somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ট্রাফিক জ্যাম,মাগুর মাছ এবং আমরা

০৩ রা আগস্ট, ২০১১ রাত ১১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গত এক মাস ধরে রাস্তায় বের হয়েছে,কিন্তু দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামের কবলে পড়েনি—ঢাকায় এমন মানুষের সংখ্যা মনে হয় শূন্যের কোঠায়।

আমাকে অবশ্য প্রত্যেকদিন-ই এই ভয়াবহ উপদ্রব সহ্য করতে হয়। আমার ক্লাস শুরু হয় সকাল সাড়ে সাতটায়। আমি সাধারণত বাসা থেকে বের হই সোয়া সাতটার দিকে। বের হতে একটু দেরি হলেই দেখা যায় ধানমন্ডি আট নাম্বার ব্রীজের কাছে ভয়াবহ যানজট। যানটনের কারণ আসলে স্কুলগুলো। ইংলিশ মিডিয়ামের পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চাগুলো ঘুম ঘুম চোখে গাড়িতে কিংবা রিকশায় বাবা-মা’র কোলে বসে আছে। তাদেরও তাড়া। স্কুল যেতে হবে সময় মত। মাঝে মাঝে খুব রাগ লাগে আমার,মায়াও লাগে। এই বাচ্চাগুলোকে মনে হয় টেনে-হিঁচড়ে ঘুম থেকে তুলে ভারী ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েছে বাপ-মা। ঘুম থেকে ঊঠ,ঊঠেই ভারী ব্যাগ নাও। তারপর স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দাও,বেশি বেশি মার্কস পাও। এই হচ্ছে উদ্দেশ্য! কি ভয়াবহ ব্যাপার! আমার শৈশব হয়ত এত প্রকট ছিলনা। যুগ দিনে দিনে কঠিন হচ্ছে। প্রতিযোগিতা বাড়ছে। তুমি দৌড়াও,যত দ্রুত দৌড়াবে—তত তাড়াতাড়ি জিততে পারবে। এই দ্রুত দৌড়ের যুগে কচ্ছপের ধীরে সুস্থে জেতার গল্প কেন জানি বড় বেমানান লাগে আমার।

যাইহোক,লেখার প্রসঙ্গ আসলে যানজট। বেশিরভাগ দিন-ই আমাকে জ্যামে বসে থাকতে হয়। আমি তখন গাড়ির মধ্যে বসে বসে মানুষজনকে দেখি। মানুষজনকে দেখি বলাটা মনে হয় ভুল হল,আমি দেখি গাড়ি-ঘোড়া। বিচিত্র সব গাড়ি। কোনটা খুব দামী,কোনটা খুব ভাঙ্গাচোরা,কোনটার বাম্পার ভাঙ্গা,কোনটার রঙ চটা। সেইসব গাড়িতে এই ভোর বেলাতেই মানুষজন ছুটছে। অবশ্য ছুটছে বলা ভুল হল,কারণ গাড়ির চাকা প্রতি দশ মিনিটে একবার করে স্লো মোশনে ঘুরছে। রিকশার ও অভাব নাই। গাড়ির চিপা-চাপা দিয়ে রিকশাও ঢুকে আছে। রিকশাওয়ালারা চেষ্টা করে ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে রিকশা নিয়ে টান মারার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে,এটা করতে গিয়ে আরো বেশি জ্যাম লাগে। রিকশা টানতে গিয়ে মাঝে মাঝে কোন গাড়ির সাথে লেগে যায়। তখন দেখার মত একটা ব্যাপার হয়। রিকশাওয়ালা বনাম ড্রাইভারের কথা কাটাকাটি। পথচারী (যাদের কোন কাজ-কাম নাই,মজা দেখতে পছন্দ করে) বেশির ভাগ সময় ভীড় করে দাঁড়িয়ে যায় এবং রিকশাওয়ালার পক্ষপাত নিয়ে নেয়। এর কারণ হতে পারে-- বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ গাড়িওয়ালাদের দেখতে পারেনা। কথা কাটাকাটি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে হাতাহাতিও হতে পারে। তখন আশপাশ থেকে বাকি গাড়িগুলো হর্ন দিতে থাকে। পুরাই গ্যাঞ্জুমাস অবস্থা। তবে জ্যামের একটা সুবিধাও আছে। অনেক সময় সকাল বেলা পেপার বিক্রেতা বাচ্চা ছেলেগুলো পেপার বিক্রি করে। তারা যখন জ্যামের মধ্যে পেপার হাতে নিয়ে ঘুরাফেরা করে,তখন চট করে শিরোনামগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলে শিরোনাগুলো দেখা হয়ে যায়। আমি আগে এই পন্থা প্রয়োগ করে পেপারের শিরোনাম পড়ে ফেলতাম। একটা চালাক পিচ্চি আমার এই পদ্ধতি বুঝে যাওয়ার পর আমার কাছে আসলে পেপার ভাল মত ভাঁজ করে,যাতে শিরোনাম না দেখা যায়। তারপর বলে,”আফা পেপার নিবেন?” বড়-ই অপমানজনক ব্যাপার।

আমি কলেজ থেকে বাড়ি ফিরি আড়াইটা-তিনটার দিকে। ভুক্তভোগী মাত্র-ই জানেন,এই পিক আওয়ারে এলিফ্যান্ট রোড বা নিউমার্কেটের দিকে কি অবস্থাটাই না থাকে! কোন যানজট না থাকলে বাড়ি ফিরতে লাগে দশ থেকে পনেরো মিনিট। কিন্তু জ্যাম থাকলে পাক্কা এক ঘন্টা! এক ঘন্টা সময় প্রত্যেকদিন আমার জীবন থেকে ঝরে যাচ্ছে। আপচুচ।

দুপুরের দিকে রাস্তায় বাসের সংখ্যা বেশি থাকে। বাসের চেয়ে বেশি থাকে বাসের মধ্যে মানুষের সংখ্যা। গরমে সবাই সিদ্ধ হয়। বাংলাদেশে মনে হয় আর কিছুদিন পর বারো মাস-ই গরম থাকবে। রাস্তায় গাড়ি,বাস,রিকশা—সাথে গিজগিজে মানুষ। মাথার মধ্যে কখন বাসায় পৌঁছাব সেই চিন্তা,পেটে ক্ষুধা। সবমিলিয়ে এমন বিরক্তিকর অবস্থা যে মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়—“ধুর! এই দেশে মানুষ থাকে নাকি?”!

হ্যাঁ,এই দেশে এত অসুবিধার মধ্যেও তবুও মানুষ থাকে। শুধু যে থাকে তাই না,দিনে দিনে এই দেশটার জনসংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। দেশটাতে কেউ থাকে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাই,কেউ থাকে অন্য কোন দেশে চলে যাওয়ার সুযোগ বা উপায় নেই তাই,কেউ থাকে পেটের ধান্ধায়,কেউ থাকে দেশকে ভালোবেসে।

বিগত বছরগুলোতে যতবার যে সরকার এসেছে সেই সরকার-ই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যানটন নিরসনের। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এত ভুলো মনের যে,খুব দ্রুত প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়া তাদের কাছে ডাল-ভাত। (লাইফটা বাংলা সিনেমা হলে প্রত্যেক রাজনৈতিক প্রধানদের একটা করে ইটের বাড়ি দিলে স্মৃতি ফিরে আসত) অবশ্য আমাদের দেশে ট্রাফিক জ্যাম কমানোর জন্য রাস্তা একমুখী করার ব্যবস্থা হয়েছে--কার্যকর হয়নি তেমন,ফ্লাইওভার বানানো হয়েছে, তবুও জ্যাম কমেনি।

যানজট কমানোর জন্য রাস্তায় গাড়ি কমাতে হবে? কিভাবে সম্ভব? মন্ত্রীরা নিজেরাই তো ভারত থেকে গাড়ি আমদানীর পক্ষপাতী। রিকশা ঊঠিয়ে দাও? রিকশাওয়ালাদের চলবে কিভাবে? ট্রাফিকদের ঘুষ খাওয়া কমাতে হবে? তাহলে ট্রাফিক পুলিশদের সংসারের উপরি আয় কোথা থেকে আসবে? ট্রাফিক সিগনাল মানতে হবে? এটা করতে গেলে তো বাংলাদেশের সকল ড্রাইভার এবং রিকশাওয়ালাদের শিক্ষিত হতে হবে,বিবেকবোধ জাগাতে হবে। শিক্ষার জন্য যে অর্থ সেটা এই দরিদ্র মানুষগুলোকে কে দেবে? সবচে’ ভাল উপায় বাংলাদেশের বর্ধিত জনসংখ্যা কমানোর ব্যবস্থা করা। কিন্তু সেটাও সম্ভব না। কারণ আমাদের দেশের মানুষগুলোর মধ্যে শিক্ষার হার খুব কম। ফলে তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কেও তেমন জানেনা।

আমাদের এই অপরূপ সুন্দর দেশটার জন্য ভাল কিছু করার আগে সব কিছুতেই আসে বিশাল বিশাল বাধা। তারপরও খুব অদ্ভুত ব্যাপার কোন এক জরীপে বাংলাদেশের মানুষ জ্যাম,দারিদ্র্য,অশিক্ষা সব কিছু উপেক্ষা করে সবচে’ সুখী মানুষের দেশ নির্বাচিত হয়েছিল। আমার কেন জানি মনে হয়,সুখী দেশ হ্‌ওয়ার কারণ বাংলাদেশের মানুষগুলোর হাসার ক্ষমতা। যেকোন ব্যাপারেই আমার দুঃখিনী দেশের মানুষের মাঝে প্রবল সেন্স অব হিউমার দেখেছি আমি।

ফেসবুকে মাগুর মাছের মত সাধারণ অপসন চালু করে মজার মজার প্রশ্নের উত্তরে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে পারি মনে হয় একমাত্র আমরাই,গম্ভীরমুখো ব্রিটিশগুলো না (তারা জানেই না মাগুর মাছ কি?)। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল একটা ম্যাচ জিতলেই রাত-দুপুরেও সব বিভেদ ভুলে রাস্তায় পতাকা জড়িয়ে উল্লাস করতে পারি মনে হয় আমরাই। এত আবেগ অন্য কোন দেশে আমাদের মত করে দেখা যায় কিনা জানিনা। ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে তপ্ত রোদে পুড়ে গিয়ে,বাসের হাতল ধরে ঝুলে থেকেও বাসের কারো মজার কথায় হেসে ঊঠতে পারি মনে হয় আমরাই। চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় অকারণে হাসতে হাসতে বিষম খেতে পারি আমরাই। ক্ষেতে-খামারে যে চাচা কষ্ট করে ফসল ফলান,খর রোদ্দুরে মাঠ থেকে ফিরে গিয়ে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে পারেন মনে হয় তিনিই। কারণ আমরা সুখী দেশ,আমরা আমাদের দুঃখিনী মায়ের সুখী সন্তান!

শুধুমাত্র এই “হাসতে পারা”-র কিংবা অল্প পেয়েও “সুখী থাকতে পারা”-র ক্ষমতার জন্য-ই আমার কেন জানি খুব আশা হয়,কেন জানি ভাবতে খুব ভাল লাগে,সব সমস্যা তুচ্ছ করে আমাদের দেশটা একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে। একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবেই!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ১:১১
৫৮টি মন্তব্য ৫৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×