন্ধুরা সিদ্যান্ত নেয় শ্বশানঘাটে যাওয়ার কিন্তু মুরুব্বীরা কঠিন আপত্তি করে। যার কারণে সকাল অবধি অপেক্ষা করে শ্বশান ঘাটে এসে দেখে রুস্তম যেখানে বাঁশটা পুতেছিল সেখানেই উপুত হয়ে পড়ে আছে। হাত-পা ঠান্ডা বরফ!! টেনে উপরে আনতে গেলে টের পাওয়া যায় রুস্তমের পড়নের লুঙ্গি বাঁশের সাথে আটকে আছে। রুস্তম যখন বাঁশটি পুতে তখন তার লুঙ্গির ঝুলে থাকা অংশ বাঁশের তলায় পড়ে এবং রুস্তমের প্রচন্ড শক্তিতে চাপ দেয়ার কারণে সেটি বাঁশের সাথে সাথে মাটিতে ঢুকে যায়।
সবকিছু বিচার বিশ্লেষন করে এলাকাবাসী সিদ্যান্ত নেয়ঃ-
“কোন অশুভ শক্তির আঘাতে নয়,রুস্তমের মৃত্যূ হয়েছে ভয়ে, বোধশূণ্য হয়ে!!”
বিঃদ্রঃ-ছোট বেলায় শোনা গল্প,মূল বিষয় ঠিক রেখে নিজের ভাষায় লেখা হয়েছে।