মাতালের কাণ্ডজ্ঞান ও রসবোধ যে কতটা উচ্চস্তরের হতে পারে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যয় 'দুই পুরুষ' নাটকে তার বর্ণনা করেছেন। নুটু মোক্তারের পুত্র সুশোভন মাঝরাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরেছেন, এই দেখে নুটু মোক্তার সুশোভন কে বলেন, "তোর এতটা অধঃপতন হয়েছে?" শুনে সুশোভন তাঁর বাবাকে বলেন, "পতন তো চিরকাল অধঃলোকেই হয় গুরু...কে আর কবে ঊর্ধ্বলোকে পড়েছে বলো!" এইকথা শুনে নুটু মোক্তারের কী অবস্থা হয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য।
তারাশঙ্কর বেচে থাকলে আজকে আর মাতাল সুশোভনের মুখ থেকে এই উক্তি বের করতেন না, সুস্থ্য কোন চরিত্রের মুখ দিয়েই বের করতেন “এক মাত্র বাঙ্গালীর পতনই উর্ধ্বমুখী হয়।”
শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। এক জীবনে আল্লাহ অনেক কিছুই দেখালেন। এটাও কপাল এত বড় মহামারী চোখে দেখে যাওয়া। ব্লাক ডেথ, স্পানিশ ফ্লু, এই সব নিয়া পড়তে পড়তে যে একদম চোখ দিয়ে এই যুগে মানে স্পেশ সায়েন্সের যুগে দেখতে পাব তা কিন্তু আমি কেন, মাতাল সুশোভন ও কল্পনা করে নাই। বেশ একটা থ্রিলিং থ্রিলিং ভাব। (খালি একটু ভাবনা হচ্ছে না খেয়ে মারা যাই কিনা যদি এটা কন্টিনিউ হয়) ব্লাক ডেথ প্রায় ছয় বছর, স্পানিশ ফ্লু দুই বছর স্থায়ী হয়েছিল। ইংরেজী শব্দ লক ডাউন, হোম কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশান শুনলেও গা ছম ছমে অনুভুতি!
গত দুই দিন ধরে ঢাকা শহর প্রায় খালি হয়ে গেছে, কিন্তু মানুষজন ঢাকা ছেড়ে মফঃস্বল বা গ্রাম অভিমুখে যাবার কোন কারন আমি খুজে পাচ্ছি না, শুধু একটা ব্যাপার থাকতে পারে, গ্রামে বা নিজ মফঃস্বলে গেলে নিম্ন বিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তের বাড়ি ভাড়াটা বেচে যাবে হয়ত কয়দিন খাওয়া চিন্তাও থাকবে না, যেহেতু অনেক দিন পর বাড়ীতে যাচ্ছে সেখানে কেউ না কেউ থাকবে। তারপর!! কয়েকদিন পর কিভাবে খাবে? কে কাকে খাওয়াবে?
অথচ দেখুন সৌদীতে যেখানে গত ২৪ ঘন্টায় আক্রান্ত ১৩৩ সেখানে বাংলাদেশের IEDCR এর প্রধান মাননীয় মীরজাদী সেব্রিনা গত চব্বিশ ঘন্টায় কোন নতুন আক্রান্তের নিউজ দিতে পারে নাই, আমি ধরে নিচ্ছি তার মানে কেউ নতুন করে আক্রান্ত হয় নাই। সাব্বাশ! লক ডাউনের কারনে সবাই ঢাকা ছাড়ছে, আচ্ছা যারা এই ভীড়াভিড়ি করে ঢাকা ত্যাগ করছে তাদের মাঝে কি কেউ করোনা আক্রান্ত আছে? যদি থেকে থাকে তবে তার সহযাত্রী সহ তার এলাকাকে আক্রান্ত করবে, আর যদি সুস্থ্য অবস্থায় যায়, সেক্ষেত্রে তার মফঃস্বলে যদি কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত থাকে তবে সে তো সেধে গিয়ে নিজেকে ঝুকির মাঝে ফেলল। অবশ্য মাননীয় মীরজাদী বলে দিয়েছেন গত চব্বিশ ঘন্টায় কেউ নতুন আক্রান্ত হয় নি!
ওদিকে সম্ভবতঃ আমাদের উন্নত চিকিৎসা ব্যাবস্থার কারনে আমেরিকা আমাদের কাছে পিপিই চেয়েছে (দেখুন যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশের কাছে পিপিই চেয়েছে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী )অবশ্য এই দেশে ৭০০ টাকায় পিপিই বেঁচে। চিন্তা করতে পারেন ৭০০ টাকায় মেডিকেল পিপিই যা দিয়ে আপনি করোনা থেকে সুরক্ষা পাবেন! সব কিছু নিয়ে জোচ্চোরী আমাদের জাতীয় চরিত্র হয়ে দাড়িয়েছে। এগুলো যেন কেউ দেখেও দেখার নেই। বিপদে মানুষকে প্রতারনা করার কত সহজ পদ্ধতি।
এদেশে আল্লাহর খাস রহমত আছে যেখানে অন্যান্য দেশে আক্রান্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ে সেখানে এদেশে কোন সিষ্টেম না মেনেও আক্রান্তের সংখ্যা যিরোতে নামিয়ে আনা গেছে।
করোনায় যে এদেশের মানুষের সচেতনতা কতখানি তা আজকে আর একটা ঘটনায় প্রমানিত হয়ে গেছে, বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের সাজা স্থগিত করার পর তাদের কয়েক হাজার নেতা কর্মীরা করোনা ভীতি উপেক্ষা করে পিজি হাসপাতাল থেকে কাওরান বাজার পর্যন্ত নেত্রীর গাড়ীকে ঘিরে আসতে থাকে, যা একজন ৭৩/ ৭৪ বছরের অসুস্থ্য বৃদ্ধার জন্য প্রানঘাতী হতে পারে কেউ একবারো ভাবল না, পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তারা কি জানত না এমন অবস্থা হবে? সেক্ষেত্রে কেন তারা পিজি থেকে কাওরান বাজার পর্যন্ত এই সব ষ্টুপিড অসচেতনদের এমন সুযোগ দিল? এটা তো শুধু বেগম জিয়া না এটা ওখানে উপস্থিত সবার জন্যই মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরী হতে পারে যদি এর মাঝে একজনও ইনফেক্টেড থাকে। তার মানে এই হল লকডাউন পরিস্থিতি!! কাওরান বাজার পুলিশ লাঠি চার্জ করে বাকী রাস্তাটুকু একটানে গুলশানে আসে, সেখানে আবার বেগম জিয়ার বাড়ীর সামনে হাজারো কর্মীর ভীড়। সেই ভীড় ঠেলে অসুস্থ্য বেগম জিয়াকে বাড়ির মাঝে ঢুকিয়ে গেট আটকে দিয়ে তবে বাচোয়া।
আজকে কালো রাত্রি পাক বাহিনী এই রাতে ঢাকায় ম্যাসাকার করে ১৯৭১ সালে আবার একই সাথে শুরু হয় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ। এইবারের স্বাধীনতা দিবস এক বিশেষ কারনে আমার কাছে স্মরনীয়। ৭১ এ চোখে দৃশ্যমান শত্রুর বিরুদ্ধে সমগ্র জাতি এক হয়ে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল, এইবার এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে, এটা শুধু আমাদের জাতির না, সমগ্র বিশ্বের। এখানে যেন কে আওয়ামীলীগ কে বিএনপি সে ভেদাভেদ যেন না থাকে। আমরা বাঙ্গালী, বাংলাদেশী। এই পরিচয়ে সবাইকে যে যার অবস্থান থেকে এক নীরব যুদ্ধ চালাতে হবে অদেখা শত্রুর বিরুদ্ধে। সামান্যতম বিভেদ বা অসচেতনতা আমাদের যে ক্ষতি বা প্রানহানি করবে তাতে যে বা যাদেরই ভুমিকা থাকবে ইতিহাস নিশ্চয়ই তাদের ক্ষমা করবে না। যেমন করেনি ৭১ এর ঘাতকদের।
আসলে নিজের জীবনের বা বিশ্ব পরিস্থিতির কারনে এগুলো লিখে রাখছি, যদি আল্লাহ বাচিয়ে রাখে পাচ বছর পর এইগুলো পড়তে পড়তে ভাবব কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছি, এবং তখন হয়ত হাসব এখনকার কথা ভেবে অথবা চোখের পানি ফেলব, তবে সেটা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। শাহবাগের সেই উত্তাল দিন গুলো নিয়ে এই ব্লগেই আমার কয়েকটা লেখা আছে, সেই লেখাগুলো যখন পড়ি তখন ভাবি সে সময়ের পরিস্থিতি এবং এখনকার পরিস্থিতি কত পার্থক্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৮:৫১