somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কিছু ধর্ম এবং দার্শনিক ধর্মগুরু কথা

২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ইদানিং বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে, বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা শুরু করছি নিজ ধর্ম সহ। আমার কাছে এই পৃথিবীর সব থেকে বড় রহস্যময় বিষয় মনে হয় ধর্ম। ধর্ম হল পারমানবিক শক্তির মত। কথা হল কে কোনভাবে ব্যাবহার করবে? কেউ কেউ পারমানবিক বোমার মত কেউ আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। ধর্ম মানুষকে অন্যায় করতে শেখায় না একটা নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতে সহায়তা করে কিন্তু সেই ধর্মই যখন কোন খারাপ মানুষের হাতে পরে সেটা হয়ে দাড়ায় মানুষ ধ্বংসের সব থেকে বড় হাতিয়ার।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতবর্ষে জন্মেছিলেন বুদ্ধ এবং মহাবীর ; চীনে কনফুসিয়াস এবং লাওৎসে এবং পারস্যে জরথুষ্ট্র বা জরোঅষ্টার (জরথ্রুষ্ট সম্ভবতঃ অষ্টম শতকে জন্মেছিলেন)। এবং গ্রীসের সামোস দ্বীপে জন্মেছিলেন পিথাগোরাস।



স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েদের ধারনা পিথাগোরাস বোধ হয় খুব বড় সড় একজন অঙ্কবিদ ছিলেন যার কাজই ছিল অঙ্ক বা জ্যামিতি নিয়ে কঠিন কঠিন ভাবনা চিন্তা করা, ছোটকালে খুব জ্বালাতন দিছে এই প্রাচীন বুড়ো, তার উপপাদ্যটি ছিল “কোন একটি সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল ঐ ত্রিভুজের অপর দুই বাহুর উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রদ্বয়ের ক্ষেত্রফলের সমষ্টির সমান।" কিন্তু একজন দার্শনিক বা কিছুটা ধর্মগুরু হিসাবে যে পিথাগোরাসের নাম আছে তা কয়জন জানি?



সামোসের পিথাগোরাস ( খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০– খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৫) ছিলেন এক জন গ্রিক দার্শনিক, গণিতবিদ এবং পিথাগোরাসবাদী ভ্রাতৃত্বের জনক যার প্রকৃতি ধর্মীয় হলেও তা এমন সব নীতির উদ্ভব ঘটিয়েছিল যা পরবর্তীতে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের মতো দার্শনিকদের প্রভাবিত করেছে। তিনি এজিয়ান সাগরের পূর্ব উপকূল অর্থাৎ বর্তমান তুরস্কের কাছাকাছি অবস্থিত সামোস দ্বীপে জন্মেছিলেন। ধারণা করা হয় শৈশবে জ্ঞান অন্বেষণের তাগিদে মিশর সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছিলেন।



বর্তমানে পিথাগোরাস গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হলেও তার সময় বা তার মৃত্যুর ১৫০ বছর পর প্লেটো ও এরিস্টটলের সময়ও তিনি গণিত বা বিজ্ঞানের জন্য বিখ্যাত ছিল না। তখন তাঁর পরিচিত ছিল, প্রথমত মৃত্যুর পর আত্মার পরিণতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যিনি ভাবতেন আত্মা অমর এবং ধারাবাহিকভাবে তার অনেকগুলো পুনর্জন্ম ঘটে, দ্বিতীয়ত ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান বিষয়ে পণ্ডিত, তৃতীয়ত একজন ঐন্দ্রজালিক যার স্বর্ণের ঊরু আছে এবং যিনি একইসাথে দুই স্থানে থাকতে পারেন এবং চতুর্থত, একটি কঠোর জীবন ব্যবস্থা যাতে খাদ্যাভ্যাসের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং আচারানুষ্ঠান পালন ও শক্ত আত্ম-নিয়ন্ত্রয়ণের নির্দেশ আছে তার জনক হিসেবে।আসলেই তাকে গণিতবিদ বলা যায় কিনা এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে প্রাচীনতম নিদর্শন অনুযায়ী পিথাগোরাস এমন একটি বিশ্বজগতের ধারণা দিয়েছিল যা নৈতিক মানদণ্ড এবং সাংখ্যিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত।



পিথাগোরিয়রা শুধু একটি দার্শনিক সম্প্রদায়ই ছিল না, তারা একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ও গড়ে তুলছিলো, যার মুল ভিত্তি ছিল জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস। দেহ শুধু আত্মার এক ধরনের যন্ত্র মাত্র। দেহের মৃত্যুর পর আত্মা অন্য কোন দেহে স্থানান্তরিত হয়। একটি চক্রের মাধ্যমে আত্মা একটি দেহ থেকে আর একটি চক্রে ঘুরে বেড়ায় যতক্ষন পর্যন্ত না পরিশুদ্ধ লাভ করে। পিথাগোরাস বলেন আত্মার বিশুদ্ধি লাভের মাধ্যমে জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি লাভ করে ঈশ্বরের সাথে মিলিত হওয়া জীবনের চরম লক্ষ্য। অনেকে ধারনা করেন পিথাগোরাস ভারত ভ্রমন করেছিলেন এবং সেখান থেকে এই ধারনা পেয়েছিলেন।



প্লেটোর মহাজাগতিক পুরাণে যে সব ধারণা পাওয়া যায় তার সঙ্গে এর বেশ মিল আছে। বিভিন্ন সংখ্যার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ পিথাগোরাসের উপপাদ্য। কিন্তু এই উপপাদ্য তিনি প্রমাণ করেছিলেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত পিথাগোরীয় দর্শনের উত্তরসূরিরাই এর প্রকৃত প্রতিপাদক। এই উত্তরসূরিরা তাঁদের গুরুর বিশ্বতত্ত্বকে দিন দিন আরও বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক দিকে নিয়ে গেছে যাঁদের মধ্যে ফিলোলাউস এবং আর্কিটাস উল্লেখযোগ্য। পিথাগোরাস মৃত্যু-পরবর্তী আত্মার অপেক্ষাকৃত আশাবাদী একটি চিত্র দাঁড় করিয়েছিলেন এবং জীবনযাপনের এমন একটি পদ্ধতি প্রদান করেছিলেন যা দৃঢ়তা ও নিয়মানুবর্তিতার কারণে অনেককে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল।


File:'Pythagoras Emerging from the Underworld', oil on canvas painting by Salvator Rosa

কয়েকটি ক্ষেত্রে পিথাগোরাস তার সময়ের চেয়ে কয়েক সহস্রাব্দ এগিয়ে ছিলেন। যেমন নারী পুরুষের সমতা। তিনি মনে করতেন তারা সমান, সম্পদের সমান অংশীদার এবং তারা একই ধরণের জীবন ধারণ করতে পারে। পিথাগোরাসের আরেকটি বিখ্যাত তত্ত্ব হচ্ছে, ‘সবকিছুই সংখ্যা’। তিনি সংগীতে সংখ্যার গুরুত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। বর্গ ও ঘনের ধারণা আমরা পিথাগোরাস থেকেই পাই। সংগীত নিয়ে তাদের আরেকটি শক্ত মত হচ্ছে এর রোগ সাড়ানোর ক্ষমতা আছে যেটা আসলে অনেক সুদূরপ্রসারী চিন্তা ছিল। সংগীত তাদের দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দাড়িয়েছিল কারণ এর মাধ্যমে প্রমাণ করা অতি সহজ ছিল যে ‘সবকিছুই সংখ্যা’। (সূত্রঃ বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি’তে পিথাগোরাসের দর্শন এবং ধর্মতত্ত্ব নিয়ে কিছু আলোচনা আছে)



পারস্যে জরাথ্রুষ্ট নামে একটা একজন ধর্মগুরুর দেখা যায় যার জন্ম আগেই বলছি আনুমানিক খ্রিঃপূর্ব অষ্টম শতক। অনেকেই তাকে ঠিক নব ধর্মের প্রচারক হিসাবে দেখেনা, তাকে পারস্যের সনাতন ধর্মকে একটি পরিশীলিত রূপ দানকারী হিসাবে দেখেন। জরাথ্রুষ্টীয় বা পারসিক ধর্মের প্রবর্তক জরাথ্রুষ্ট। তার নাম অনুসারেই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় এই ধর্মের নাম হয়েছে "জরোয়াস্ট্রিয়ানিজম" বা জরাথ্রুস্টবাদ। এ ধর্মে ঈশ্বরকে অহুর মজদা বা আহুরা মাজদা ("সর্বজ্ঞানস্বামী") নামে ডাকা হয়। এদের ধর্মগ্রন্থের নাম অবেস্তা (বা আবেস্তা) বা জেন্দাবেস্তা। পারসিক ধর্মের অনুসারীরা অগ্নি-উপাসক। আগুনের পবিত্রতাকে ঈশ্বরের পবিত্রতার সাথে তুলনীয় মনে করেন পারসিক জরাথ্রুষ্টীয়রা।



বর্তমান পারস্য থেকে এই ধর্ম এক রকম বিলুপ্ত প্রায়, অনেক আগেই নিজ ধর্ম রক্ষার্থে এই অগ্নি উপাসকরা ভারতে এসেছিল এখানে এরা অগ্নি উপাসক বা পার্সি নামে পরিচিত। পার্সিদের মাঝে সাধারনতঃ নিজেদের রক্ত সম্পর্কীয়দের মাঝে বিবাহ রীতি প্রচলিত যার কারনে শিশুদের বিকলাঙ্গ হবার হার অনেক বেশী। (এটা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত রক্ত সন্মন্ধ্যদের মাঝে বিবাহ হলে শিশুদের বিকলাঙ্গ হবার সম্ভাবনা বাড়ে)।



জরথ্রুস্টবাদীদের বিষ্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে মৃত্যুর পর মৃতদেহ সৎকার। শকুনেরা যেহেতু সবচেয়ে বেশী উচুঁতে উঠে সূর্যের কাছে যেতে পারে, তাই তারা নিজেদের মৃতদেহকে শকুন দিয়ে খাওয়ানো পবিত্র কর্ম মনে করে। মৃতদেহকে যাতে সহজে শকুনে খেতে পারে তার ব্যবস্থা করে তারা এবং মাংস শকুনে খাওয়ার পর মৃতের হাড়-মজ্জা ‘পবিত্র কুয়ায়’ ফেলে দেয়া হয়। তাদের বিশ্বাস, মরণের ৪র্থ দিনে ‘রুহ’ অহুর মাজদার কাছে বিচারের জন্যে পৌঁছে, এই ৪-দিন মৃতকে শকুন দিয়ে খাওয়ানো অত্যন্ত পূর্ণ কর্ম। কারো দেহ শকুনে না খেলে সেটা অবশ্যই অশুভ।



জরথ্রুস্টবাদিরা যেখানে বাস করে সেখানে সৎকারের ব্যাবস্থা স্বরূপ থাকার কথা মৃতকে শকুন দিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা। তবে ভারতে যেহেতু বর্তমানে সবচেয়ে বেশি এ ধর্মের লোক তাই, দক্ষিণ মুম্বাইর মালাবার হিলে ৫৭ একর অরণ্য-উদ্যানের মাঝে বিরাটাকার 'ডখমা' বা ‘টাওয়ার অব সাইলেন্স’ (নির্জনতার স্তম্ভ) নির্মাণ করা হয়েছে। ঐ পাহাড় চূড়ায় বিশাল আধার নির্মাণ করে সেই আধারের মাঝে পাথর বসিয়ে তার উপর মৃতদেহ রেখে আসে তারা। এ টাওয়ারে বা কাছাকাছি শকুনেরা বসে থাকে মৃতদেহটি খাবারের জন্যে। ৩-দিন খাওয়ার পর হাড়গোড়গুলো সংগ্রহ করে অন্যত্র কয়লা ও বালির মিশ্রণের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়। এর নাম হাড়দানি (Ossuary ), এরপর যায় পবিত্র কুয়ায় (কবর?)।

এই জরাথ্রুষ্ট ধর্মের প্রবর্তক জরাথ্রুষ্টকে নিয়ে খুব বেশী কিছু ইতিহসে লেখা নেই। আপাতত পল ক্রিসবাসজেকের “জরাথ্রুষ্ট সন্ধানে” বইটি পড়ছি, অনেক বড় বই নতুন কিছু পেলে আলাদা পোষ্ট দেবার ইচ্ছা রাখি।



এই একই সময় বা সমসাময়িক সময়ে চীনে দুজন দার্শনিক বা ধর্ম প্রবক্তার জন্ম হয় তাদের নাম কনফুসিয়া ও লাওৎসে। কনফুসিয়াসের চীনা উচ্চারন হল “কং ফু ৎসে”। প্রচলিত অর্থে ধর্ম প্রচারক বলতে যা বোজায় কনফুসিয়াস বা লাওৎসে সে রকম কিছু ছিলেন না, এরা আসলে কিছু নীতিমালা শিক্ষা দিত, কোনটা করা ঠিক বা কোনটা করা ঠিক না।



ধারণা করা হয়, কনফুসিয়াসের জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর, খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১ সালে, যোউ জেলায়, বর্তমান কুফু, চীনের নিকটবর্তী এলাকায়। বাবার নাম কং হি বা শুলিয়াং হি, যিনি ছিলেন স্থানীয় লু গ্যারিসনের প্রবীণ সেনানায়ক।



তার দর্শন অনুসারে, পৃথিবীর কোনো মানুষই নিখুঁত নয় তবে মানুষ মহৎ কিছু গুণের চর্চার মাধ্যমে তার স্বীয় প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তিনি জনগণের মানসিক পরিবর্তনের চাইতে শাসকের মানসিক পরিবর্তনকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন। এ ব্যাপারে তিনি মনে করতেন, একটি ভাল সমাজের জন্য একজন শাসকের সে সকল গুণ ধারণ করতে হবে, যে সকল গুণ তিনি তার জনগণের মধ্যে দেখতে চান।



কনফুসিয়াসের মৃত্যুর পরপরই অনুসারীরা কনফুসিয়াসের তত্ত্বগুলো একত্র করে তার চিন্তাধারা সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেন। তত্ত্বগুলো মূলত ছিল অনুসারীদের এবং কিছু শাসকদের সঙ্গে কনফুসিয়াসের কথোপকথন। তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষার ওপরে নিজের বেশ কিছু ধারণা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তার সামাজিক দর্শনের মূলে ছিল ‘রেন’ বা ‘পারস্পরিক ভালোবাসা’র সঙ্গে সংযমের চর্চা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তুমি নিজের জন্য যা চাও না, অন্যের জন্যও তা আশা কর না।’ চীনা ঐতিহ্যের সাথে কনফুসিয়াসের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চীনাদের যে ভদ্রতাবোধ তাও ঐ কনফুসিয়াসের প্রভাব।



গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে এখানে আমি বিষদ আলোচনায় যাব না, কারন গৌতম বুদ্ধের জীবন চরিত এদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষ কম বেশী জানেন। তিনি ছিলেন একজন রাজকুমার, ক্ষত্রিয়। সিদ্ধার্থের বাবা মা তাকে প্রচুর আরাম আয়েশে মানুষ করছিলো, তাকে সর্বদা পাহারা দিয়ে রাখা হত যেন তিনি কোন দুঃখী বা মৃত্যু কাউকে না দেখেন, কিন্তু যার জন্মই হয়েছিল বিরাট কিছু করার জন্য তাকে তো এভাবে বন্দী রাখা যায় না। এর পরের ইতিহাস সবাই জানেন। সেদিকে আর যাব না। বর্তমান বিশ্বে সব থেকে বড় ধর্ম কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম



জৈন কিংবদন্তি অনুসারে, “সকলপুরুষ” নামে তেষট্টি জন বিশিষ্ট সত্ত্বা এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। জৈন কিংবদন্তিমূলক ইতিহাস এই সত্ত্বাদের কর্মকাণ্ডের সংকলন। সকলপুরুষদের মধ্যে চব্বিশ জন তীর্থঙ্কর, বারো জন চক্রবর্তী, নয় জন বলদেব, নয় জন বাসুদেব ও নয় জন প্রতিবাসুদেব রয়েছেন।। এই চব্বিশ জন তীর্থাঙ্কর জৈন ধর্মের মতবাদ প্রচারিত হয় এঁদের মধ্যে তেইশতম প্রচারক পার্শ্বনাথ ও চবিবশতম মহাবীর ছিলেন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব।



মহাবীর ছিলেন গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক এবং তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০ থেকে ৪৬৮ অব্দ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। তাঁর পূর্বসূরি পার্শ্বনাথের আবির্ভাব ঘটে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। পার্শ্বনাথ ও মহাবীরের শিক্ষা থেকেই জৈন ধর্মমতের উৎপত্তি। পার্শ্বনাথের ধর্মোপদেশকে বলা হয় চতুর্যাম। এতে পরিত্রাণের চারটি উপায়ের কথা বলা হয়েছে, যথা- সর্বজীবে দয়া, মিথ্যাকথন থেকে বিরত থাকা, চৌর্যবৃত্তিতে অংশ না নেওয়া এবং পার্থিব সম্পদ থেকে দূরে থাকা। পরবর্তী সময়ে মহাবীর আরও একটি উপায় সংযোজন করেন। এটি হলো কোনো পোশাক পরিধান না করা। এভাবে জৈনরা দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পার্শ্বনাথের অনুসারীদের বলা হয় শ্বেতাম্বর অর্থাৎ সাদা বস্ত্র পরিধানকারী, আর মহাবীরের অনুসারীদের বলা হয় দিগম্বর অর্থাৎ নগ্ন (আক্ষরিক অর্থে, আকাশই হচ্ছে আচ্ছাদন)।



মহাবীরের জীবনকালেই বাংলায় জৈনধর্মের আবির্ভাব ঘটে। মহাবীর তাঁর মতবাদ প্রচারের জন্য রাঢ়ে (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশ) এসেছিলেন। এমন বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, চবিবশ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে বাইশ জন পশ্চিমবঙ্গের পরেশনাথ পাহাড় নামে পরিচিত পার্বত্য অঞ্চলে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। “বোধিসত্ত্বভবদানকল্পলতার” ভাষ্য মতে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পুন্ড্রবর্ধন (উত্তরবঙ্গ) জৈনধর্ম অনুসৃত হতো। তখন জৈন মন্দিরের নেতা ছিলেন পুন্ড্রবর্ধনের অধিবাসী ভদ্রবাহু। তিনি ‘কল্পসূত্র’ নামে বেশ কিছু জৈন অনুশাসনের একটি সংকলন প্রকাশ করেন। তাঁর তিরোধানের পর গোডাস নামে তাঁর এক শিষ্য পুন্ড্রবর্ধন এর জৈন মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর অনুসারীদের বলা হয় গোডাসগণ। পরবর্তী পর্যায়ে ‘গোডাসগণ’ সম্প্রদায় তাম্রলিপ্তিকীয়, কোটিবর্ষীয়, পুন্ড্রবর্ধনিয়া ও ধসিখরবতিকা নামে আরও চারটি উপ-সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং এটা ধরে নেওয়া যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব চার-তিন শতকের মধ্যে সমগ্র বাংলা জৈন মতবাদ প্রচারকদের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে।



বাংলার জৈনরা ছিল ‘দিগম্বর’ মতাদর্শের অনুসারী। প্রাপ্ত তথ্যাবলি থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, বাংলায় প্রাপ্ত তীর্থঙ্করের বিগ্রহগুলির সবই নগ্ন। অল্প কয়েকটি বিগ্রহে দেখা যায় যে, তীর্থঙ্করগণ তাদের সঙ্গী তীর্থঙ্করদের দ্বারা পরিবেষ্টিত রয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তীর্থঙ্কর ছাড়া অপর কোনো বিগ্রহ পাওয়া যায় নি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের জৈনরা তীর্থঙ্করদের ছাড়াও সলক পুরুচ, আচার্য, বাহুবলী, যক্ষ-যক্ষী, চক্রবর্তী, বাসুদেব, বলদেব, শসন দেবী, দিকপাল, ক্ষেত্রপাল, নবগ্রহ, অগ্নি, নৈর্ঋত, ব্রহ্ম, শ্রুতি দেবী ও হরিণ-গোমেশের প্রতি সশ্রদ্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করে। এসব তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঐতিহাসিক যুগের গোড়ার দিকে জৈনধর্ম বাংলায় প্রচলিত থাকলেও এটি কখনই অন্যান্য অঞ্চলের মতো এদেশে ততটা বিস্তার লাভ করে নি।



অহিংসা জৈনধর্মের প্রধান ও সর্বাধিক পরিচিত বৈশিষ্ট্য।কোনোরকম আবেগের তাড়নায় কোনো জীবিত প্রাণীকে হত্যা করাকেই জৈনধর্মে ‘হিংসা’ বলা হয়। এই ধরনের কাজ থেকে দূরে থাকাই জৈনধর্মে ‘অহিংসা’ নামে পরিচিত। প্রতিদিনের কাজকর্মে অহিংসার আদর্শটিকে প্রাধান্য দেওয়া জৈনধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক মানুষ নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ ও কোনোরকম আদানপ্রদানের সময় অহিংসার চর্চা করবে এবং কাজ, বাক্য বা চিন্তার মাধ্যমে অন্যকে আঘাত করা থেকে বিরত থাকবে – এই হল জৈনদের অহিংসা আদর্শের মূল কথা।



জৈনদের নির্দিষ্ট একটি প্রধান ধর্মগ্রন্থ নেই। 'আগাম' নামে একাধিক গ্রন্থ আছে যেগুলোতে তীর্থঙ্কর মহাবীরের উপদেশগুলো লেখা আছে। আগামগুলোই জৈন ধর্মের অনুসারীদের কাছে পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। এটি লেখা হয়েছে অর্ধ মাগধি প্রাকৃত ভাষায়। আগামকে আগাম সূত্র নামেও ডাকা হয়। শ্বেতাম্বর এবং দিগম্বর জৈনদের বিশ্বাসে কিছু পার্থক্য আছে। শ্বেতাম্বরেরা মনে করে অবিকৃত জৈন গ্রন্থ তাদের কাছে আছে, অন্যদিকে দিগম্বরদের বিশ্বাস তাদের প্রকৃত গ্রন্থ হারিয়ে গেছে।

কিছু মানুষ সব সময়ই থাকবে যারা ধর্মের খুত ধরে বেড়াবে এবং ধর্মপ্রচারকারী মহাপুরুষদের নামে নোংরামি ছড়াবে। এদের মাঝে আর ধর্মের নামে উগ্রতা সৃষ্টিকারীদের কোন পার্থক্য নেই। ধর্ম হোক সুন্দর জীবন যাপনের একটি নিয়ামক।

তথ্য সুত্রঃ বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি’, পল ক্রিসবাসজেকের “জরাথ্রুষ্ট সন্ধানে” জৈনধর্ম এবং আরো অনেক অন্তর্জাল ফিচার।।

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:১৯
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×