somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

|~বর্ষা থেকে হেমন্তঃ মাঝে এক শরতের প্রেম উপাখ্যান~|

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৮:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

”ভোরের শুকতারার সাথে এক নিশিজাগা বালকের খুব ভাব হয়েছে। রাত জেগে নিশিজাগা বালক আঁধার পাহারা দেয়, আঁধারের ঘ্রাণ মুঠো ভরে রাখে। নক্ষত্র ঘড়ির দিকে তাকিয়ে গুনে যায় প্রহর। অতঃপর ভোরের আঁধারে খুব করে গল্প করে ওরা দু'জনে। শুদ্ধ শুভ্র বন্ধুত্ব দেখে মুচকি হাসে লিলুয়া বাতাস। সে হাসি এক শীতল পরশ বয়ে আনে নিশিবালকের মনে-দেহে! লিলুয়া বাতাস কানে কানে বলে যায়, শুকতারাকে ধরে রেখো। শুকতারারা হারিয়ে যায় না।“

এমনি এক বর্ষার ভোরে গল্পের শুরুটা হয়েছিল। বালকের সাথে শুকতারা প্রায় রাতেই গল্প করতো। খুব ভালো বন্ধু বনে গিয়েছিলো তারা দুজনে। বালকের মনে তখন বর্ষার মেঘের মত কালো দুঃখ। দুঃখগুলো খুব গোপনে বন্ধু শুকতারার সাথে ভাগাভাগি করত।

বালকের দুঃখ শুনে শুকতারা বলে, “মাঝবর্শায় আমি কিছু মেঘ পাঠাবো আকাশের ঠিকানায়, দেখে নিও। তাদের মাঝে একটি মেঘ পাবে- অনেক কালো মেঘের মাঝে একটি সাদা মেঘ। ওতে দুঃখ ছুঁইয়ে দেখো, সাদা মেঘ হয়ে যাবে কালো। তোমার দুঃখে ছোঁয়ায় কালো মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরবে। তাঁকে ধরে রেখো। সে পারবে তোমার দুঃখগুলো মুছে দিতে।“


সেদিন থেকে নিশিজাগা বালক নীল আকাশের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। কখন পাবে মেঘের দেখা সে আশায় বুক বাঁধে। আশার প্রহর ফুরোয় এক সময়। বর্ষারই কোনও এক নির্ঘুম রাতে খুব বৃষ্টি হয়। সারারাত বৃষ্টির পর ভোরবেলা থামে বৃষ্টি। আকাশের দিকে তাকালে যেন মনেহয় আকাশ হালকা হয়েছে কেঁদে কেঁদে। একটু একটু করে আলো ফুটতে থাকে। সহসা নীল আকাশে হঠাৎ বায়ুকোণে একগুচ্ছ মেঘের ভেলা ভাসতে থাকে। একটুকরো সিমুলাক্রা মেঘ যেন আকার বদলে এক পাখির রূপ ধারন করে। নির্ঘুম বালক দেখেই বুঝতে পারে শুকতারা তাঁকে এই মেঘের কথাই বলেছিলো। মেঘের সেই পাখিকে দেখে বালক আকাশের ঠিকানায় চিরকুট লিখে-

“পরিপাটী নীল জামদানী পরে খুব রানী রানী। গলাতে মুক্তার মালা কানে ঝুমকো দুল, হাওয়াতে ওড়ে যেন এলমেলো চুল। হাতে চুড়ি এলেবেলে, কপালেতে টিপ, মুখেতে মুচকি হাসি যেন সবঠিক”

এই চিরকুট চোখ এড়িয়ে যায় সেই মেঘপাখির। এদিকে বালকটি অপেক্ষা করতে থাকে তাঁর চিরকুটের উত্তরের। অপেক্ষায় অপেক্ষায় দিন পার হয়ে আবার ও রাত আসে। আবারো নির্ঘুম বালক। যেই আকাশের ঠিকানায় চিরকুট পাঠিয়েছিলো বালকটি সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখে চিরকুট আটকে আছে, মেঘের কাছে পৌঁছেনি। শেষে নিজেই চিরকুটটি দিয়ে কাগজের বিমান বানিয়ে ছুড়ে দিলো সেই মেঘপাখির কাছে। নীল কাগজের বিমানে লেখা বালকের ভালোলাগার কথা জানতে পারলো মেঘ। সেদিন থেকেই মেঘপাখির সাথে খুব ভাব হল বালকের।

এভাবেই প্রতিদিন একটু একটু করে কথা পিঠে কথা সাজাতে সাজাতে দুজন দুজনার দুঃখ সুখের ভাগাভাগি করে যাচ্ছিলো। বালকটা ছিলো খুব স্বপ্নবাজ, কিন্তু তাঁর স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে যেতো। স্বপ্ন ভাঙ্গার দুঃখ বালক বয়ে বেড়াতো বছরের পর বছর। সে একটা একটা করে স্বপ্নের কথা শুনাতো মেঘপাখিকে। বলত স্বপ্ন ভাঙ্গার কি দুঃখ। সেই শুকতারা যেমনটা বলেছিলো; বালকের দুঃখ শুনে মেঘপাখিটার খুব খারাপ লাগতো, সে চাইতো বালকের দুক্ষগুলো নিজের করে নিতে।


কিছুদিন পর নির্ঘুম রাতের পর সকালে যখন বালকটা ঘুমে বেঘোর, জানালো চৌকাঠে তখন এক কাঠঠোকরা ঠক ঠক ঠুকে যাচ্ছে। ঘুম চোখে জানালা খুলতেই কাঠঠোকরা জানালো সে মেঘপাখির বার্তাবাহক। আজ মেঘপাখি আকাশ থেকে নেমে পাশে বসতে চায় বালকের।

খবর পেয়ে খুব খুশি হয় বালকটি। বার্তাবাহক কাঠঠোকরাকে সে জানিয়ে দেয় মেঘ যেনো সময় মতো এক সবুজ মাঠের পাশে লেকের ধারে চলে আসে।

সময়মত দুজনেই সেই লেকের ধারে চলে এলো, এই প্রথম খুব কাছ থেকে মেঘকে দেখলো বালক। পাশাপাশি বসে কথা হল। দেখতে দেখতে অনেকটা সময় তারা পাশাপাশি বসে অনেক কথাই বলল। শেষে যে যার বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় মেঘপাখিটা বালকের হাতে তুলে দিয়েছিলো, এক টুকরো মেঘের পালক।

যাবার বেলায় নিশিবালক মেঘপাখির পাশে হেঁটে, মনে মনে বলেছিলো-

“আকাশের এক কোনে কিছু বিষাদগ্রস্থ মেঘ জমে আছে। নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যায় উষ্ণ বাতাসে। ব্যাস্ত কোন পাখির চোখে সময়কে জমা রেখে আমি থেমে যাই। বিস্বস্ত সম্মোহনে বিষাদগ্রস্থ মেঘের সাথে বন্ধুত্ব গড়ি। হে মেঘ, তোমার ঐ মেঘপ্রাঙ্গনে আমার কিছু বিষাদ জামা রাখো ক্ষনিকের জন্য।“

সেদিনের পর থেকে আরো কাছাকছি আসতে থাকে দুজন। কথা বাড়ে, বাড়ে ভালোলাগা। ভালোলাগাগুলো একটু একটু করে জমিয়ে জমিয়ে নিশিবালক বুঝতে পারছিলো, বালকের মনের কথা ঠিক বুঝেছিলো মেঘপাখি।

“গত ক'দিন খুব বৃষ্টি হয় ভোর বেলা। ভোরের যে শুকতারার সাথে নিশিবালকের বন্ধুত্ব সে কেবল তাকিয়ে থাকে আকাশ পানে। মেঘের আড়ালে থেকে নিশিবালক আর মেঘের ভাব দেখে মুচকি হাসে শুকতারা। পাখি ডাকা শুরু করলেই শুকতারাটা হারিয়ে যেতে থাকে, মিলিয়ে যায় আকাশের বুকে।“

নিশিবালক ছিলো নিশাচর। কিন্তু মেঘপাখিটা নিশিবালকের এই রাত্রিজাগা একদমই পছন্দ করতো না। এদিকে বর্ষা ফুরিয়ে আসছে প্রায়। শরত সমাগত। বালকের প্রতি কড়া নির্দেশ আর রাত জাগা যাবেনা, সাথে পালটে ফেলতে হবে নাম। তাই শরতের স্নিগ্ধ রাতের মেঘের কোলে ভেসে থাকা চাঁদের সাথে মিল রেখে বালকের নাম দেয়া হল শরত, শরতশশী। তাঁর পর থেকে বালককে শরতবালক নামে ডাকা হয়।

বর্ষা প্রায় শেষ। শরতকাল আসি আসি করছে। শরতবালক খুব বুঝতে পারে সে মেঘপাখির প্রেমে পড়েছে। তাই সে আকাশের ঠিকানায় আবারো চিরকুট লেখে-

“তুমি আমি; আমরা দু'জনই জানি, শ্রাবণ শেষ হতে বাকি আর মাত্র সাতটি বিকেল। তবুও আঙুলের কর গুনে বলেছিলে, অনামিকার তৃতীয় কররেখায় জমা রেখেছো এই বর্ষার শেষ মেঘদিন। সে হিসেবে তোমার অনামিকা এখনো বর্ষার কাছে সপ্তজলদ ঋণী। ঠিক সপ্তম বিকেলে, এই বর্ষার শেষ বর্ষণের পর যখন রংধনু উঠবে; তখন তোমার অনামিকায় পরিয়ে দিবো আসন্ন শরতের কাঁচা ধানপাতার আংটি।“


মেঘপাখি কি চিরকুটটা পেয়েছে কিনা এই নিয়ে শরতবালক কিছুটা সংশয়ে থাকে। তবুও সে আর খোঁজ নেয়নি আকাশের তরে চিঠিটা ঠিকঠাক পৌঁছেছিল কিনা। সে ভাবে তাঁর ভালবাসা যদি সত্যি হয় তবে চিরকুট ঠিকই পৌঁছে যাবে মেঘের কাছে।

তারপর মেঘপাখির সাথে নিয়মিতই কথা হয় শরতবালকের। ভালোলাগার, খারাপলাগার বিনিময় হয়। কথা হয় জীবনের মরনের। কথায় কথায় সে বুঝাতে চেয়েছে তার মনে ভালবাসা জমছে পাখিটির জন্য। শরতের খুব ভালো লাগতো মেঘপাখিটার কথা শুনতে। চুপচাপ শুনে যেতো। আর কথা ফাঁকে ফাঁকে খুঁজত মেঘপাখির মনের কথা। পাখিটা কি চিরকুট পেয়েছিলো? সেই প্রশের উত্তর খুঁজত।

এভাবেই কেটে যায় আরো কিছুদিন। শরতকাল পূর্ণরূপে তার আদল সাজিয়েছে প্রকৃতিতে। মেঘেপাখির মন পড়ে পড়ে যখন শরতবালক কিছুই বুঝতে পারেনা, অভিমান হয় তার। তাই সে আবারো আকাশের ঠিকানায় চিরকুট লিখে পাঠায়-

“বর্ষা শেষে শরৎ এলো। তোমার আঙ্গুলের কর শ্রাবণের শেষ দিনে জলদ ঋণ চুকিয়ে দায়মুক্ত হয়েছে। কথা ছিলো এমন সময়ে তোমার অনামিকায় কাচা ধানিপাতার আংটি পরিয়ে ভালোবাসার শিউলি বসত গড়বো। হয়নি, আমি দীনহীন প্রেমিক, দৈন্যতার শিকল কি আর শরৎ শিউলি ভাঙতে পারে? হয়ত পারে, কখনো কখনো হয়ত ব্যার্থ হয়। আমি নাহয় দ্বিতীয় দলেই থেকে গেলাম। দল বদলের প্রয়োজন নেই, কেবল তুমি জেনে রেখ- আমি শরতের ব্যার্থ দলে আছি।‘’

অভিমান বুকে নিয়ে কাটলো আর কিছুদিন। শরতবালকের জন্মদিন এলো এরই মাঝে। সেদিন মন খারাপ করে ছিলো শরত মেঘপাখিকে জানালো আজ তার জন্মদিন। মেঘপাখিও শুভেচ্ছা জানালো। কিন্তু সবচাইতে বড় চমকটা ছিলো সেদিন রাতে। রাতের বেলা সুবিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে মেঘপাখিটা উড়ে যাচ্ছে। পাখির ডানায় করে উড়ে যাচ্ছে আকাশের চাঁদ। মানে শরতের চাঁদ বুকে নিয়ে উড়ছে মেঘপাখিটা। মেঘপাখির চোখে ছিলো ভালবাসার সম্মোহন। সেই সম্মোহনের টানে শরতবালকের বুঝতে বাকি থাকেনা, মেঘপাখিটাও শরতশশী তথা শরতবালককে ভালবেসে ফেলেছে। শরতবালক বুঝতে পারে আকাশের ঠিকানায় পাঠানো সবগুলো চিরকুটই পেয়েছিলো মেঘপাখি।

সেই রাতেই মেঘকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে শরতবালক বলেছিলো-

“হাতের মুঠোয় তাকিয়ে দেখো রেখাগুলো হচ্ছে বিলীন করতলে। তুমি আমায়, তোমায় আমি ভাবছি যে আজ আপন করে।“

“বেশ বুঝতে পারি, যে হিমেল বাতাস শ্রাবণের শেষ প্রহরে অনুমতিবিহীন শিষ দিয়েছিলো তাতে ছিল তোমার মন পবনের গান। আজ বুকের খোলা বোতামের ঘরে জন্মেছে খুব যত্ন করে রোপণ করা মায়াঘ্রাণের কুড়ি। আজ থেকে প্রতি রাতে দূরত্ব কমে যাবে দুটো নক্ষত্রের। চন্দ্রাহত সময় ঘিরে নিঝুম শঙ্খবাস, চাঁদের আলোয় লিখেছি আমার সর্বনাশ। আজ জেনেছি, সূর্যগন্ধী মেঘের ঠিকানায় পোস্ট করা চিঠিটি বিরতিহিন পৌঁছে গেছে; শুনেছি তোমার ভাবনার আকাশবাণী হৃদয়তরঙ্গের নব ঘুরিয়ে। তোমার নামে একটি কাঁচা ধানিপাতার গাড় সবুঝ আংটি রেখেছি খুব গোপনে।


আমি বৃষ্টির শব্দে কান পেতে শুনেছি তোমার মনের অনুরনন,
আমি বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁয়ে জেনেছি কেন ভালবাসো আমার মেঘমন।“


মেঘপাখিও বলেছিলো-

“শরতের ব্যর্থ দলে তুমি নেই । আমি জানতাম সেই কাঁচা ধানিপাতার আংটি আমার জন্য ছিল।“

"ভাবনার মরচে তবে ছেয়ে যাক স্বপ্নের আবেশে
স্বপ্ন তবে কাছে এসে বসুক পাশে।"



তারপর থেকে প্রতিদিনই একটা করে চিরকুট পাঠাতো শরতবালক। খুব জমে উঠেছিল তাদের প্রেম। শরৎকালের মাঝামাঝি সময়ে ইচ্ছেপূরণ হল শরত বালকের। নবান্নের দিনের কাছে যে ধানিপাতার আংটি জমা ছিলো সেটা পরিয়ে দিলো মেঘপাখির অনামিকায়। কানে কানে বলে দিলো-

"আজ থেকে একটা হৃদয়ের সাথে আরেকটা হৃদয় যোগ হয়েছে, হৃদয় থেকে হৃদয়ে ঝোঁক বেড়েছে। শরতের সাথে খুব জমেছে মেঘনীলিমার প্রেম। বিকেলের কাঁচা রোদ পড়ে গেলে, সাদা মেঘের শাড়ী পরে মেঘনীলিমা শরতের হাতে হাত রেখে হেঁটে বেড়াবে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। মেঘনীলিমার খোঁপায় শরত গেঁথে দেবে একঝাক কচুরিপানার ফুল। রাত হলে পূর্ণিমাতে শরত হবে চাঁদ, মেঘনীলিমা হবে জ্যোৎস্নানূর। চাঁদ-জোছনার ভালবাসায় আলোকিত হবে চারিদিক। আমাবস্যাতে ওরা জোনাকি হবে। পাশাপাশি আলো জ্বেলে পাড়ি দিবে পথ। ওরা হবে স্বপ্নকারিগর। দুজন দুজনার চোখে স্বপ্ন আঁকবে, দেখবে, পূরণ করবে। আমি শরৎ হবো, আমি চাঁদ হবো শুধু মেঘনীলিমা, জ্যোৎস্নানূরের জন্য। তুমি আমার মেঘনীলিমা আমার জ্যোৎস্নানূর।“

মেঘপাখি সেদিন খুব খুশি হয়েছিলো, মুখে কিছু বলেনি শরতবালকের জানালার কাছে রেখে গিয়েছিলো নিজের একটা মেঘচ্ছবি- এক টুকরো আলো। যে আলোতে শরতবালক দেখতো দুজনার রঙ্গিন আগামী।

তারপর থেকে প্রতিদিনই একটা করে চিরকুট পৌঁছে যেতো আকাশেরর ঠিকানায়। মেঘপাখিটাও আসক্ত হয়ে পড়েছিলো শরতবালকের চিরকুটের প্রতি।

“আমি জ্যোৎস্নাপিপাসু চাঁদ এক, তুমি জ্যোৎস্না আমার,
তুমি আর আমি মিলে আকাশের গায়ে জলসা সাজাই।“


দুজনে রাতজেগে গল্প করতো, দুঃখ ভাগাভাগি করতো। স্বপ্ন দেখতো। মেঘপাখির সংস্পর্শে এসে শরতবালক তার সকল দুঃখ ভুলতে থাকে। সেই শুকতারার প্রতি কৃতজ্ঞ হয় সে, কৃতজ্ঞ মেঘপাখির কাছেও। মেঘপাখি তাঁকে দেখিয়েছে জীবনে বাচার আশা, শিখিয়েছিলো অনেক জীবনের মূলমন্ত্র। এই কথা সেই কথায় কেটে যাতো রাতের পর রাত।

“আমার একটা আদুরে রাতজাগা চড়ুই পাখি আছে,
আঙ্গুলে বসে বসে কথা বলে।“


এবার শরত ঠিক করে আর চিরকুট নয়। একেবারে প্রেমের চিঠিই দিবে সে মেঘপাখিকে। যেই ভাবা তো সেই কাজ। খুব যতনে চিঠি লিখে ফেলল সে। প্রায়ই মেঘাপাখিটা আসতো শরতবালকের কাছে , পাশে বসতো। কখনো ঘুরে বেড়াতো। এমনি এক দিনে নীল খামে করে চিঠিটি দিয়ে দেয় মেঘপাখিকে।

”একটা কাঠবাদাম ফুল রেখেছি বইয়ের ভাঁজে। কোন এক বসন্তের রোদহীন বিকেলে আমি হঠাৎ ঘুমিয়ে গেলে ফুলটা নিয়ে যেও তোমার কাছে। প্রতিটা পাপড়িতে লেখা আছে একটি করে প্রেমের চিঠি।“

এভাবেই শরৎকালটা যেন হয়ে উঠেছিলো মেঘপাখি আর শরতবালকের প্রেমঋতু। শরৎকাল কেটে গেল এভাবেই।

শরৎ শেষে এলো হেমন্ত। হেমন্তের শুরুতে আকাশ ছেয়ে গেলো কালো মেঘে। খুব বৃষ্টি হল খুব। সেই কালো মেঘের আড়ালে যেন মেঘপাখি ও কাঁদে। এদিকে শরতবালক মেঘপাখির কথা ভেবে ভেবে অস্থির। দিন যায় রাত যায়, মেঘপাখির দেখা নেই। হয়ত কোনও অজানা ভাবনা গ্রাস করছে মেঘপাখিকে। অজানা ভয়ে যে লুকিয়ে আছে। আবারো আকাশের ঠিকানায় চিরকুট পাঠায় শরতবালক-

‘’এই হৃদয়ের অরন্য এতটা গহীন তোমাকে ভালবাসার আগে বুঝিনি। মিছে কেন ভাবনা তবে হাত বাড়লেই আছি।‘’

এর কোনও উত্তর পায়না শরতবালক। হেমন্তের শুরুতে যে বৃষ্টি হয়েছিলো তাও থেমে গেলো। আকাশ পরিষ্কার- একেবারেই নীল। কোনও মেঘ্নেই আকাশে। নেই মেঘপাখিও। হ্যাঁ হেমন্তের নীল আকাশে মেঘ থাকেনা। তাই মেঘপাখিও আর আসেনা। হঠাৎ হঠাৎ যাও আসতো তাও ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু মেঘপাখির জন্য শরতের ভালবাসা কমেনা একটুও। সে আবারো চিরকুট পাঠায়-

"দৈন্য আমি। নিজের বলতে ছিলো আমার একটি হৃদয়-এই বুকে সযতন।
দেয়ার মত যা ছিলো একমাত্র ধন- তা কেবলই আমার অবুঝ একটা মন।‘’


হ্যাঁ, এই অবুঝ মন আর একটা হৃদয় ছাড়া দেবার মত কিছুই ছিলোনা শরত বালকের। কে জানে মেঘপাখি হয়ত আরো বেশি কিছু চাইতো। চাওয়াটাই স্বাভাবিক, মন আর হৃদয় দিয়ে কি পাখি পোষ মানে? তাও সে আবার মেঘপাখি।

কথিত আছে হেমন্তের বৃষ্টি নাকি দুঃখ বয়ে আনে। এই হেমন্তের বৃষ্টিও তেমনটাই দুঃখ এনেছিলো শরতবালকের জন্য। সেই বৃষ্টির পর থেকেই মেঘপাখি একটু একটু করে সরে যেতে থাকে বালকের কাছ থেকে।

শরতবালক প্রায় ই একটা স্বপ্ন দেখত। একটা সবুজ মাঠের মাঝে সে বসে আছে। তার পাশে বসে আছে এক সাদা পরীর বেশে কোনও এক লাবণ্য। কিন্তু সেই লাবণ্যের মুখবয়ব কখনোই খুজে পায়নি স্বপ্নে। কিন্তু যখন সে প্রথম মেঘপাখিকে দেখেছিলো তখন সেই লাবণ্যের যায়গায় বসিয়েছিল তাকে। ভেবেছিলো তার স্বপ্ন বুঝি সত্যি হবে।

কিন্তু বালক ভুলে গিয়েছিলো – আকাশের বুকে যে মেঘেরা ঘুরে বেড়ায় তারা সিমুলাক্রার। একেক সময় একেক আকার ধারন করে, কখনো মেঘখন্ড পরিনত হয় পাখিতে কখনোবা ফুলে। আবারর কখনোবা দানবে। শরতবালকের মেঘপাখিও হয়ত এখন আকার বদলে অন্য কোনও আকৃতি নিয়েছে ।

এসব মেঘদের ধরে রাখা যায়না, এসব মেঘরাও চায়না কোনও নির্দিষ্ট আকৃতিতে আবদ্ধ থাকতে । কারন বদলে যাওয়াই মেঘদের ধর্ম। এদের যায়না পোষ মানানো।

কিছু কিছু জিনিস নিয়তির উপরেই ছেড়ে দেয়া ভালো, হয়ত নিয়তিতে লেখা ছিলো এক মেঘপাখি এসে শরতের ভালবাসা হবে আবার শরতকে একা ফেলে চলেও চলে যাবে। এখন শরতবালক আবারও নিশিবালক।

আগের মতই রাত জেগে আঁধার পাহারা দেয়। আর সেই যে শুকতারা! যার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল। আবারো সেই বন্ধু শুকতারার সাথে রাত জেগে কথা বলে। বলেছিলাম না? শুকতারারা হারিয়ে যায়না। আর সেই অভিমানের কথাগুলো সত্যি হয়ে নিশিবালকটা আজ শরতের ব্যার্থ দলেই আছে।

মেঘপাখি চলে গেছে, তবুও সে আহত কোনো শরতের বুকে বেঁচে থাকা মেঘফুল।

----------------------------

© শশী হিমু
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে দেখা - ১৩ মে

লিখেছেন জোবাইর, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:০৩

১৩ মে ২০০৬


দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×