আমাদের ছোটকালে পাড়ার ইজ্জত ছিল সব থেকে বেশী। প্রায় সব পাড়ায়ই একটা না একটা ক্লাবের মত ছিল, নাম গুলো ছিল বাহারী “নজরুল স্মৃতি ক্লাব”, “জাগরনী বয়েজ ক্লাব”, “সবুজ সংঘ ফুটবল ক্লাব” এই টাইপের। এই ক্লাব গুলোই ছিল পাড়ার ইজ্জতের আতুর ঘর। ইজ্জতের আতুর ঘর বলতে কি বুজাচ্ছি একটু ব্যাখ্যা দেয়া লাগে না হলে এই যুগের ইয়াং বয়েজরা বুজতে পারবে না।
ধরেন, আপনার শহরে দুটো পাড়া আছে একটা পাড়ার নাম যোগীর কোল, আর এক পাড়ার নাম ঝাউতলা। এখন ঝাউতলায় অবিনাশ দাদার এক অপরূপ সুন্দরী বোন আছে নাম পুস্পাদি (অবশ্য কোন কবি যেন বলে গেছে যৌবনে কুক্কুরীও সুন্দরী)। সে কিন্তু ঝাউতলার ইয়াং জেনারেশানের সন্মান বা ভালোবাসার পাত্রী। এক মাত্র ওই পাড়ার, এমতাবস্থায় ধরেন যোগীর কোলের জ্যাঠা ছেলে হরেন এক দিন সাইকেলে এসে অথবা পুস্পাদি যোগীর কোল বেড়াতে গেছে সেখানে তাকে দেখে হরেন এবং তার দল বল শিষ দিয়ে উঠল। পুস্পাদি কাদতে কাদতে এসে ভাই অবিনাশ দাদাকে সে কথা বলল, অবিনাশ দাদা এসে তার পাড়ার ক্লাবে চোখ লাল করে এহেন অপমানের কথা বলতে বলতে হাতে হকি ষ্টিক তুলে নিল।
ব্যাস কাজ হয়ে গেল পাড়ার এমন গৌরব এবং ভালোবাসার সন্মান রক্ষার্থে সবাই হকিষ্টিক অথবা লোহার রড (ম্যাক্সিমাম দু একটা রামদা) নিয়ে যোগীর কোলের অভিমুখে রওনা দিল হরেন বাহিনীকে শায়েস্তা করার নিমিত্তে (তখনো ক্রিকেট খেলার চল হয় নি, তাই ক্রিকেট ষ্ট্যাম্প দুর্লভ বস্তু ছিল)। মোহন দাদা ছিল আমাদের এলাকার বোমা স্পেসালিষ্ট, সে বোমা বানানোর কায়দাও ছিল ভিন্ন, জর্দার কৌটায় কি সব যেন ভরে কালো ইলেকট্রিক টেপ পেচিয়ে বানাত, ছুড়ে দিলে বিকট আওয়াজে ফাটত, এছাড়াও ছিল কোকের বোতল, কিভাবে যেন কায়দা করে মারলে সেটাও বিকট আওয়াজ হত। যাই হোক উভয়পক্ষের মাঝে ইটাইটি শুরু হতেই কিছুক্ষনের মাঝে পুলিশ চলে আসত, উভয় বাহিনী যে যার এলাকায় ফিরে যেত পুলিশ ও নিজ থানায় ফিরে যেত। এগুলো সে সময়ের পুলিশ খুব বেশি পাত্তা দিত না।
আবার ধরেন পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল খেলা মানে কোনমতেই কোণ পাড়া হেরে যেতে পারবে না, কোন পাড়া হারার অবস্থায় গেলেই অবধারিত ভাবে কোন এক ছুতা নাতায় মাইর পিট অবধারিত। অবশ্য তাতে আহত খুব কমই হত। ভুলক্রমে কারো মাথায় ইট পড়লে সামান্য ব্যান্ডেজেই কাজ হয়ে যেত তবে এলাকায় সে পেত হিরোর মর্যদা। কয়েকদিন দুই এলাকার ইয়াং গ্রুপ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেত না, গেলে কপালে খারাবি ছিল ধরা পড়লে, পরে অবশ্য উভয় এলাকার সিনিয়র ভাইদের মিটিং এ এর সুরাহা হত।
এলাকায় কোন ব্যাপারে সহায়তা লাগবে, বা ঈদ পুজায় চাঁদা লাগবে? এলাকার ক্লাবের এবং এর সদস্যদের (জন্মগত ভাবে অথবা অবস্থান গত ভাবে যে যার এলাকার ক্লাবের সদস্য হয়ে যেত) একচেটিয়া পবিত্র দায়িত্ব। সন্ধ্যার পর উঠতি বয়সীদের আড্ডার স্থল ছিল ক্লাব ঘর, সেখানে বয়স ভিত্তিক আড্ডা চালু ছিল, আর ছিল সন্মান, এক বছরের সিনিয়রের সামনে সিগারেট ধরানো মানে নির্ঘাত খুনের অপরাধে অপরাধী হওয়ার সমান। এলাকার বড় ভাইদের সন্মান না দিলে এনিয়ে নির্ঘাত বিচার আচারের মুখোমুখি হতে হত। সেকালে এ যুগের মত ফেন্সিডীল, ইয়াবা চল ছিল না। কিসের যে চল ছিল সেটা কখনো বুজি নি কারন বাসার কড়া নির্দেশে ইন্টার মেডিয়েট পর্যন্ত ঠিক মাগরেবের আযানের মধ্যে বাসায় ফিরে আসতে হত।
আমাদের ছেলে বেলায় নিটোল আড্ডায় অসাধারন সে সব সময় কাটত। বাসায় বসে থেকে ইদানিং এগুলো খুব মাথার ভেতর জ্বালাচ্ছে। লিখে রাখছি। নেই কাজ তো খৈ ভাজ। সময় যত পার করে বড় হয়েছি তত আমাদের নষ্টামি জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেছে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাই চোখের সামনে দেখছে। আমরা যারা টাইপ রাইটারে টাইপ করে পরীক্ষা দিয়েছি (সেকালে মেট্রিক মানে আধুনিক SSC তে টাইপ রাইটার বলে অপশনাল সাবজেক্ট ছিল), তারাই এখন কম্পুটার নামক এক আধুনিক প্রযুক্তিতে টাইপ করি। একটা প্রজন্ম আমরা, একটা ট্রানজিট সময়ের সাক্ষী।
সেকালে খুন জখম ধর্ষন এখনকার মত পত্রিকার পাতা দখল নিতে পারে নি। ইয়াবা ফেন্সিডীলের রাজত্ব তখনো অনেক দূরে। ইয়াবা তো সেদিনের আগমন। সেকালে নেশা বলতে বড় জোর বাংলা মদ খাওয়ার প্রচলন ছিল, বিদেশি মদ সম্ভবতঃ দূর আকাশের তারা ছিল। আমি যে মফঃস্বল শহরে বড় হয়েছি সে শহরে দুটো ফ্যামিলির ব্যাক্তিগত গাড়ী ছিল। ডিসি, এস পি দের যে গাড়ী ছিল তা বোধ হয় এখনকার সময় ফিটনেসের অভাবে রাস্তায়ই নামতে পারবে না।
এই হল অঢেল ছুটির খারাপ দিক। কি লিখতে শুরু করছিলাম কোথায় চলে গেছি। যাই হোক সেকালে দেখতাম মাঝে সাঝে মোহনদাদা (পাড়ার বখাটে ছেলে) কি সব খেয়ে দেয়ে রাস্তা দিয়ে রাত নয়টা দশটার দিকে হেড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে বাসায় যাচ্ছে, বাবার ভুরু কুচকানো এবং মায়ের বিড় বিড়ে গালিতে বুজতাম মোহন দাদা ভালো কিছু খেয়ে যাচ্ছে না। অনেকেই আবার মোহনদাদাকে খারাপ মনে করছেন, আসলে সে অত খারাপ না, কারো বিপদে আপদে ওই বখাটে মোহনই ছিল অনেকের শেষ ভরসা, মড়া পোড়াতে হবে, কাউকে হাসপাতালে নিতে হবে, বিয়ে হবে নো চিন্তা মোহন এ্যান্ড গং আছে।
কবে যেন মোহনদাদা মাল (এই শব্দটার মানে অনেক পরে জেনেছি, ইদানিং এর আবার অনেক মানে আছে) খেয়ে কন্ট্রাকটর আঙ্কেলের দুই তলা বিল্ডিং এর নীচ দিয়ে যাচ্ছিলেন, দুই তলার ব্যালকনি দিয়ে কন্ট্রাকটর আঙ্কেলের দুই বছরের ছেলেকে তার গিন্নী দুই তালার রাস্তামুখী ব্যালকনি দিয়ে হিসু করাচ্ছিলেন (সেকালে এগুলো কোন ঘটনা ছিল না), হিসু ডাইরেক্ট গিয়ে মোহনদাদার মাথায়। মোহনদাদা জায়গায় ব্রেক মেরে উপরের দিকে তাকিয়ে হাক দিল,
“উপর থেকে পানি ফেলে কেরে রাস্তায়”
কন্ট্রাক্টর গিন্নী মিহি গলায় জবাব দিলেন, “মোহন এটা পানি না, আরিফ (কন্ট্রাক্টর গিন্নীর দুই বছরের ছেলের নাম) হিসু করছে”
“ও আচ্ছা, বাচ্চা মানুষ কিছু বললাম না বৌদি, বড় কেউ ফেললে তাকে দেখে নিতাম” মাথাটা দুলাতে দুলাতে মোহনদাদা আবার গান গাইতে গাইতে বাসায় রওনা দিল। এই ছিল আমাদের ছোটকালের বখাটে মোহনদাদা।
যখন বড় হয়ে গেলাম, সময়ও চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে, সেই জাদরেল মোহনদাদার চুলেও পাক ধরছে, খুব অর্থকষ্টে পড়ল, এলাকায় গেলে মাঝে মাঝে আমাকে দেখলে বলত “শের, দে দেখি ২০ টাকা দে অনেক দিন কেরোসিন খাই না” চাহিদা খুব বেশি ছিল না, ২০/৩০ টাকা, আমি ততদিনে চাকুরী শুরু করছি তাই ২০/৩০ টাকা তেমন কিছুই না আমার কাছে, আমিও খুশী মনে দিতাম কেন যেন আমি এই মানুষটাকে পছন্দ করতাম। মাঝ রাতে বাসায় শুয়ে টের পেতাম মোহনদাদা হেড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে বাড়ী যাচ্ছে তার “কেরোসিন” খেয়ে। মোহনদাদার কাছ থেকে ২০/৩০ টাকার বিনিময়ে আমি ফিরে পেতাম আমার হারানো শৈশব, কৈশোর। অবশ্য ততদিনে পরিবর্তনের ঢেউ লেগে গেছে।
বছর বিশেক আগে এলাকার গেলে মিলন জানাল এক রাতে প্রচন্ড পেটে ব্যাথায় মোহনদাদা মারা গেছে। সেই ক্লাব গুলোও এখন আর দেখিনা, পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল খেলা চল তো দূর অতীত স্মৃতি, পুস্পাদিদিরা এখন আর এই গ্লোবাল ভিলেজের যুগে কোন এলাকার সন্মান বা ভালোবাসার পাত্রী না, তারা এখন পুরা শহরের অসন্মানের বা ধর্ষনের বস্তু। তাদের সন্মান রাক্ষার্থে এই যুগে কোন মোহনদাদা জন্মায় না।
রাজধানীতে বাস করছি, এমন সীন জীবনেও দেখি নাই। মৃত্যুপুরী। মনে হয় কোন জাদুর কাঠির ছোয়ায় সারা শহর মৃত্যুপুরী। কোন এক পাগল (পাগলই মনে হয় না হয় এই মৃত্যুপুরীতে কে গান গাইবে) গান গাইতে গাইতে ফাকা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, মনে পড়ে গেল মোহনদাদার মাল খেয়ে হেড়ে গলার গান শোনার স্মৃতি। এযুগে বোধ হয় বাংলা ফাংলা কেউ খায় না, মোহনদাদার ভাষায় “কেরোসিন”। সবাই বিদেশিতে অভ্যস্ত। পরোপকার এযুগে কেতাবে লেখা থাকে বাস্তবে দেখা সম্ভব না, সেকালে তো মোবাইলে ছবি তোলা যেত না তাই যে যা করত নিঃস্বার্থ মন দিয়ে, এখনকার এই দুর্দিনে একটা পাগলকে একটা মাস্ক পরিয়ে পিছনে পঞ্চাশজনের দাত খেলানো ছবি দেখে নিজেকে শুধাই আর কত দিন এগুলো দেখব? মোহনদাদাদের মাতলামি একটা নির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ থাকত। এযুগে মাতলামির জন্য..... চলুন একটা জোক শুনাই যদিও কিছু দিন আগে একটা পোষ্টে দিয়েছিলামঃ
এক মদতি বারে গ্যাছে মদ খাইতে।
বারম্যানরে কয়, “একটা বিয়ার কত?”
বারম্যান কয় “চাইরানা।”
মদতি টাস্কি। কয়, “আইচ্ছা গরু ভুনা আর লগে এক বোতল হুইস্কি কত পড়ব?”
বারম্যান কয় “আটানা দিয়েন।”
মদতি বুইজ্জা গ্যাছে কোতাও গড়মিল আছে, কয়, “এই বারের মালিক কই?”
বারম্যান কয়,” সে উপরে আমার বউর লগে।”
মদতি কয় “উপরে তোমার বউর লগে কি করে?”
বারম্যান কয়, “আমি ওর ব্যবসার লগে যা করতাছি…”
যুগটাই এমন যে যেভাবে পারে যে কোনভাবে পারে বারম্যানের এবং বারের মালিকের মত একই কাজ করে যাচ্ছে। যাক দেখে যাচ্ছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৩:৩৩