বিকেলে ছোটভাইয়ের সাথে বের হলাম । কম্পিউটারের দোকানে ল্যাপটপ দেখলাম । তেমন সুবিধাজনক দামে পেলাম না। এরপর ৪২ নং ষ্টেশন থেকে ৪৭-৫০ রকফেলার প্ল¬াজায় গেলাম। আন্ডার গ্রাউন্ডে ক্যানাডিয়ান এম্বেসী, ১২৫১ নং রুমে। সেখানে কানাডা যাওয়ার নিয়ম কানুন ও টাকা পয়সা জমার তথ্য নিয়ে এলাম।
সেন্ট্রাল পার্ক মনুমেন্ট
সকালে নাস্তা করে সাবওয়ে দিয়ে সেন্ট্রাল পার্কে যাওয়ার জন্য কলম্বাস সার্কেলে গেলাম । সেন্ট্রাল পার্ক এলাকাতে অনেক লোক বসে আছে। এটা ফিফথ ও এইটথ এভিনিউর মধ্যস্থ এলাকা এবং ৫৯ ষ্ট্রীট থেকে ১১০ ষ্ট্রীট অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। ৫৯ ষ্ট্রীট ও এইটথ এভিনিউ ঢোকার মুখে সুন্দর একটা মনুমেন্ট আছে। এটা ব্যাটেলশীপ মেহনীর নিহত বীরদের স্মরনে নির্মান করা হয়েছে । এর নীচে বহু পর্যটক বসে দুদন্ড বিশ্রাম নেয়। নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটানের অবস্থিত সেন্ট্রাল পার্ক একটা পাবলিক পার্ক । ৮৪৩ একর এলাকা জুড়ে এর অবস্থান । ১৮৫৭ সালে এটা জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয় এবং ১৮৭৩ সালে এর বিভিন্ন কাজকর্ম শেষ হয় । অনেকগুলো সাবওয়ে ষ্টেশন থেকে সেন্ট্রাল পার্কে যাওয়া যায় এবং সেন্ট্রাল পার্কে ঘোরাফেরা শেষে অন্য আরেকটা সাবওয়ে ষ্টেশন থেকে নিজ গন্তব্যে ফেরা যায় । কলম্বাস সার্কেলে নেমে কিংবা ১১০ ষ্ট্রীট কিংবা পার্ক নর্থ ষ্টেশন থেকেও সেন্ট্রাল পার্কে যাওয়া যায় । সারা বছর এটা খোলা থাকে এবং বৎসরে ২৫ মিলিয়ন ভ্রমনকারী এখানে বেড়াতে আসে । সেন্ট্রাল পার্কের সবুজ ঘাসে ছাওয়া এলাকার মাঝে মাঝে কৃত্রিম লেকের মত আছে । একটা বড় লেকের নাম জ্যাকুলিন ওনাসিস রিজারভায়ার (জন এফ কেনেডি ও এরিষ্টটল ওনাসিস এর স্ত্রীর নামে)। কোন কাজ না থাকলে সকাল বেলা সেন্ট্রাল পার্কে চলে যেতাম, সাথে থাকত পানির বোতল ও হাতব্যাগে স্যান্ডুইচ। কিছুক্ষন ঘোরাফেরার পর পার্কের বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিতাম, মাঝে মাঝে ছবিও তুলেছি, সারা বছর পার্কের কোন না কোন রক্ষনাবেক্ষনের কাজ চলছে । বহু লোক শুয়ে আছে ঘাসে, অনেক যুগল নিরিবিলিতে গল্প গুজব করছে । পার্কে বেশ কয়েকদিন গেলাম । তবে এখানে সবাই ব্যক্তি সচেতন কেউ কাউকে ডিসটাব করে না । তাই কারোর সাথেই কথা হলো না । মাঝে মাঝে পথচারীকে দু একটা জায়গার নাম জিজ্ঞাসা করে বোবা ভাবটা কাটাতাম।
তারপর ছোট ভাইয়ের অফিস এলাম। ম্যাকডোনাল্ড থেকে ১.৬১ ডলারে পেপসি খেলাম ও ফ্রেস হলাম । পৌনে পাঁচটপা পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। ছোট ভাই তখনও বের হয়নি । ট্রেনে করে রুজভেল্ট ষ্টেশন এ নেমে পাউরুটি, ফুলকপি ও সসেজ কিনলাম । সন্ধ্যায় বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে গেলাম ওরা দৌড়াদৌড়ি করল । রাতে ছোট ভাই কানাডার ভিসার কাগজ পত্র রেডি করলো । ইনভাইটেশন, সলভেন্সি সার্টিফিকেট এবং পারমানেন্ট রেসিডেন্স কার্ড এর কপি নিলাম ।
পরদিন সকালে ছোট ভাইকে ট্রেনে তুলে দিলাম । ২৪ ডলারে কেনা আনলিমিটেড টিকেট দিয়ে অনেক ঘোরা হচ্ছে। এরপর কানাডিয়ান এম্বেসীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। অনেক চেকিং এর পর ভিতরে বসলাম। ৬৫ ডলার জমা দিলাম কাউন্টারে। তারপর ইন্টারভিউ। আমার কাগজপত্র দিলাম। বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করল তারপর পাসপোর্ট জমা নিয়ে দুপুর ১-৩০ এ আসতে বলল । সময় মত এম্ব্যাসিতে গেলাম। এক মাসের ভিসা পেলাম,সিংগল এ্যান্ট্রি । এরপর আন্ডার গ্রাউন্ডে করে কিংসওয়ে ষ্টেশনে এলাম এটা ব্র“কলিন এলাকায়। কিছু কেনাকাটি করলাম এখানে। অনেক দুরের রাস্তা ২/৩ বার ট্রেন পরিবর্তন করে ছোট ভাইয়ের অফিসে আসতে আসতে বিকেল ৫-১০ বেজে গেল। ছোট ভাইকে পেলাম না, পরে আমি একা বাসায় এলাম। রাতে গাড়ীতে ছোট ভাইয়ের সাথে বাজারে গেলাম রাত ১২-৩০ এ বাসায় এলাম অনেক বাজার নিয়ে। রাতে পিচ ফল খেলাম, ভাল লাগল। আজকে নিউইয়র্ক এর দুটো বরো বা এলাকা ব্র“কলিন ও ম্যানহাটন দেখা হলো ভালই লাগল ।
সকালে ছোট ভাইকে ট্রেনে তুলে দিয়ে বাসায় এসে ঘুম দিলাম । ১১ টাতে উঠে নাস্তা করে বের হলাম ফিফর্থ এভিনিউতে গেলাম এয়ার মরক এর অফিসে । টিকেট চেঞ্চ করলাম । ফিফর্থ এভিনিউ অসম্ভব সুন্দর । বিশাল চকচকে বিল্ডিং ও অনেক সুন্দর ডিজাইনের বাড়ী তবে এটা অফিস এলাকা । দুপুরে ট্রেনে করে সেন্ট্রালপার্কে এলাম। সেখানে পৌনে ৪ টা পর্যন্ত বসে ছিলাম। তারপর দুই ভাই মিলে একসাথে বাসায় এলাম । রাতে বাচ্চাদেরকে নিয়ে বাসার আশে পাশে হাঁটলাম কিছুক্ষণ ।
প্রতিদিন সকাল বেলা বাচ্চাদেরকে স্কুলে দিয়ে ফিরে আসার সময় কুইস এলাকার বিভিন্ন জায়গাগুলো ঘুরে দেখতাম । বিশাল এই দেশটাতে এবং এই শহরে সবকিছু ফাকা ফাকা করে বানানো এবং বিশাল আকারের সব জিনিষপত্র। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে একটা আন্ডার পাস আছে, নীচে ট্রেন লাইন, উপরে থেকে নীচে তাকালে জায়গাটা কেমন যেন অন্য রকম লাগত । উপরে ঘরবাড়ি ও চলমান জীবন নীচে গাছপালা এবং নির্জন অপরিচিত দৃশ্য মনে হতো ওটা অন্যজগত ।
এখানে মানুষজন অনেক বই কেনে এবং পথে ঘাটে বসে কিংবা দাড়িয়ে ট্রেনে বা সাবওয়েতে অনেকের হাতে বই দেখা যায় । বই পড়ার পর বইগুলো এরা কাছের বিনে ফেলে দেয়। বিনে অনেক বই দেখলাম প্রায় নতুন সবগুলো বাসায় নেই তাই ফেলে চলে যায়। জ্যাকসনহাইট সাবওয়ে ষ্টেশন থেকে বাসায় আসার পথে এক বাসার সামনে বড় একটা কার্টুনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগজিন দেখলাম। কপিগুলো একদম নতুন একবার পড়ার পর বাসার সীমানার বাইরে রেখেছে । কেউ নিলে নিতে পারে নইলে গার্বেজে চলে যাবে । ময়লা আবর্জনা ফেলার ব্যবস্থাও উন্নত, সব ধরনের ময়লা একই কার্টুনে ফেলার নিয়ম নেই । কাগজ জাতীয়, কাঁচ কিংবা অন্যান্য ময়লা ফেলার আলাদা আলাদা পলিব্যাগ পাওয়া যায় সেগুলোতে ময়লা ভরে বাসার বাইরে নিদির্ষ্ট জায়গায় রাখতে হয় । অন্যথা হলো জরিমানার ব্যবস্থাও আছে। এখানে এক বৃদ্ধাকে দেখলাম বোতল সংগ্রহ করছে জানলাম এগুলো সে জমিয়ে পরে বিক্রি করে। গরীব লোক এদেশেও আছে ।
সবাই মিলে বেড়াতে বের হলে মাঝে মাঝে গ্যাস নিতে হতো । ফুয়েলকে এরা গ্যাস বলে, কয়েকটা গ্যাস ষ্টেশন ফাঁকা, দু একটা গাড়ী মাঝে মাঝে আসছে গ্যাস নিয়ে চলে যাচ্ছে । আবার একই রকম ষ্টেশনে অনেক গাড়ীর ভিড়, ছোট ভাই তার গাড়ীটাকে সুবিধামত একটাতে ঢোকাতে চাচ্ছে তবে খালি ষ্টেশনে যাচ্ছে না,পরে হেসে আমাকে মূল্যের বোর্ডের দিকে তাকাতে বলল । দেখলাম ভিড়ের জায়গা গুলোতে যে তেলের দাম ৩.৯৯ ডলার সেখানে খালি পাম্পগুলোতে তা ৪.৯৯ কিংবা ৪.৫০ ডলার । কি সুন্দর ব্যবস্থা । টাকা থাকলে শান্তিতে চলে যাও নইলে আমজনতার লাইনে দাড়িয়ে তেল ভরে নাও । জীবন এখানে বেশ হিসাব করে বুদ্ধি খাটিয়ে যাপন করতে হয় । আবেগ দিয়ে এখানে চলেনা।
চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থাও অনেকটা এ ধরনের, সবার জন্য যেসব পার্ক বা চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা সেগুলো সাবওয়ে থেকে হাঁটাপথের দুরত্বে এখানে আমজনতা ভিড় করে আনন্দ করে সবাই খুশী, তবে টাকাওয়ালাদের জন্য আরো দুরে নিজের গাড়ীতে চড়ে পরিছন্ন বিনোদনের বহু ব্যবস্থা আছে । এখানে আমজনতা ভীড় নেই সামর্থ্যবানদের সমাগম সেখানে। সুন্দর ভাবে নিজস্ব প্রাইভেসী ও বিনোদন এরা নিশ্চিত করেছে টাকার মানদন্ডে । এগুলোও নতুন অভিজ্ঞতা আমার কাছে। সবাই অফিসে ও স্কুলে চলে গেলে এলাকাটা প্রায় ফাঁকা হয়ে যেত । তখনো ছায়া ছায়া ভাব থাকত বলে বাসার আশপাশে ঘোরার সময় ছোট ছোট বাচ্চা ও বড়ো বুড়িদের দেখা যেত । পাশেই চাইনিজদের বাসার ছোট ৩/৪ বছরের ছেলে ও তার দাদী কিংবা নানী । হেসে হ্যালো বলত । বাচ্চাও কোলে আসতে চাইত । তবে বিনা অনুমতিতে অন্যের বাচ্চা কোলে নেয়া বা আদর করা অপরাধ । বিনা আমন্ত্রনে অচেনা বাসায় যাওয়া অপরাধ, তাই এসব আবেগ সংযত করে চলতাম । এদেশী লাইসেন্স ছাড়াও গাড়িতে উঠলে ধরা পড়লে ফাইন এবং কাউকে সাহায্য করতে গিয়ে কোন অঘটন ঘটলে দায়দায়িত্ব সেই চালকের । একবার এক বৃদ্ধা তার পার্কিং সময় শেষ হচ্ছে বলে গাড়ীটা আমাকে সরিয়ে দিতে বলল আমি সরি বলে চলে এলাম কারণ এই মহিলাই কোন সমস্যা হলে আমার বিরুদ্ধে কেইস করে দেবে। বিদেশে উপকার করে ঝামেলায় জড়াতে কে চায় ।
সেঞ্চুরী ২১
পরদিন শুক্রবার ২৩ সেপ্টেম্বর ১১ টার দিকে নাস্তা খেয়ে বাইরে গেলাম । আজ ম্যানহাটনে গেলাম । প্রথমে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ষ্টেশনে গেলাম সেখান থেকে রেক্টর ষ্ট্রীট , টাইমস্ স্কয়ার, ফুলটন ষ্ট্রীট ইত্যাদি সব জায়গায় ১২ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত ঘুরলাম । ২টা বড় ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর সেঞ্চুরী ২১ ও সায়ামে গেলাম। ডাউন টাউন ম্যানহাটন এ বিশাল চার্চ আছে । ছবি তোলা হলো না কারণ আমি একা ছিলাম তা ছাড়া ছবি তোলার নিয়ম কানুন জানিনা যদি আবার ক্যামেরা নিয়ে যায় । আলকায়দা ও টেররিষ্ট আতংক আমেরিকার সর্বত্র বিরাজমান।
ব্যাটারী পার্কে
গ্রাউন্ড জিরো ও আশে পাশের এলাকা দেখে একটু বিরতি নিয়ে ব্যাটারী পার্কে এসে কিছুক্ষন বিশ্রাম নেয়া যায়। নিউ ইয়র্কের স্কাই ক্রাপারের অরন্যে ব্যাটারী পার্ক যেন মরুদ্যান । কলোনিয়াল সময়ে হারবার এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটা আর্টিলারী ব্যাটারী এখানে ছিল এবং সেই ব্যাটারীর নামে বর্তমানে পার্কের নাম ব্যাটারী পার্ক । ব্যাটারী পার্কে ক্যাসেল ক্লিনটন নামে একটা দুর্গ আছে যা ১৮০৮-১১ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল । বর্তমানে এই দুর্গটা সামরিক কাজে ব্যবহার হয় না । এখানে এখন থিয়েটার ও অ্যাকুরিয়াম আছে এবং এটা নিউইয়র্কের ইতিহাস পর্যটকদের কাছে তুলে ধরে। পৌনে চারটার দিকে হাডসন নদীর পাড়ে ব্যাটারী পার্ক ও ওয়াগনার পার্ক এলাকায় কিছুক্ষণ বসলাম। ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার টেররিষ্ট আক্রমনের ফলে ধ্বংস হয়ে যায় । বর্তমানে এই জায়গাটাকে গ্রাউড জিরো বলা হয় । এখানে সেই ধবংসের পর আবার নতুন সৃষ্টির অপেক্ষায় রয়েছে নিউ ইয়র্ক বাসী। সাবওয়েতে ওয়ার্ল্ড ট্রেড ষ্টেশনে নেমে গ্রাউড জিরোতে যাওয়া যায়।
দুপুর বেলা বার্গার কিং এ ৫ ডলার দিয়ে বার্গার ও কোক খেলাম। বার্গার কিংএ বসে ছিলাম কিছুক্ষণ । ৪-৩০ এ ছোট ভাইয়ের অফিসে এলাম । সেখান থেকে শো পিছ কেনার জন্য গেলাম । তারপর ট্রেনে করে লেক্সিংটন এভিনিউতে এলাম। পরে ট্রেন বদল করে এইটি সিক্সথ ষ্ট্রীটের সার্কিট সিটিমলে গেলাম । সেখানে ডিজিটাল ক্যামকর্ডার ও ক্যামেরা কিনে রাত আটটায় বাসায় এলাম ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




