অকেজো টর্চটা হাতে নিয়ে তারার আলোয় পথ চলতে লাগলাম। যখনই তেঁতুলগাছটার নিচে আসলাম আমার চোখে হঠাৎ লাগলো ব্রীজ হতে যেই রাস্তাটা এই রাস্তার সাথে মিশেছে, সেই রাস্তা দিয়ে সাদা কিছু একটা ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে। আমি সাথে সাথেই দাড়িঁয়ে পড়লাম ভাল করে লক্ষ করলাম আমি ঠিকই দেখছি ভুল নয় সাদা আলখাল্লার মতো কিছু একটা এগিয়ে আসছে এদিকেই। রাস্তার দুপাশে হালকা ঝোপঝাড় থাকায় ঠিক খেয়ালও করা যাচ্ছে না কি ওটা। (অনেকে হয়তো সন্দেহ করছেন ,আধাঁরের মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি কিভাবে)?লক্ষ করলে দেখবেন যতই আধাঁর হোক সাদা রংএর রিফ্লেকশানটা সব সময়ই চোখে ধরা পরে। তাছাড়া তারার আলোয় সাদা রংটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে কিন্তু ওটা কি সেটা বুঝা যাচ্ছে না।
অমাবশ্যার রাত,আলোহীন একা একটা মানুষ,তিন রাস্তার মোড়,তেতুল গাছের নিচে,পুরোনো গোরস্তান,ভুতের আদর্শ সময় ফজরের আজানের পূর্বমূহুর্ত। এটা অবশ্যই ভুত, কারণ ভুতের জন্য যেই উপাদান গুলো প্রয়োজন শুনেছি, সবই এখানে বিদ্যমান। সুতরাং সঠিক সিদ্ধান্ত হবে একটা দৌড় দেওয়া। বাজারের দিকে যাওয়া যাবে না কারণ তাতে ঐ সাদা জিনিসটার সামনে পরার সম্ভাবনা শতভাগ। উল্টো পথে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোন গতি নেই। এক মুহুর্তে ভাবলাম দেই দৌড় কিন্তু কৌতুহলি মন আমায় বাঁধা দিচ্ছে। এমন সুযোগ আর নাও পাওয়া যেতে পারে। এতোদিন যেটার কথা লোক মুখে শুনে এসেছি আজ দেখার সুযোগ পেয়ে দৌড়ে পালাবো? যদি বেঁচে থাকি ভবিষ্যতে আমিও কারো কাছে গল্প করতে পারবো হ্যাঁ আমিও দেখেছি। মাটি যেন আমার পাগুলোকে আঁকড়ে ধরে আছে যাতে আমি দৌড় দিতে না পারি। আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম মুহুর্তকাল কিছুই কারার নেই আমার নিজের পাগুলোও আমার অবাধ্য যতই ভাবছি দৌড় দেবো ততই পাগুলো সামনের দিকে যাচ্ছে। আমি ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সাদা জিনিসটা এগিয়ে আসছে। শীতের মাঝেও আমার সোয়েটারের ভিতর শরীর ঘেমে গেছে। মাথার পিছনের চুলগুলো দাড়িয়ে গেছে শক্ত হয়ে। শিরদাঁড়া দিয়ে শিরশিরিয়ে ভয়ের স্রোত নামছে। কিন্তু আমি অসহায়,চিৎকার করার শক্তিও আমার নেই। আর চিৎকার করলেও কেউ শুনবে কিনা জানি না কারণ আশেপাশে অনেকদূর পর্যন্ত কোন বাড়ি ঘর নেই।
আমি চাবি দেওয়া পুতুলের মতো ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম। আমি যখন দুই রাস্তার সংযোগস্থলে এসে দাঁড়ালাম তখন সাদা জিনিসটার আকৃতি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগলো। সেটাও এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,"বাবা তুমি কোন বাড়ির, এই সময় এইখানে কি কর"? আমি ওটার দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলাম। আমার মনে হতে লাগলো কথাগুলো বহুদূর কোন গ্রহ হতে আমার কানে আসছে। কিন্তু কোন উত্তর দিতে পারছি না। আরো দুইবার জিজ্ঞাসা করেও কোন উত্তর না পেয়ে একটু ধমকের সুরেই বলল,"ঐমিয়া কথ কও না ক্যা"? আমি ধাতস্থ হয়ে আমার পরিচয় বললাম। আমি শহর থেকে এসেছি এই গ্রামের ওনি আমার চাচা হন আমার আরো দুজন লোক আসছে তাদের এগিয়ে নিতে আসছি।
আমি বার বার সাদা জিনিসটার দিকে তাকাচ্ছিলাম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার সামনে যেটা দাঁড়িয়ে আছে সেটা একটা মানুষ, একজন বৃদ্ধ লোক। সাদা লম্বা জোব্বা পরিহিত মুখে সাদা দাড়ি হাতে একটি লাঠি।
আমি জানতে চাইলাম,"।আপনি এই সময় এখানে কেন"? ওনি বললেন, "ওনি বাজারের মসজিদের মোয়াজ্জেম ও ইমাম আজান দিতে মসজিদে যাচ্ছে"। আমরা দুজনই পাশাপাশি হেঁটে বাজারে আসলাম ওনি মসজিদে ঢুকে গেলেন। এই প্রথম দেখলাম বাজারে একটা টিনের তৈরী মসজিদও আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আজান হলো। আমি চুপচাপ রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে রইলাম তখনো ভয়ের রেশটা যেন রয়ে গেছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমি এতক্ষণ একটা মানুষের ভয়ে অস্থির ছিলাম।
আমার অলৌকিক বিশ্বাসে দেয়ালে এটাই প্রথম আঘাত।
তখনই দেখলাম দুই বন্ধু হেঁটে আসছে। জানতে চাইলাম,"কিরে এতো দেরি কেন রিক্সা কই"?
ওরা বলল,"রিক্সা অর্ধেক রাস্তায় নষ্ট হয়ে গেছে, তাই সেখানে রিক্সা ছেড়ে দিয়ে বাকি পথ হেঁটেই চলে এলাম তাই দেরি"।
আমি বললাম,"ভাগ্যিস তোদের রিক্সা নষ্ট হয়ে গেছে তাই আজ একটা বড় অভিজ্ঞতা হলো"।
আর মনে একটা প্রশ্নের উদয় হলো, ভুত প্রেত তথা অলৌকিকতা আধ্যাত্মিকতা বলে পৃথিবীতে আদতেও কিছু আছে কি??
সেই রাতেই বিশ্বাসের দেয়ালে প্রথম আঘাতটা করলো কৌতুহল সাহস আর যুক্তি।
এরপরও জীবনে অনেকবার এমন পরিস্থিতিতে পরেছি। সেই গল্প আরেকদিন।।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:১৬