আমার জন্মের পরপর-ই ৯০’এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। কাজেই সেই সময় কি ঘটেছিল তা সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। ইন্টারনেট ব্যবহার করা শুরু করার পর একদিন “৯০’এর গণঅভ্যুত্থান” লিখে নেটে সার্চ দিলাম বেশ আগ্রহী হয়ে। নেট থেকেই জানলাম এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের নানা কথা,গণমানুষের রাস্তায় নামার কারণে পুলিশের লাঠিচার্জ করার কথা,স্বৈরাচারিতা নিপাত গিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা। নেটে লেখাগুলো পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল,"সেই সময়ের প্রতিবাদী বাঙ্গালী আজ বিংশ শতাব্দীতে এসে এত বদলে গেল কিভাবে? নাকি আমরা সবাই গণতন্ত্রের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি? তাই প্রতিবাদ করার কিছু নাই?” অবশেষে নিজেকে দিয়েই নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম।
ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে এসেছি,"বোবার কোন শত্রু নাই।" পৃথিবীর সব মানুষ,এমনকি আমি নিজেও শান্তিতে থাকতে চাই। অযথা ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি? তাই আমরা অন্যের সকল দুর্দিনে চুপ করে বসে থাকি। যারটা যে বুঝে নিবে,আমার এত ঝামেলা করার দরকার কি? খাচ্ছি,ঘুমাচ্ছি,পড়ছি,চাকরি করছি,নিজের টাকায় কেনাকাটা করছি,আমিতো বেশ ভাল-ই আছি—এইটা হচ্ছে আমাদের দেশের বেশির ভাগ টিপিক্যাল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অথবা উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষের মনোভাব। (উচ্চবিত্ত মানুষের মনোভাব নিয়ে আমার কোন ধারণা নেই এবং নিম্নবিত্ত মানুষদের নিজেদের-ই নুন আনতে পান্তা ফুরায়—অন্যের দুরাবস্থা নিয়ে তাঁদের না ভাবাটাই স্বাভাবিক) আমরা মনে করি--আমি যেহেতু ভাল আছি—কাজেই কেউ মরল নাকি পুড়ল,রাস্তা কি চুরমার হয়ে ভেঙ্গে গেল নাকি আধভাঙ্গা হয়ে থেকে গেল,দেশের শেয়ার বাজারে ধ্বস নামলো কি নামলো না—তা দেখার কোন প্রয়োজনীয়তা আমার নাই। “ঘরের খেয়ে বনের মোষ” তাড়ানোর কি দরকার? আমরা এটুকুও ভাবি না--অন্যের ঘরে যে বিপদ,ঠিক সেই বিপদ একদিন আমাদের ঘরেও আসতে পারে! আমাদের মধ্য থেকে মানবিকতা হারিয়ে গেছে,আমরা রোবট হয়ে গেছি।
******************
মুসা ইব্রাহীমের এভারেষ্ট জয় এবং বাংলাদেশের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্যায়ে তিনটা জয়ের পর বহুদিন আমি কোন আনন্দের ঘটনা শুনিনি,যে আনন্দে মেতে উঠতে পারে সারা দেশ। অথচ মন খারাপ করা ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ষিত হয়েছে ছাত্রী,স্বামীর পৈশাচিক নির্যাতনে অন্ধ হয়ে গেছেন রুমানা সাঈদ,পা হারিয়েছে লিমন,চিরকালের মত চলে গেছেন তিন জন ক্ষণজন্মা প্রতিভা—আবিদ,মিশুক মুনীর এবং তারেক মাসুদ,মীরসরাইয়ের সড়ক দূর্ঘটনায় ঝরে গেছে অনেকগুলো শিশু প্রাণ। এই ঘটনাগুলো নিয়ে ব্লগে,ফেসবুকে,পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে দেখে এগুলোর কথাই আমরা বেশি বলি। হয়ত আরো মারাত্মক কোন মন খারাপ করা ঘটনা ঘটে গেছে আমাদের চোখের অন্তরালে। আমরা যারা সক্রিয়ভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করি—তারা আজকাল এমন নিস্পৃহ হয়ে গেছি যে কোন হত্যাকান্ড বা দূর্ঘটনার কথা শুনলেই নেটে একটা সার্চ দিই,তারপর ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতে থাকি প্রতিবাদী স্ট্যাটাস অথবা ব্লগের জন্য প্রস্তুত করতে থাকি নোট। আমাদের কতটুকু মন খারাপ হয়,তার তুলনায় কতগুণ বেশি আমরা কয়েকদিন ব্লগে,ফেসবুকে হাউকাঊ করি আমরা মনে হয় নিজেরাই জানিনা। এই ব্যাপারে আমি একটা উদাহরণ দিতে পারি—আবিদ যেদিন মারা যান,সেদিন আমার প্রচণ্ড কষ্ট হয়েছিল। তাঁর “পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে” গানটা সরাসরি শুনেছিলাম আমাদের এসএসসির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। সেই কথাটাই বারবার মনে হচ্ছিল। আবিদ মারা যাওয়ার পরের দিন আমি যখন ফেসবুকে গেলাম,অবাক হয়ে দেখলাম আবিদকে নিয়ে ফেসবুকে ফ্যান পেজ বের করা হচ্ছে,আবিদের ফ্যান পেজে সবাই লাইক দিচ্ছে। এতদিন পর সবার আবিদকে নিয়ে ফ্যান পেজ বের করার কথা মনে হয়েছে। আশ্চর্য! আমরা গুণীর কদর করি তিনি মারা যাওয়ার পর! এই ফেসবুকীয় শ্রদ্ধা কি আবিদের প্রয়োজন ছিল নাকি প্রয়োজন ছিল তাঁর বেঁচে থাকা?
কীবোর্ডে খট খট শব্দ তুলে শোক ঝরিয়ে দেওয়া অনেক সোজা একটা ব্যাপার,সেই খটখটে শোক মুছে ফেলাও খুব সোজা ব্যাপার। তেল-গ্যাস চুক্তি নিয়ে কেউ আর তেমন উচ্চবাচ্য করেনা,আমি নিজেও জানিনা এই চুক্তির এখন কী অবস্থা। ব্লগে তারেক মাসুদকে নিয়ে যতগুলো শোকগাঁথা বের হয়েছিল,আজ তা হারিয়ে গেছে। নতুন করে যখন কোন দূর্ঘটনা ঘটবে ব্লগ,ফেসবুক আবার সরব হবে,আমরাও আবার সরব হব। শোক প্রকাশ করব,প্রতিবাদ জানাব। একসময় থেমে যাব চিরাচরিত প্রথায়। আমরা কি তাহলে দূর্ঘটনা ঘটার জন্য অপেক্ষা করি,অপেক্ষা করি ডিজিটাল শোক প্রকাশ এবং প্রতিবাদের? হয়ত আমরা মনের কষ্টের অনুভূতিগুলো সেই মুহূর্তে সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই। এইজন্যেই লিখি। কিন্তু এই লেখালেখিগুলো কেন সারাবছর ধরে চলেনা? যদি আমরা সবাই মাসে একবার করে এই দূর্ঘটনাগুলো,সমাজের অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে পোষ্ট দিতাম—হয়ত লাভ তেমন হতনা,তবে অন্ততঃ নিজেদের মনের মধ্যে এটুকু আশা জাগিয়ে রাখা যেত আমরা শুধু একদিনের হুজুগে বাঙ্গালি না,আমরা নিয়মিত প্রতিবাদের অক্ষরে জানিয়ে দিচ্ছি--আমরা অন্যায় মানিনা।
***************
আমাদের একটা বড় ধরণের খারাপ স্বভাব হচ্ছে আমরা সবসময় অন্যকে হেয় করে কথা বলতে পছন্দ করি। এর কারণ কি? আমি চিন্তা করে এর কারণ বের করলাম,এটা আসলে এক ধরনের হীনমন্যতা। আমি নিজে কিছু করতে পারিনাই,কাজেই আরেকজন যখন ভাল কিছু করছেন—তাঁকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখ। বাংলাদেশের মানুষজনের এই মুহূর্তে এই স্বভাব থেকে বের হ্ওয়া খুব প্রয়োজন। পেছন দিকে টানার কয়েকটা উদাহরণ দিই-
এই সামহোয়্যারইন ব্লগেই একদিন একটা কমেন্ট পড়েছিলাম। এক পোষ্টে লেখা ছিল এক ভদ্রমহিলা ব্যাংকে চাকরি করেন এবং মাসে ৭০,০০০ টাকা আয় করেন। তখন আরেকজন কমেন্ট করেছিলেন,নিশ্চয় ঐ মহিলার চরিত্র খারাপ,নাহলে ব্যাংকে চাকরী করে এত টাকা ইনকাম করে কিভাবে? এই একই ধরনের অসংখ্য কমেন্ট দেখা গেছে রুমানা সাঈদ যখন হসপিটালে শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন,তখন। হায়রে মানসিকতা! কেউ খুব উপরে উঠে গেলে চরিত্র খারাপ বানায় দাও,নষ্টা-ভ্রষ্টা অপবাদ দাও। বিশেষ করে মেয়েদের চরিত্র খারাপের অপবাদ দেওয়াটা অনেক সোজা।
পরিমলের সহযোগী কিছু মানুষের পরিমলের সাফাই গেয়ে অসংখ্য ব্লগীয় এবং ফেসবুকীয় কমেন্ট আমি এখনো ভুলিনাই। ফেসবুকে একটা গ্রুপে একজন কমেন্ট করেছিল,"অশ্লীল ড্রেস আপ পুরুষদেরকে প্রভাবিত করছে ধর্ষণ করতে।" আমি সাধারণত এই ধরনের কমেন্ট যারা করে তাদেরকে এড়িয়ে চলি,কথা বলার রুচি হয়না। নর্দমার কীট মনে হয়। কিন্তু সেদিন হয়ত খুব বিক্ষিপ্ত ছিলাম,তাই আমি কমেন্ট করলাম,"শোনেন,ব্যাপারটা আসলে নৈতিকতার। যে মেয়ের বিবেকবোধ নাই,সে উল্টা-পাল্টা ড্রেস পরবে এবং যে ছেলের বিবেকবোধ বা নৈতিকতা নাই-সে সেটা হা করে গিলবে,তারপর ফেসবুকে কমেন্ট করবে—অশ্লীল ড্রেস আমাকে প্রভাবিত করেছে। তাই আমি হা করে মেয়েদের গিলেছি।" আমার কমেন্টের প্রতিউত্তর আসল,"যারা মেয়েদের অশালীন ড্রেস দ্বারা প্রভাবিত হয়না,তারা এক একটা হিজড়া।" আমি পুরুষের পৌরুষত্বের নমুনা দেখে হতভম্ব হয়েছিলাম,ফেসবুকের সেই পোষ্টে আর কোন কমেন্ট করিনি। পুরুষ মানুষটা পৌরুষত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে এক নিমিষে ধর্ষণ জায়েজ বানিয়ে দিল। তার কাছে পরিমল ধর্ষণের বিচার চেয়ে শহীদ মিনারে ন্যায়ের সপক্ষে প্লাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত মানুষের প্রতিবাদের কোন দাম নেই!
মেয়েদের ব্যপারগুলো বাদ দিই। নাহলে অনেকে আমাকে নারীবাদী ট্যাগ দিয়ে দিবেন। তারেক মাসুদ মারা যাওয়ার পর অনেক মানুষকেই বলতে শুনেছি,"রোজা রমজানে শুট্যিং স্পট দেখতে যাওয়ার কি দরকার?” মানুষের উর্বর মস্তিষ্কের কথা শুনে আমি মুগ্ধ।
****************
এইটা তো গেল সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে করা মন্তব্যগুলো। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যার এবং ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসকে নিয়ে যে পরিমাণ আজেবাজে কথা হয়েছে,সেই কথাগুলোর জন্য-ই কি তাঁদের এই দেশটা থেকে শ্রদ্ধা উঠে যাওয়া উচিত ছিলনা? অথচ তাঁরা নিরলস ভাবে দেশকে দিয়েই গেছেন। যাঁরা কথা কম বলেন,তাঁরা কাজ করেন বেশি। আর আমাদের এক শ্রেনীর অকৃতজ্ঞ জাতি কি করে? জাফর স্যারকে নিয়ে কোন লেখা আসলেই “বেটা তো আওয়ামীলীগের দালাল,ভণ্ড” এই সব বলে গালাগালি করে। (আমি জানি,সেই অকৃতজ্ঞ দলের যে কেঊ এই লেখাটা পড়লে গালিগালাজ করতে আসবে। আমি আগেই বলে দিচ্ছি তার কাছে আমার প্রশ্ন থাকবে—তুমি দেশের জন্য কি করেছ? একটা গণিত অলিম্পিয়াড? একটা শিক্ষানীতির খসড়া? নাকি দেশকে ভালোবাসার চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটা লেখা লিখেছ? যদি কিছুই না করে থাক--জাষ্ট গেট লষ্ট,জাফর স্যারের সমালোচনা করার যোগ্যতা তোমার নেই।)
দুঃখজনক হলেও সত্য, এই নেতিবাচক কমেন্টকারী মানুষ যেমন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে আছে,ইন্টারনেট যারা ব্যবহার করেন না—তাদের মধ্যেও আছে। সংখ্যাটা নেহাত-ই কম নয়। আমার এই নেতিবাচক কমেন্টকারী মানুষগুলোকে খুব বলতে ইচ্ছা করে,"ভাই,আপনি পরকীয়া করে হলেও মাসে ৭০,০০০ টাকা কামান তো,দেখি পারেন কিনা?” অথবা ইচ্ছা হয় বলি,"মাটির ময়না বানাতে যে মেধা দরকার তা কি আপনার আছে? নাকি সব মেধা কমেন্ট করতে গিয়েই শেষ হয়ে গেল?” কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারিনা। কারণ আমি ভাষাহীন,আমি বোবা,আমি মূঢ়। আমিও আর দশটা সাধারণ বাঙ্গালির মত প্রতিবাদ করতে ভয় পাই। প্রতিবাদ করলেই নাকি আজকাল মাথার উপর নেমে আসে রাষ্ট্রদ্রোহিতার খড়্গ,জেলের ঘানি টানার ভয়। হায়রে গণতন্ত্র!
************
বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর মুহাম্মদ ইব্রাহিম স্যার তাঁর ছাত্রদের একটা কথা বলতেন,"You should not be sympathetic, you must be empathetic to your patients."—“তোমরা রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীলতা না,সহমর্মিতা প্রদর্শণ কর।" চমৎকার একটা কথা। এখানে সহমর্মিতা মানে কি? এখানে সহমর্মিতা মানে হচ্ছে—একজন অসুস্থ মানুষ যে পরিস্থিতিতে আছে,সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে দাঁড় করাও। মানুষকে অনুভব কর নিজেকে দিয়ে।
আমরা কতজন নিজেকে দিয়ে অন্যকে অনুভব করি? আমি জানিনা। যদি আমরা আসলেই সহমর্মী হতাম,তাহলে একবার ও উচ্চারণ করতাম না পরিমল দ্বারা নিপীড়িত মেয়েটাই দোষী। আমাদের সেই ছোট্ট আপুটা কেমন আছে,কতটা কষ্ট পাচ্ছে—সেই জিনিসটা আগে অনুভব করতাম,বোঝার চেষ্টা করতাম। রুমানা সাঈদকে নষ্টা বলার আগে অনুভব করতাম একজন অন্ধ মানুষকে—যিনি কিছুদিন আগেও পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ অনুভব করেছেন। তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর ক্যামেরার সামনে মাইক্রোফোনে অবিবেচক মন্তব্য করার আগে আমাদের মন্ত্রী মশাই যদি একবার,শুধু একবার অনুভব করতেন তারেক মাসুদের ছোট্ট ছেলে নিষাদের কষ্টটুকু অথবা মীরসরাইয়ের শিশুদের পরিবারে এক লক্ষ টাকা তুলে দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসার আগে মন্ত্রীরা যদি অনুভব করতেন সেই পরিবারগুলোর বুকফাটা আর্তনাদ—আমার ধারণা মন্ত্রী মশাই কেন,আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তথাকথিত দেশ প্রেমিক না সেজে সাথে সাথে পদত্যাগ করতেন। কিন্তু হায়! আমাদের অনুভব করার অনুভূতি যে নষ্ট হয়ে গেছে! ক্ষমতার কাছে অনুভূতি পরাজিত।
**************
আমাদের দেশের বর্তমান প্রজন্ম এখন রাজনীতি বিরোধী। কোন একটা অঘটন ঘটলেই আমরা রাজনৈতিক নেতা,মন্ত্রীদের গুষ্টি উদ্ধার শুরু করে দিই। তারপর যখন ভোটের সময় আসে—আমাদের বাবা-মা,আমরা ভোট দিয়ে আসি সেই বিখ্যাত দুই রাজনৈতিক দলের কোন একটিকে। গত নির্বাচনে “না” ভোটের ব্যবস্থা ছিল,তবুও আমরা “না” ভোট দিইনি। (আমি অবশ্য গত নির্বাচনে ভোটার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করিনি। আমি ভোট দিতে পারলে ‘না” ভোট-ই দিতাম।) আমি নিশ্চিত গতবারের মত এবার-ও “না” ভোট কম পড়বে—হয়ত শুধুমাত্র ক্ষমতার পালাবদল হবে। এর কারণ কি? যেখানে আওয়ামী লীগ,বিএনপি কেউ-ই দেশকে ভালো কিছুই দিতে পারেনি তারপর ও আমাদের রাজনীতি কেন এখনো দুইটা প্রধান দলের বাইরে যেতে পারেনা? এর কারণ আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের ব্রেইন এখনো ওয়াশড হয়ে আছে। আর যারা সরাসরি ছাত্র-রাজনীতির সাথে জড়িত,সেইসব তরুনের কথা নাই বলি। তারা পুরোপুরি প্রভুভক্ত কুকুরের মত হয়ে গেছে। তাদের উচ্চারিত “ঘেউ”টাও দলের প্রশংসামূলক। আর আমাদের মত আমজনতার আসলে কি-ই বা করার আছে এই দুই দলকে ভোট দেওয়া ছাড়া? সাধারণ মানুষের পক্ষে নিজেরাই একটা নতুন রাজনৈতিক দল খোলা সম্ভব না—আসলে ইচ্ছাও নেই,প্রয়োজন ও নেই,কারণ আমাদের চিন্তা-ভাবনা এখন আর সামষ্টিক না, শুধুই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। কাজেই ভোট দিলে সেই দুই দলের কাউকে না কাউকে দিতেই হবে। এছাড়া উপায় নেই। সবখানেই যখন দূর্নীতি,তখন সুনীতির পক্ষে সাফাই গাওয়ার মানুষের সংখ্যা কম হবে--এবং কেউ সাফাই গাইলেও তাঁকে ধরে বেঁধে থামিয়ে দেওয়া হবে—এটা তো আমাদের দেশের সাধারণ চিত্র।
গত বিশ বছর ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনৈতিক চক্রে বন্দী। আরো নির্দিষ্ট করলে বললে হাসিনা-খালেদার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর উন্নয়নের জোয়ারে (!) বন্দী। এ থেকে কবে মুক্তি পাব আমরা কেউ জানিনা। তবে একটা পরিবর্তন মনে হয় খুব প্রয়োজন,খুব বেশি প্রয়োজন। বাকের ভাইয়ের মত নাটকের একটা চরিত্রের জন্য যদি এই দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে মিছিল করতে পারে--তাহলে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি,রাষ্ট্রপতির অবিবেচক সিদ্ধান্তে ফাঁসির আসামী ছাড়া পেয়ে যাওয়া,মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার ব্যাপারগুলোর প্রতিবাদে সবাই একত্রিত হয়ে কেন রাস্তায় নামে না? পরিবর্তন কি তবে আমরা চাইনা? উত্তর—আমরা আসলে পরিবর্তন চাইনা। আমরা নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই। নিজেদের পরিবার-পরিজনদের মাঝেই আমাদের জীবন সীমাবদ্ধ। তাই আমরা ফেসবুকে,ব্লগে দুইএকটা লেখালেখি করে দেশ নিয়ে আমাদের কর্তব্য শেষ করতে চাই। আমরা ঝামেলায় জড়াতে চাইনা। আমরা ভয় পাই। তাই ঘরের ভিতরে লুকিয়ে থাকি। আমরা দূর থেকে পলান সরকার অথবা জয়নাল চাচার দেশপ্রেমকে স্যালুট জানাই কিন্তু নিজেরা ভালো কিছু করতে আগ্রহ বোধ করিনা।
**************
সত্য কথা বলতে কি,আমি নিজে যে এত বড় বড় লেকচার দিচ্ছি,আমি নিজেও সেই এক-ই “ভীতু অথবা অনুভূতিহীন” মানুষ গোত্রের। তবুও মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছা করে নিজের মরে যাওয়া অনুভূতিটাকে জাগিয়ে তুলি। ঠিক তখন-ই আমি লিখি। দেশটাকে নিয়ে লিখি,স্বপ্ন দেখি। বহুদিন আগে আমার এক বন্ধু বলেছিল,"বাংলাদেশ একটা গরীব দেশ।" তখন ছোট ছিলাম,আবেগ বেশি ছিল--ঠুস করে দেশপ্রেম জেগে উঠেছিল,আমি প্রতিবাদ করে বলেছিলাম,"বাংলাদেশ মোটেই গরীব দেশ না,উন্নয়নশীল দেশ।" তারপর অনেক তর্কবির্তকের পর আমার বন্ধুটি বলেছিল,”আচ্ছা যা! তোর কথাই ঠিক।“ আজকাল যখন সেই ঘটনাটা মনে পড়ে,আমি নিজের ভেতর কুঁকড়ে যাই। কোন সাহসে সেদিন ছোট্ট আমি অনেক বড় বড় কথা বলেছিলাম মনে পড়েনা। আজ আমি আর প্রতিবাদ করতে পারিনা—কারণ যে দেশে মধ্যবিত্ত মানুষেরাই বাজার নিয়ে হিমসিম খায়,খেতে পায়না ঠিকমত,আর আরেক শ্রেনী ব্যাংককে ঈদের মার্কেটিং করে—সেই দেশ গরীব নাকি উন্নয়নশীল আমি ঠিক বুঝে উঠিনা। আমি আজকাল আমার দেশের মানুষের আচরণ বুঝিনা। শিক্ষা বুঝিনা। তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনেকের কানে হেডফোন লাগিয়ে উচ্চস্বরে ইংলিশ গান আর পার্টিতে হিন্দি গান শোনার কারণ বুঝিনা। তাদের প্রতিবাদহীন আচরণের কারণ বুঝিনা। শুধু বুঝি কেউ কেউ আমার মত আছেন—যারা বোবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন,কিন্তু কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেননা। কিছু করতে চেয়েও করতে পারেননা। কারণ, এখন যুগটাই আসলে—“চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।"
******************
আমি নিতান্ত-ই সাধারণ একজন মানুষ। আর দশটা মানুষের মত হিপোক্র্যাট আচরণ আমার মধ্যেও আছে। নিজে যা বলি,অনেক সময় নিজেই সেটা করিনা। আমার লেখালেখি শুধু ব্লগেই সীমাবদ্ধ। কোনদিন আমার লেখা পত্রিকার পাতায় ছাপা হবেনা। আমি সুন্দর লিখতে পারিনা,তাই জাফর ইকবাল স্যার অথবা আনিসুল হকের মত করে আমার লেখা কারো বিবেকবোধকে নাড়া দিয়ে যাবেনা সেটাও জানি। তবুও মনের ভেতর কিছু কথা আকুপাকু করে,সেই আকুপাকু কথাগুলো বের করে দেওয়ার জন্য-ই আমি লিখি। আমি চাই,আমাদের সবার মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই “আকুপাকু”টা জেগে উঠুক। আমরা গতানুগতিক প্রেমের কাব্য বা গল্প লেখার পাশাপাশি দেশটাকে নিয়ে ভাবি,দেশের জন্য অল্প অল্প করে কাজ করি, এই দেশটাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত কিছু লেখা লিখি। সেই লেখার অক্ষরে অক্ষরে ফুটে উঠুক প্রতিবাদ,আর আমাদের ভেতর থেকে উঠে আসা উচ্চারণগুলো হোক শোকের।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১১ সকাল ১১:৩৭