বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা। আমি অফিসে আমার ডেস্কে বসে আছি। এমন সময় এক মাঝবয়সী লোক আসলো। তিনি একটি সরকারী অফিসে চাকরী করেন। লোন নিতে চান। আমি বসতে বললাম। তিনি না বসে দাড়িয়ে রইলেন। আমি আবারও বসতে বললাম।
তখন তিনি বললেন:- স্যার, আমি সুইপার।
আমি বললামঃ- আচ্ছা, বসেন ।
তারপরও তিনি দাড়িয়ে রইলেন। আমি আবার বললাম:
-"ভাই, দুইটা চেয়ার খালি, যে কোন একটাতে বসেন। বসে কথা বলেন।"
তিনি বললেন:- "স্যার, আমি সুইপার,ঝাড়ুদাড়। আমাদের চেয়ারে বসা নিষেধ আছে।"
আমি বললাম: "কে নিষেধ করছে?"
তিনি বললেন: "অফিস থেকে নিষেধ আছে।"
আমি কিছুটা অবাক হলাম, কিছুটা বিস্ময় নিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাঁকালাম। তিনি আমার দিকে হাতজোড় করে দাড়িয়ে আছেন।
আমি বললাম:- "দেখেন, এটা আপনার অফিস নয়, আমাদের অফিস, ব্যাংকের অফিস। আর আপনি ব্যাংকের সম্মানিত কাস্টমার। এই চেয়ারগুলো সকল কাস্টমারদের জন্য। আমাদের কাছে সব কাস্টমারই সমান। আপনি বসেন। আপনি না বসলে আমি আপনার সাথে কথা বলবোনা।"
আমি জোড় করাতে তিনি বসলেন। তারপর আমি তাঁকে লোন নেয়ার নিয়মকানুন বলছিলাম। এমন সময় তার অফিসেরই আরেকজন অফিসার আসলেন আমার সাথে লোনের বিষয়ে কথা বলতে। তাঁকে দেখে সুইপার ভদ্রলোকটি লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। ওই অফিসারের কাছ থেকে প্রায় দুই হাত দুরে গিয়ে হাত জোড় করে দাড়িয়ে পড়লেন!!
------------------------------------।
আজকের ঘটনাঃ
আমি আমার বাসার কাছে পান্থপথে মেইন রাস্তার ধারে একটা সিঁড়িতে বসে আছি। অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সন্ধার দিকে প্রায়ই বসি। এখানে একটা ছেলেকে প্রায়ই বসে থাকতে দেখি, তার সাথে আগে আমার কথা হয়েছে। কিছুটা সহজ সরল। সে ও সুইপার। খুব ভোরে রাস্তা ঝাড়ু দেয়। বিকাল বা সন্ধেটা বসে বসেই কাটায়। কিছু পড়াশোনা জানে মনে হয়। হাতে পত্রিকা বা ম্যাগাজিন,এটা সেটা থাকে। আজকেও একটা পত্রিকা হাতে নিয়ে বসে আছে। অন্যদিন আমি পাশে বসলে কেমন আছি জিঙ্গেস করে, আজ তেমন কিছু জিঙ্গেস করলো না। কি যেন ভাবছে। আমি বসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নেটে ব্রাউজ করা শুরু করি। এমন সময় ছেলেটি এগিয়ে আমার আরও কাছাকাছি আসলো, এসে বসলো:
-ভাই!
-হুমম, বলো।
-আমার শরীর গন্ধ করে কি-না শুকে সত্যি সত্যি বলেনতো!!
এমন প্রশ্নে আমি বিস্মিত হলাম। মোবাইল থেকে চোখ তুলে তার দিকে তাঁকালাম, তাকিয়ে বললাম:
- না তো! কিন্তু কেন?
-না এমনি। আচ্ছা ভাই, আমরা কি দেখতে আপনাদের মতো না?
-আমরা কারা?
-আমরা মানে সুইপাররা।
-তা হবে না ক্যান? সব মানুষই তো দেখতে মানুষের মতো!
-"তাহলে আপনাকে বা ওই দোকানদারকে কেউ জড়াইয়া ধরলে তো পত্রিকায় নিউজ হয়না। আমাদের ধরলে পত্রিকায় নিউজ হয় ক্যান? আমরা কি খুব খারাপ মানুষ?"
আমি কিছুটা আঁচ করতে পারলাম তারপরও খোলাসা করার জন্য জিঙ্গেস করলাম: "পরিস্কার করে বলোতো কি বলতে চাচ্ছো?"
-"ভাই, রংপুরে এক সুইপার মহিলাকে এডিসি ম্যাডাম জড়াইয়া ধরে স্বান্তনা দিছে, কারণ ওই মহিলার ছেলে এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আর সেটা আজকে কয়েকটা পত্রিকায় আইছে। এই যে আমার হাতে একটা। সবাই এডিসি ম্যাডামকে অনেক বড় মনের মানুষ বলছে। কেন ভাই? আমাগোরে ছুইলে কিংবা জড়াইয়া ধরলেই বড় মনের মানুষ হয়ে যাইবো ক্যান ? আমরা এত নিকৃষ্ট কোন দিক দিয়া? খারাপ কেমনে হইলাম?"
আমি ছেলেটির কাঁধে হাত রাখলাম। হাত রেখে বললাম:-
-"ভুল কথা। তোমরা মোটেও খারাপ না,নিকৃষ্টনা। যারা তোমাদের নিকৃষ্ট মনে করে তারাই নিকৃষ্ট। তারাই খারাপ। আর যে এডিসি ম্যাডাম ওই মহিলাকে জড়িয়ে ধরেছে সে মোটেই তোমার-আমার চেয়ে বড় নয়, তোমার-আমার সমান এবং আসল মানুষ। আসল মানুষের সংখ্যা খুব কম হওয়াতে এটা উদাহারন হয়েছে। একদিন আর এটা হবেনা। মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে, শুদ্ধ হচ্ছে। এমন একদিন আসবে যেদিন সব পেশার মানুষকে মানুষ সমানভাবে সম্মান করবে। রিকশাওয়ালা, শ্রমিক,কুলি কিংবা সুইপারকে কেবল তাদের পেশার জন্য তাচ্ছিল্য করে কথা বলবেনা। বয়সের ভিত্তিতে স্নেহ করবে,শ্রদ্ধা করবে। চরিত্রের ভিত্তিতে ঘৃণা করবে,ভালবাসবে।"
আমার কথাগুলো সে মনোযোগ দিয়ে শুনে, স্বান্তনা পায় কিন্তু আশ্বস্ত হয়না। হয়তো ভাবে এর কথায় আর কি হবে? আশেপাশে তো দেখতেছি সবাই আমাদেরকে কেমনে দেখে! এমনটা চলছে,চলবেই!!
সাড়ে আটটার মতো বাজে, ক্ষুধা লাগতেছে। আমি বাসায় যাওয়ার জন্য উঠে পড়ি। উঠতে উঠতে ছেলেটিকে বলি: "আশাহত হইয়ো না, দেখো একদিন সব বদলে যাবে!"
ফিরতে ফিরতে মনে মনে ধন্যবাদ দেই এডিসি তনিমা তাসনিম ম্যাডামকে। উপরের স্তরের এই মানুষগুলোর ভিতরের ভালমানুষটা যদি এভাবে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে তবেই না সমাজে পরিবর্তন আসবে, মানুষগুলোতে পরিবর্তন আসবে। শ্রেণীভেদ মুছে যাবে!!
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:২৮