সে সময় বাংলা কবিতা এবং সাহিত্য ছিল সমাজের উচুতলার এলিট শ্রেণীর জন্য। কবিতা কিংবা সাহিত্যে সমাজের নিচু শ্রেণীদের ঠায় ছিল না। মুসলমান সমাজের অভিযোগ ছিলো রবীন্দ্রনাথ ও সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকরা হিন্দুদের প্রাধান্য দিয়ে লিখছেন। প্রতিটি সাহিত্যে হিন্দুয়ানী শব্দ ও সংস্কৃতির জয়জয়কার, তাই একটা সময় পর গিয়ে মুসলমানদের মধ্যে এ কারণে রবীন্দ্রনাথ কেও বয়কটের রব উঠলো। বাংলা সাহিত্য ও কবিতা হয়তো বাংলার মুসলমান ও নিচু শ্রেণীদের থেকে বিভক্ত হয়েই যেতো, যদি না রুটির দোকানের চুলা থেকে ‘দুখু মিয়া’ নামের ঝাকড়া চুলের আস্ত একটা ধূমকেতুর সৃষ্টি না হতো!
দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া দুখু মিয়া সাহিত্য কে সমাজের উচুতলা থেকে টেনে নিচে নামিয়ে আনলেন। সাহিত্য কে ছড়িয়ে দিলেন লেটো দলের বাদক হয়ে, রেলগার্ডের খানসামা হয়ে, বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক হয়ে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে, গীতিকার-গল্পকার-সুরকার হয়ে, কারারুদ্ধ বন্দী হয়ে, শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার সাংবাদিক হয়ে। কখনো তিনি গান গেয়েছেন, কখনো পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, কখনো রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করেছেন। নজরুল ছিলেন ওই সময়কার প্রথম বাঙ্গালী, যে ক্ষমতাবান আর সমাজের উচুশ্রেণীর তেল দেওয়া নতজানু সাহিত্য কে ভেঙ্গে নতুন এক সবল, শক্ত ও বিদ্রোহী রুপ দিয়েছিলেন।
নজরুল তার শিকড় কে ভুলেননি কখনোই। সমাজের সব ধরণের মানুষের সাথে তিনি মিশেছিলেন। আর তাই হ্যারিসন স্ট্রিটের রিকশাওয়ালাকে তিনি বলেছিলেন – “এ্যাই তুই তো অনেককেই নিয়ে যাস রিক্সায় টেনে। ঠিক আছে আজ তুই রিক্সায় বোস আর আমি তোকে টেনে নিয়ে যাই”। নজরুল শুধু রিকশাওয়ালা কে টেনেই ক্ষান্ত হননি। কুলি, মজুর, মুচি, মেথর, কৃষক, তাঁতি, জেলে সহ সমাজে বসবাসকারী সব ধরণের জনগোষ্ঠীকে টেনে নিয়ে এসেছেন বাংলা অভিজাত সাহিত্যের অন্দরমহলে। হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান, বৌদ্ধ সহ সবাইকে নিয়ে তৎকালীন সাহিত্যবিভক্ত বাংলায় সৃষ্টি করেছেন সাম্যবাদ। রবীন্দ্রসৃষ্ট বিশাল সাম্রাজ্যের পাশেই নতুন এক ‘স্বতন্ত্র’ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। যে সাম্রাজের নাম “নজরুল”।
আমাদের সাম্যের কবি, দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, বেদনার কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০২১ দুপুর ২:১৪