somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাস থেকে বর্তমান সংঘাতময় ইউক্রেনের কিছু কথা

২৭ শে জুলাই, ২০২২ রাত ১১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ইউক্রেন দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ এবং আয়তনের দিক থেকে রাশিয়ার পরেই ইউক্রেন ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। এর পূর্ব এবং উত্তরে দীর্ঘতম স্থল সীমান্ত রয়েছে রাশিয়ার সাথে, উত্তরে আছে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র বেলারুশ। ইউক্রেনের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশগুলো হলো পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি,রোমানিয়া এবং মলদোভা। মলদোভা ছাড়া সবগুলো দেশ এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর সদস্য। রাশিয়া এবং পশ্চিমা রাজনৈতিক ও সামরিক জোটের মাঝখানে পড়ে ইউক্রেন এখন "স্যান্ডউইচড" অবস্থায় আছে। ইউক্রেনের দক্ষিনে রয়েছে কৃষ্ণ সাগর এর মাধ্যমে ইউক্রেন তুরস্ক এবং বুলগেরিয়ার সাথে যুক্ত এবং প্রণালী ছাড়িয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও বহিঃবিশ্বের সাথে এর যোগাযোগ রয়েছে। ইউক্রেনের ইতিহাসে কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলের প্রতিবেশী দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

ইউক্রেনের আয়তন ৬০৩৭০০ বর্গ কিলোমিটার বা ২৩৩১০০ বর্গ মাইল। এই আয়তন ক্রিমিয়া সহ যা বর্তমানে রাশিয়ার দখলে। দেশটি ফ্রান্সের চেয়ে কিছুটা বড় এবং জার্মানি এবং গ্রেট ব্রিটেনের মিলিত আয়তনের সমান। ইউক্রেনের ভূখণ্ড প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি নিয়ে গঠিত, এই ভুমি কৃষি চাষের জন্য উপযুক্ত। ইউক্রেনের সুদূর পশ্চিম প্রান্ত বরাবর রয়েছে কার্পাথিয়ান পর্বত মালা এবং ক্রিমিয়ান উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্ত বরাবর রয়েছে সুদৃশ্য ক্রিমিয়ান পর্বতমালা যা এই দেশের উচ্চ ভুমি হিসেবে ধরা যায়।
ইউক্রেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী হল নিপ্র বা নিপার নদী যা কৃষ্ণ সাগরে মিলিত হওয়ার আগে পুরো দেশ অতিক্রম করে। কয়েক শতাব্দী ধরে ইউক্রেনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ছিল ডিনিপ্রো অববাহিকায় হিউমাস-সমৃদ্ধ মাটির বৃহৎ "ব্ল্যাক-আর্থ" বেল্ট। এই মাটি অতি উর্বর এবং এখানে প্রচুর ফসল ফলে , সেজন্য ইউক্রেনীয় ভূখন্ডকে "ইউরোপের রুটির ঝুড়ি" বলা হয়। ইউক্রেন প্রথমে পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল ছিল এবং পরবর্তীকালে তা রাশিয়ান সাম্রাজ্যের একটি কৃষি পণ্যের বাণিজ্যিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং শস্য এবং বিট চিনি র একটি নেতৃস্থানীয় উত্পাদক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
পূর্ব ইউক্রেনে বিশেষ করে দনবাস অঞ্চলে কয়লা ও লৌহ আকরিকের সমৃদ্ধ খনি রয়েছে, উনিশ শতকে আধুনিক শিল্পের আগমনের সাথে সাথে, খনি থেকে আকরিক উত্তোলন এবং ইস্পাত উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিংশ শতাব্দীতে, প্রবাহমান ইউক্রেনীয় নদীগুলি জলবিদ্যুত উতপাদনের প্রধান উত্স হয়ে ওঠে । সে সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অনেক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছিল, যার মধ্যে একটা হল চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যা , কিয়েভের ঠিক উত্তরে অবস্থিত।

ইউক্রেনের একসময় তেল ও গ্যাসের গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার ছিল ১৯৭০ এর দশকে এর মজুদ অনেকাংশে নিঃশেষ হয়ে পড়ে, এবং ইউক্রেনকে এইসব জ্বালানি আমদানিকারকে পরিনত করে। তবে সাম্প্রতিক দশকে নতুন নিষ্কাশন প্রযুক্তি এই খাতকে পুনরুজ্জীবিত করেছে, এছাড়াও ক্রিমিয়ান উপকূল বরাবর কৃষ্ণ সাগরে আবিষ্কৃত তরলীকৃত গ্যাস এই খাতকে পুনরায় গতিশীল ও লাভজনক অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ান উপদ্বীপ দখল করার কারনে বর্তমানে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সোভিয়েত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পতনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়ে ইউক্রেনীয় অর্থনীতির কিছু সেক্টর তুলনামূলকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপর ও দেশটি বিশ্বের মধ্যে ইস্পাত, ঢালাই লোহা এবং পাইপ, সেইসাথে খনিজ উৎপাদনকারী ও সার উৎপাদনে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে আছে। সোভিয়েত উত্তরাধিকার থেকে প্রাপ্ত উন্নত শিল্প কারখানা বিশেষত উন্নত সামরিক শিল্পের কারনে ইউক্রেন এখনও বিশ্বের শীর্ষ ১০ অস্ত্র ব্যবসাকারী রাষ্ট্র। তবে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামুলক পরিবেশে অন্যান্য খাতগুলো নতুন করে তেমন ভালো ফল করতে পারেনি। ইউক্রেনের একসময়ের সমৃদ্ধ বিমান শিল্প প্রায় বিলুপ্ত, এবং দেশে উৎপাদিত একটি ইউক্রেনীয় গাড়ির ব্র্যান্ড, জাপোরোজেটস (পরে, তাভরিয়া এবং স্লাভুতা),২০১১ সালে বন্ধ হয়ে যায়। পশ্চিমা বাজারে প্রতিযোগিতামূলক না হওয়ার কারনে ইউক্রেনীয় মেশিন তৈরি কারখানা গুলোতে প্রাথমিকভাবে রাশিয়া এবং সোভিয়েত-পরবর্তী অন্যান্য রাষ্ট্রের জন্য যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয়।
কৃষি, ইউক্রেনের অর্থনীতির ঐতিহ্যগত প্রধান ভিত্তি হলে ও এটা এখনও সোভিয়েত যুগের যৌথ খামার থেকে বাজারমুখী বাণিজ্যিক ব্যবস্থার উপযোগী হওয়ার জন্য একটি ধীর এবং কঠিন স্থানান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখন গতিশীল হয়েছে এর পাশাপাশি পর্যটন শিল্প ইউক্রেনীয় অর্থনীতির একটি ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ খাতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে দেশের পশ্চিম অঞ্চলের সমৃদ্ধ স্থাপত্য ঐতিহ্য এবং নতুন পর্বত রিসর্টগুলো পর্যটক দেরকে আকর্ষণ করছে ।


ইউক্রেনের জনসংখ্যা সাড়ে চার কোটির একটু বেশি৷ জনসংখ্যার দিক থেকে খারাপ অবস্থা ইউক্রেনের। জাতিসংঘ ধারণা করছে এই দেশে ২১০০ সাল নাগাদ ৩৬ শতাংশ জনসংখ্যা কমতে পারে । অভিবাসী না আসা ও অপর্যাপ্ত উপার্জন অঞ্চলটির জনসংখ্যা কমার প্রধান দুটি কারণ। প্রজনন হার হ্রাসের সাধারণ ইউরোপীয় প্রবণতা ও এর উপর প্রভাব ফেলেছে। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে ইউক্রেন থেকে আরো অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ গুলোতে প্রচুর অভিবাসন হয়েছে। দনবাস অঞ্চলের যুদ্ধের আগে ও এই সংখ্যা বৃদ্ধি নিম্ন মুখী ছিল। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, ইউক্রেনের জনসংখ্যার ৭৭.৮ শতাংশ জাতিগত ইউক্রেনীয় এবং ১৭.৩ শতাংশ রাশিয়ান নিয়ে গঠিত। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে নগণ্য, এক শতাংশ র কম। দক্ষিণ-পশ্চিমে কিছু অঞ্চলে মোলডোভানরা অথবা রোমানিয়ান (০.৮ শতাংশ) এবং হাঙ্গেরিয়ান (০.৩ শতাংশ)। উত্তর-পশ্চিমে বেলারুশিয়ানরা (০.৬ শতাংশ), দক্ষিণে বুলগেরিয়ান (০.৪ শতাংশ) এবং গ্রীক (০.২ শতাংশ), এবং ক্রিমিয়াতে ক্রিমিয়ান তাতার (0.৫ শতাংশ)।

ঐতিহাসিকভাবে,ইহুদি ও পোলরা এদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ছিল তবে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, হলোকাস্ট, এবং স্ট্যালিনের অধীনে জোরপূর্বক গন পুনর্বাসন ইউক্রেনের জনসংখ্যার মধ্যে তাদের আনুপাতিক উপস্থিতি অনেক কমিয়ে দিয়েছে। ডিনিপ্রো নদীর পশ্চিমের অঞ্চলে এক সময় অনেক পোল বসবাস করত বর্তমানে তারা মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৩ শতাংশ। ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে, ইউক্রেনের ইহুদিরা ইসরায়েল ও পশ্চিমের দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ করে, ১৯৫৯ সালে তারা ২ শতাংশ ছিল এবং এখন কমে দাঁড়িয়েছে ০.২ শতাংশে । ১৯২০ এর দশকে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশিরভাগ জার্মান-ভাষী মেনোনাইট দক্ষিণ ইউক্রেন থেকে চলে গেছে।



ঐতিহাসিকভাবে জাতিগত বৈচিত্র্যের দেশ ইউক্রেন, সোভিয়েত শাসনের শেষ দিকে সমজাতীয় পূর্ব স্লাভিক দেশে পরিণত হয়েছে, যেখানে একটি উল্লেখযোগ্য রাশিয়ান সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে এবং রাশিয়ান-ইউক্রেনীয় দ্বিভাষাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতিগত রাশিয়ানরা ইউক্রেনীয় এসএসআর এ নিজেদেরকে সংখ্যালঘু হিসেবে দেখেনি বরং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয় জাতির প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিল। স্বাধীন ইউক্রেন অভ্যুদয়ের পর সৃষ্ট জাতিগত পরিস্থিতি রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয়ানদের মধ্যে বর্তমান সংঘাতের মঞ্চ তৈরি করেছে ।
ছবি নেট থেকে
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০২২ রাত ১১:২৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×