দুপুরের রোদটা হালকা হতেই, কোলাহল শুরু হয়ে গেল । কলোনী মাঠের ছেলেদের ফুটবল খেলার কথা বলছিনা না বলছি রাস্তার আশেপাশে চলাফেরা করা মানুষের কথা । কোলাহলটা অনেকগুলো “কাকের” গন্ডগোল করার জন্য হচ্ছে । জানালা দিয়ে ছেলেটা এক টুকরো আকাশ দেখতে পারে আর সাথে একটা গাছ । সেই গাছের মাথায় মাঝারি সাইজের কাকের বাসা। হয়ত সেখানে আজ কোন গন্ডগোল বেধেছে । জানালা দিয়ে কাকের বাসায় কি চলছে , বোঝা মুশকিল! যা অনুমান করা যায় তা হল, যেহেতু কাকের বাসাটা এইগাছে নতুন সেহেতু এইখানে নিশ্চয়ই কাক ডিম পেড়ে , বাচ্চা ফুটাবে । কিন্তু গণ্ডগোলটা বাধল কি নিয়ে বোঝা যাচ্ছেনা । ছেলেটার ধারনা, খাবার বিষয়ক কিছু হবে । তাছাড়া গন্ডগোল আর কি কারন থাকতে পারে ? কারন যাই হোক, অনেকক্ষণ ধরে গন্ডগোল করার পর কোলাহল শান্ত হল । কাকের বাসায় একটি কাককে বসে থাকতে দেখা গেল, বাকিরা উধাও। রহস্যজনক…
ছেলেটা কাকের বাসা থেকে তার মনযোগ সরিয়ে নিল । রোদটা পড়ে গেছে । শহরে আসার আগে ,এই রকম সময়ের জন্য ছেলেটা সারা দুপুর ছটফট করত । আছরের আযান দিলে, ছেলেটা ওযু করে মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য বাইরে যেত । ব্যছ নামায পড়া শেষ , সাইকেল নিয়ে ছেলেটার স্বাধীনতা শুরু। তার জন্য সময় বরাদ্দ থাকত মাগরিব এর আযান পর্যন্ত । এতটুকু সময়ে ছেলেটা হয় কোন নতুন রাস্তায় যেত সাইকেল নিয়ে অথবা যেত তার রেল লাইনের পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটার কাছে । স্বাধীনতার সময়টাতে কেউ তাকে জ্বালাতনা । নিজের মত করে উপভোগ করত তার সংক্ষিপ্ত স্বাধীনতা ।
কিন্তু শহরে এসে ঝামেলা বাধল । শহরে কোলাহল তো আছে কিন্তু কারও জন্য কারও সময় নেই । সবাই খুব ব্যস্ত । ব্যস্ততার ধরনও খুব ভিন্ন । এবং কয়েকটা জিনিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । জিনিসগুলো হচ্ছে, টিভি,মোবাইল,ল্যপটপ বা ডেস্কটপ, সাউন্ডবক্স কিংবা হেডফোন । জিনিসগুলো সকাল থেকে শুরু করে চোখে ঘুম না আসা পর্যন্ত শহরের মানুষগুলো আলাদা করে দিয়েছে । এদের সাথে মানুষগুলোর সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ। এতটাই ঘনিষ্ঠ যে, এক ফ্ল্যাটের মানুষ তার পাশের ফ্ল্যাটের মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখেনা । এ নিয়ে মানুষগুলোর কোন ধরনের আক্ষেপও নেই । তারা খুবই খুশি । তাদের পরিচিতির অভাব নেই যে । তাদের হাসি-খুশি, দুঃখ ,আক্ষেপ , পরামর্শ বা রিলেশন সবই অনলাইনে । তাদের মন খারাপ ,কানে হেডফোন লাগিয়ে শুনবে গান। তাদের মন ভাল সাউন্ডবক্সে শুনবে গান, তাদের দুঃখ ফেসবুকে দিবে স্ট্যাটাস, তাদের আক্ষেপ ফেসবুকে চাইবে পরামর্শ , তাদের রিলেশান টিকে থাকে স্কাইপি ,হোয়াটসআপ এর জোরে । তাদের বন্ধু-বান্ধব সব অনলাইনে । হোক চেনা , অচেনা । তারা তাদের সাথে অনলাইনে চ্যাট করে আনন্দ পাই । নতুন নতুন মানুষের সাথে তাদের পরিচিত হতে নাকি ভাল লাগে অথচ পাশের বাড়ীর মানুষগুলোকেই তারা চেনার প্রয়োজন বোধ করেনা । আর এদের পরামর্শ আর সিদ্ধান্তে পৌছানোর ধরন অস্থির । একেবারে এলোপ্যাথিক ঔষধের মত ।
এই যেমন ধরুন, আপনার বাচ্চা কাদছে টিভি আছে আর তাতে আছে কার্টুন চ্যানেল । ব্যছ কান্না থেমে গেল । কিন্তু নিজে কখনও পাশে বসে আদর দিয়ে কাছে টানবেনা । তারপর কি হবে ? আস্তে আস্তে বাচ্চাটা কার্টুন দেখার প্রতি ঝুকে পড়বে । ফলপ্রসূ সে তখন আর তার বাবা মাকে কাছে চাইবেনা । চাইবে টিভির ঐ কার্টুন নেটওয়ার্ক চ্যানেল কে । তারপর আসবে স্বার্থের পার্ট আর সমাজের কাছে তাদের মান সম্মানের পার্ট । এ পার্টটাও চরম মজার । এবার বাচ্চা হালকা বড় হলেই তাকে পড়াশোনা করাতে হবে । এ কোচিং সেই কোচিং এ দিয়ে , বাচ্চাকে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হবে । তারপর সে যাতে পড়াশোনা ঠিকঠাক করে তাই তাকে লোভ দেখানো হবে। কিসের লোভ , “কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়” । তোমার খেলনা দরকার রেজাল্ট ভাল কর কিনে দেব । তোমার খেলার ব্যট দরকার রেজাল্ট এক থেকে দশের মধ্যে আন কিনে দেব। তোমার সাইকেল দরকার ? ক্লাসে ফার্স্ট হও কিনে দেব । তোমার মোবাইল দরকার গোল্ডেন পাও তাহলে। বাইক দরকার গোল্ডেন পাও । আর যদি এসব কিছু দিয়েও কাজ না হয়, তাহলে সবচেয়ে ভয়ানক অস্ত্র প্রয়োগ করা হয় । না না, মারধর ভয়ানক অস্ত্রের মধ্যে পড়েনা । ভয়ানক অস্ত্র হল, ইমোশনাল অভিনয় । কিছুক্ষেত্রে নরম, এই যেমন , “পড়াশোনাটা নিজের কাছে, নিজের ভাল নিজে বুঝবি কবে! আমরা কি আমাদের জন্য বলছি, আমরা বলছি তোর ফিউচার এর জন্য” … এবার হালকা গরমের ইমোশনাল অভিনয়,
“পাশের বাড়ীর মেয়েটা ক্লাসে অংকে ৯৫ পাই । তুমি কি ঘাস কাও যে ৮২ পাইছ? ছেলে হয়ে একটা মেয়ের আগে যেতে পারনা। গাধা কোথাকার…!!” এবার অতিরিক্ত গরমের ইমোশনাল অভিনয় ,
“টুট টুটের বাচ্চা । কি করছ সারাদিন ঘরে বইস্যা? গাদা গাদা টাকা ঢেলছি তোর পেছনে কোনমতে পাশ করার জন্য? কালকে থেকে রিকশা নিয়া বেরবি । টুট টুটের বাচ্চা, কোথাকার ”।
আরেকটা ইমোশনাল পার্ট আছে, উচ্চবংশীয় বা ডাক্তার- ইজ্ঞিনিয়ার ফ্যামিলির জন্য , “আমার মান সম্মান কিছু রাখবানা নাকি ? আমার বংশের কেউ কোনদিন এত্ত খারাপ রেজাল্ট করেনি । তোমাকে এখানে রাখা যাবেনা, তুমি বাইরে চলে যাও । খারাপ রেজাল্ট হলেও লোকজনকে বলতে পারব,বাইরে থেকে ডিগ্রী পেয়েছে…।”
তাহলে কি বুঝলেন? আপনাকে প্রযুক্তি নির্ভর, চাহিদাবাদী ,ভেদাভেদকারী এবং স্বার্থবাদী বানানোর পেছনে কাদের হাত আছে? জ্বী, ঠিক ধরেছেন । থাক , উনারা আপনাকে জন্ম দিয়েছেন তাদের দোষ ত্রুটি ধরতেও নিষেধ করা হয়েছে , ধর্মে ।
ভাল । ধরলাম না । তবুও তাদের উদ্দেশ্য যারা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত । যারা সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীর কাছে বন্দি । পড়ুন তাহলে, আপনি আপনার সন্তানকে শেখাচ্ছেন কিভাবে অল্পতে খুশি হওয়া যায় । আর এটা শেখাতে গিয়ে আপনি যে পন্থা অবলম্বন করছেন , তা তাকে লোভের দিকে ধাবিত করছে আর কিছুই না । আফসোস কখন হবে জানেন ? যখন মারা যাবেন ।
হাসছেন বুঝি । হাসা উচিত । মরেই তো গেছেন । আফসোস কিসের?
পড়ুন, যখন আপনার লাশ আপনার সন্তানের সামনে থাকবে আর সে আপনার ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিবে, “বাবা, মারা গেল। ফিলিং স্যাড …” ৯৯ টা লাইক পড়বে আর আপনার সন্তানটি আরেকটা লাইকের জন্য পোস্টটা ফরওয়ার্ড করবে । আর তাতে লেখা থাকবে, আরেকটা লাইক মার অথবা শেয়ার কর, দোস্ত…!!
অথবা আপনার লাশ সামনে , তার কানে হেডফোন লাগিয়ে সে গান শুনবে আপনার শোক কাটানোর জন্য ।
অথবা আপনি মারা গেলেন । আপনার সন্তান বলল, কবর দিয়ে দাও । টাকা খরচ করে দেশে এসে কি করব , এখন??
হাসুন এবার । কারন, আপনি তো মারাই গেছেন । আপনার কি চিন্তা বলুন?
এবার আসি আপনার ইমোশনাল পার্ট । যার জন্যে আপনি আপনার সন্তানকে তৈরী করেছেন । হুমম, ঐটা ।। ঠিক ধরেছেন একদম । “কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়”
বাবা তো চলে গেল, আমাদের জন্য কি ছেড়ে গেল? আপনার লাশ দাফন করার আগেই আপনার সম্পত্তি ভাগাভাগি শুরু হয়ে যাবে । তাই আগেভাগেই ভাগ-বাটোয়ারা করে ফেলুন …!! এতেও প্রব্লেম, যদি ছেলেমেয়ে কবরে মাটি দিতে না আসে? কি করবেন , আপনি তো মারাই গেছেন । হাসুন এইবারও… !!
ছেলেটা শহরের মানুষ থেকে মনযোগ সরিয়ে আবার কাকের বাসার দিকে মনযোগ দেই । আর ভাবে, কি আজব শহর, কি আজব মানুষ… এর থেকে কাক হওয়াই ভাল ছিল । ধীরে ধীরে ছেলেটা ভাঙছে , ধীরে ধীরে ছেলেটা বদলাচ্ছে । ছেলেটাও আরেক প্রজন্ম নিয়ে আসবে একইরকম। কারন, শহরে থাকাটা জরুরী । মনুষ্যত্ব , মায়া –মমতা নয় । স্বার্থ সন্ধান কর, ভালবাসা নয় । প্রয়োজন পূরন কর নিজের তারপর যে পূরন করেছে তাকে ভুলে যাও…!!!
অতঃপর জানালাটা বন্ধ হয়ে গেল । ছেলেকে আকাশ , কৃষ্ণচূড়া বা ভালবাসা কিছুই টানেনা । টানে স্বার্থ , প্রয়োজন আর সহ্য করে থেকে যাবার অভিনয়… !!!!
অভিনয় কর , অভিনয়…!!!
শহরে কোলাহলের ভীড়ে শোনা যায়না আর্তনাদ । না শোনা যায় আত্মচিৎকার ।।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫৪