সন্ধে সাতটা। অফিস শেষে ফেরার পথে তেঁজতুরি বাজার ওভার ব্রিজের ফ্ল্যাট অংশ পার হয়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসেছি। প্রথম সিঁড়িতে পা দিবো, এমন সময় আমার হাঁটুর নীচে একটি মাথা থেকে দুটো চোখ আমার দিকে তাঁকালো। কিছু বলছেনা কেবল তাঁকিয়েই আছে। অন্যদিন হলে হয়তো আমার চোখে পড়তোনা, কিন্তু আজকে আমি ক্লান্ত, কিছুটা অসুস্থ তাই হাঁটার গতিও স্লথ। আমার সাথে লোকটির চোখাচোখি হলো, আমার চোখে হয়তো পশ্রয় ছিলো, তাই লোকটি আশা নিয়ে বললো:-
-"আমার বিয়ারিং গাড়ীটা একটু নামায়ে দিবেন। এইডার জন্য আমি নামতে পারছি না।"
আমি লোকটির দিকে ভালো করে তাঁকালাম। লোকটির দুটো পাই অকেজো, মনে হয় জন্ম থেকেই অকেজো। কারণ দু পায়েই আমাদের যেখানে উরু সেখানে পায়ের পাতার মতো দুটো জিনিস আছে। বাম হাতটি অসম্পুর্ণ তাই ডান হাতটিই তার সম্বল।
আমি তার বিয়ারিং টা হাতে নিতে নিতে বললাম:-"নামতে পারবেন? নাকি ধরতে হবে?"
-"না বাবা, ধরতে হবেনা, আপনি কেবল বিয়ারিং টা নামায় দেন। অন্য সময় হলে ছাইড়া দিতাম, গড়াইয়া গড়াইয়া চইলা যাইতো কিন্তু এখনতো অনেক ভীড়। ভীড়ের মধ্যে ছাড়তে পারছিনা, কার না কার শরীরে লাগে!"
-"ভিক্ষা কইরা কি করেন?" আমি নামতে নামতে প্রশ্ন করলাম।
-"কি আর করুম! খাই, বেঁচে থাকি।"
-বেঁচে থেকে কি হয়?
-"মরা কি এত সহজ! চাইলেই কি মরা যায়?"
-কোন স্বপ্ন আছে?
-"স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে বাবা?"
-বিয়া করছেন? ছেলে মেয়ে আছে?
-"আমাকে কে মেয়ে দিবে? কেন দিবে?"
-বিয়ে করেন নাই! ছেলে-পেলে নাই আপনার আবার স্বপ্ন কি?
লোকটি সিঁড়ি দিয়া নামে, হাঁফায়। হাঁফাতে হাঁফাতে আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ঃ-
-"আমার মা আছে, সারাদিন যা কামাই করি মার হাতে তুলে দিই। মা বাজার করে,রান্না করে। আমি খাই, মায় খায়। মা খুশি হয়। আমার ভাল লাগে। যতদিন মায় বেঁচে থাকে ততদিন মাকে খুশি রাখবো এইটা আমার স্বপ্ন।"
-"মা মরে গেলে?" আমি আবার প্রশ্ন করি।
-"আমার বোনের একটা ছেলে থাকে আমাদের সাথে। হেরে কোলে রাইখাই বোন মারা গেছে। বোন জামাই হেরে নেয়নাই। তাই সে আমার মায়ের সাথে থাহে। হেরে খাওয়াই। সে স্কুলে যায়। আমি খরচ দেই। যদি হেরে পড়া শোনা করায়ে বড় করতে পারি আমার ভালো লাগবো। এইডা আমার আরেকটা স্বপ্ন।"
আমি বিয়ারিং নিয়ে নামি, লোকটি তার শরীর নিয়ে নামে। আমি স্বাচ্ছন্দে সিড়ি ভাঙি লোকটি সর্ব শক্তি দিয়ে ভাঙে। একসময় সিড়ি শেষ হয়, লোকটির সামনে বিয়ারিং দেই। সে লাফ দিয়ে বিয়ারিং এ উঠে। গড়গড় শব্দে বিয়ারিং সামনে এগিয়ে যায়, আমি নিঃশব্দে পাশ দিয়ে হাঁটি আর মনে মনে বলিঃ
"কাকা, আপনি বেঁচে থাকুন, অনেক বছর বেঁচে থাকুন। আমাদের অনেকের বড়বড় স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আপনার বেঁচে থাকা সার্থক। আপনি আমাদের কাছে অতি নগন্য হলেও আপনার মা ও বোনের ছেলেটির কাছে আপনি পৃথিবী। তাদের একমাত্র ভরসার স্থান। তাই আপনিও কোন অংশে নগন্য নন। হয়তো অনেকের চেয়েও বড় নয়তো নিদেনপক্ষে সমান।"
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:০৬