[] শুচি সৈয়দ []
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের কথা, তখন দেশে এসএসসি পর্যায়ের পরীক্ষায় এমসিকিউ পদ্ধতিতে প্রশ্নোত্তর প্রচলন করতে উদ্যোগী হয় শিা বোর্ডগুলো। তার আগে স্কুলগুলোর পরীাসমূহে রচনামূলক পদ্ধতিই প্রচলিত ছিল। তখনকার সরকারের শিানীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বাকি পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গতি রা করার সমকালীন বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে এই পদ্ধতি প্রচলনের সুপারিশ করেন। তখন এই ব্যবস্থা প্রচলনে অনেকেই দ্বিধা-সংশয় ব্যক্ত করলেও প্রয়োজনীয়তাকে কেউ অস্বীকার করেননি। ফলে অনেক ত্র“টি-বিচ্যুতি নিয়েও সূচনা ঘটে পদ্ধতিটির। এই পদ্ধতির অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম দুই-তিন বছরের এসএসসি পরীায় স্টার মার্কস পাওয়া পরীার্থীর সংখ্যা এত পরিমাণে বেড়ে যায় যে, সবাই কৌতুক করে বলতে শুরু করে, আকাশের তারার সংখ্যাও এই স্টারদের কাছে হার মানবে!
ঘটনাটিকে অনেকেই ভুলবেন না নানা কারণে। আমার বিশেষ করে মনে আছে দুটি কারণে তার একটি হচ্ছে- আমার এক ভাতিজা স্টার মার্কস পেয়ে এসএসসি উত্তীর্ণ হয়ে আমাকে একটি বাজীতে হারিয়ে দিয়েছিল। বাজীটা ছিল তাকে নিয়েই। একবার আমি বাড়ি গেলে তার পড়াশোনার গাফিলতি নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ জানালেন তার জননী। বিষয়টা জননী সুলভ অতিশয়োক্তি কিনা সেটা হাতে কলমে উপলব্ধির জন্য আমি ওকে খুব ছোট্ট একটা পরীায় ফেললাম। ওকে বললাম, আগামী ২ ঘণ্টায় সম্পূর্ণ বই দেখে দুটি ইংরেজি রচনা লিখতে। চার পাঁচ ঘণ্টা লাগিয়েও সে তা সম্পন্ন করতে পারেনি দেখে আমি বাঁশঝাড় থেকে একটা কাঁচা কঞ্চি কেটে ওকে শাস্তি দিতে গিয়ে দেখি, ছেলের চাইতে মায়ের চোখেই বেশি জল। বিরক্ত হয়ে বাজী ধরলাম বললাম, তুমি তো পরীায় কোনও রকমেও পাশ করতে পারবে না। বই দেখেও লিখতে না পারলে কিভাবে পাশ করবে কেউ- পাঠক বলুন! কিন্তু না-- শ্রীমান যথাসময়ে ঠিকই স্টার মার্কস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে গেল- আর এই উত্তীর্ণ শ্রীমানের যে হাসিটি আমি পরাজয় মেনে দেখেছি সেটা যে আমার বদলে তাকেই উপহাস করেছে সে প্রমাণও সে দিয়েছে, পাবলিক কলেজে তার জায়গা না পাওয়ার মধ্য দিয়ে। শ্রীমানের এই কৃতিত্বে আমি যতটা না বিস্মিত হয়েছিলাম, তার চেয়ে শত সহস্র গুণ বিস্মিত হয়েছিলাম এই যুগোপযোগী পদ্ধটিকে যিনি জঘন্যভাবে ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন, এমন একজন শিা বোর্ড চেয়ারম্যান শিােেত্র অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় পদক পাওয়ায়। এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীা নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যুৎপন্নমতিতা অনুধাবনের চেষ্টা বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন। বাংলাদেশে এ পদ্ধতি প্রবর্তনের শুরুতে শিাবোর্ড দেশের শিকগণ শিার্থীদের জন্য কিভাবে প্রশ্ন প্রণয়ন করবেন সেটা বোঝাবার জন্য, সব বিষয়ে কিছু নমুনা প্রশ্ন তৈরি করে। শিকরা যাতে প্রচলিত চিরাচরিত ধারায় বাইরে নতুন ধরনের প্রশ্ন তৈরিতে সিদ্ধ হন সে ল্েয। প্রশ্নের সেই খসড়াগুলো শুধুমাত্র শিক মহোদয়কে ধারণা প্রদানের জন্য শিা সংস্কার টাস্কফোর্স তৈরি করে। সেই সব প্রশ্নের অর্ধেকের বেশি উত্তরও সঠিক ছিল না; পাঁচ শ’ প্রশ্নের মধ্যে প্রায় আড়ইশটির উত্তরেই কোন না কোন ত্র“টি ছিল। খসড়া সেই প্রশ্নমালাকে প্রশ্নব্যাংক গাইড নাম দিয়ে উত্তরাঞ্চলের শিা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকারী একজন পুস্তক ব্যবসায়ী তার প্রকাশনা সংস্থা থেকে ছেপে বাজারে ছেড়ে দিলেন এবং এই প্রশ্নব্যাংক গাইড যাতে এসএসসি পরীার্থীরা কিনবে বাধ্য হয় তার সুব্যবস্থাও করলেন। গুণধর বোর্ড চেয়ারম্যান তার শিক্ষা বোর্ডের অধীন বিভিন্ন স্কুলে স্কুলে পরিদর্শনে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে এলেন এই বলে যে, পরীা পাশের জন্য এই প্রশ্ন ব্যংক গাইড কেনা বাধ্যতামূলকÑ পরীার সব প্রশ্ন এই গাইড থেকে করা হবে। এটি না কিনলে কেউ পাশ করবে না। তার এই ব্যবসায়িক দুর্বুদ্ধিই সেবার পরীায় জন্ম দেয় অসংখ্য স্টারের। রাষ্ট্রের শিা সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াসকে যে ব্যক্তি ভুল এবং বিপথে চালিত করল হওয়া উচিত ছিল তার অপরাধের বিচার, দেওয়া উচিত ছিল শাস্তি যাকে সে-ই কিনা উল্টো ভূষিত হল রাষ্ট্রীয় পদকে। ‘বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা’ বলে একটা প্রবাদ আমরা সবাই জানি কমবেশিÑ কিন্তু একে বলা যায়-- ক্রিমিনালের হাতে হত্যার লাইসেন্স তুলে দেয়া।
উপরের এই স্মৃতিগুলো স্মরণে এল পত্রিকার পাতায় একটি তথ্য সমৃদ্ধ সংবাদ পড়ে। প্রথম আলোর ২৬ নভেম্বরের প্রথম পৃষ্ঠা প্রকাশিত একটি খবরের উল্লেখ করিÑ ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীা। শিকদের অবহেলায় ভুলের চক্রে শিার্থীরা’’ এই হেডিং-এর উপরে ছাপা হয়েছে ‘প্রশ্ন ভুল, উত্তর ভুল, মূল্যায়ন ভুল, পুনর্মূল্যায়ন ভুল,’ Ñ ‘ভুল সবই ভুল’ বলে একটি গান আছে বাংলা সিনেমায়, এই ভুলের বহর সে গানকেও লজ্জা দিয়ে গর্তে ঢুকিয়ে দেয়। আমি মুক্ত কণ্ঠে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আরো ভুল অপেমান আমাদের সামনে শুধু আবির্ভূত হবার জন্য। সে জন্যই বিজ্ঞ আদালত এ বিষয়ে প্রথিতযশা শিাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের কাছ থেকে কিছু দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য শুনতে চায়- আর তিনিও বলেছেন, তিনি নিজেও বিষয়টা সম্পর্কে বুঝতে চেষ্টা করছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন।
প্রথম আলোর খবরটিতে ভুলগুলোর আদ্যোপান্ত তুলে ধরার চেষ্টা নেয়া হয়েছে। বলা যায়, প্রতিবেদক পুঙখানুপুঙ্খভাবে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলে এই মূল্যবান প্রতিবেদনটি রচনা করেছেন। প্রতিবেদনটি পড়ে আমি মোটেই বিস্মিত হইনি বরং আমার মনে হয়েছে নিকট অতীতে যে দুর্বৃত্তকে আমরা পদকে ভূষিত করেছি সেই ঘটনারই পরিণতি আজকের এই ভুলের চক্র! এটা একদিনের বা এক বছরের পাপ নয়, এ হচ্ছে যুগ যুগ ধরে করা আমাদের পাপের ফসল। আমি প্রতিবেদনের ইন্ট্রোটির, উল্লেখ করছি এবং আরও প্রাসঙ্গিক পয়েন্ট সমূহ আমার বক্তব্যের সপে Ñ
“শিকদের অবহেলা ও ব্যস্ততার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ ইউনিটের ভর্তি পরীা ভুলের চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওই ইউনিটের প্রশ্নপত্র তৈরি, উত্তরপত্র মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়নের সবস্তরেই ভুল হয়েছে।
ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরাও মনে করছেন, শিকদের ভুলের কারণেই এভাবে একের পর এক ভুল হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভর্তি পরীা কমিটিতে থাকা ১৮ শিকের মধ্যে ১৬ জনই অধ্যাপক। এই ১৬ জনের মধ্যে আট জন বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যান। কমিটির প্রায় সব সদস্য ব্যবসায় শিা অনুষদের সন্ধ্যাকালীন কোর্সে অতিরিক্ত কাজ করেন। এসব কারণেই প্রশ্নপত্র তৈরি ও মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি বলে অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র জানায়, ভর্তি কমিটির অধিকাংশ সভা অনুষ্ঠিত হতো রাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাস, সন্ধ্যাকালীন কোর্সের কাস এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাস নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ প্রশ্নপত্র সংক্রান্ত কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতেন।
এ বছর গ ইউনিটের ভর্তি পরীার প্রশ্নপত্র ও খাতা মূল্যায়নের সঙ্গে জড়িত ১৮ শিকের মধ্যে তিনজন ছিলেন ভর্তিসংক্রান্ত কাজকর্মের মূল দায়িত্বে। এঁদের মধ্যে ব্যবসায় শিা অনুষদের ডিন জামাল উদ্দিন আহমেদ বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা, এর আগে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ছিলেন। শিকদের অভিযোগ, তিনি বেসরকারি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর সময় দেন। অপর দুই সদস্য রফিকুল ইসলাম ও আবু হেনা রেজা হাসান একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাস নেন।
এই তিনজন ছাড়াও এস এম মাহফুজুর রহমান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং রূপালী ব্যাংকের পরিচালক। বাকিরা প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে যুক্ত।
তবে বাইরে কাজ করার কারণে ভর্তিসংক্রান্ত কাজে কোনো ধরনের প্রভাব পড়েনি বলে দাবি করেছেন মাহফুজুর রহমান। আর ডিন জামাল উদ্দিন এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। গত বুধবার সকালে ডিনের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। দুপুরে তদন্ত কমিটির সভায় উপস্থিত হওয়ার পরপর তাঁর কার্যালয়ে প্রবেশ করলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ সময় সেখানে উপস্থিত ভর্তি কমিটির আরেক সদস্য ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসের চেয়ারম্যান আবু হেনা রেজা হাসান এ প্রসঙ্গে কথা বলতে চাননি। অপর সদস্য রফিকুল ইসলামের বাসায় যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
গ ইউনিটের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মূল্যায়নে তিন ধরনের ভুল হয়েছে। যেমন বাংলা অংশে একটি প্রশ্ন ছিল কোনটি পর্তুগিজ শব্দ? এর উত্তরে যে চারটি জবাব দেওয়া ছিল তার মধ্যে আনারস ও পেয়ারা দুটি উত্তর সঠিক। কিন্তু মূল্যায়নের সময় কর্তৃপ আনারসকে সঠিক বলে ধরে নেয়। এর ফলে যেসব শিার্থী পেয়ারাতে সঠিক চিহ্ন দেন, তাঁদের উত্তর ভুল বলে ধরা হয়।
ইংরেজিতে একটি প্রশ্ন ছিল ফবংঢ়রংব- এর সমার্থক শব্দ কোনটি? এর উত্তরে দেওয়া চারটি শব্দের মধ্যে সঠিক উত্তর হবে ধনযড়ৎ শব্দটি। কিন্তু মূল্যায়নের সময় ভধপরষরঃধঃব শব্দটি সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়, যা সমর্থক নয়। উত্তরপত্রে এমন ভুল ছিল ছয়টি। আরও ছয়টি প্রশ্ন ছিল, যেগুলোতে কোনো শুদ্ধ উত্তরই ছিল না।
পরীা কমিটির কয়েকজন শিক জানান, বাংলা ও ইংরেজি প্রশ্ন তৈরির েেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও ইংরেজি বিভাগের বিশেষজ্ঞ শিকদের সহায়তা নেওয়া হয়নি। ব্যবসায় অনুষদের শিকেরাই প্রশ্ন করেন। এই পদপে সঠিক ছিল না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রথমবার ভুল ধরা পড়ার পর প্রশ্নপত্র তৈরি ও মূল্যায়ন করতে গিয়ে দফায় দফায় ভুল হয়। গ ইউনিটের প্রশ্নপত্রে শিার্থীদের জন্য দেওয়া নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, প্রতি ভুল উত্তরের জন্য দশমিক ২৪ করে নম্বর কাটা হবে। কিন্তু ফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রথমবার প্রকাশিত ফলে তাঁরা প্রতি ভুল উত্তরের জন্য দশমিক ২০ করে নম্বর কেটেছেন। এর ফলে প্রথমবার পাস হওয়া অনেক শিার্থীই দ্বিতীয়বার প্রকাশিত ফলে ফেল করেন।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘শিকদের ভুলের কারণে শিার্থীদের যে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সে জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কাদের অসতর্কতা বা অবহেলার কারণে এমন হযেছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করার জন্য তদন্ত কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’ উপাচার্য বলেন, ভুল হলে তা সংশোধন করারই ছিল প্রথম কাজ। শিার্থীরা প্রথম এবং দ্বিতীয়রবার যে ফল পেয়েছিল, তা ছিল ভুল এর ভিত্তিতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার সুযোগ নেই। পুনরায় পরীা নিয়ে স্বচ্ছতার মাধ্যমেই শিার্থীদের ভর্তি করা হবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্য মীজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরীাসংক্রান্ত সব ধরনের কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে। এ বিষয়ে অনুষদের ডিন ও পরীা কমিটিতে থাকা কিছু শিক্ষক বক্তব্য দিয়েছেন। সবার সঙ্গে কথা বলে এটি স্পষ্ট যে শিকদের অবহেলার কারণেই প্রথমবার ভুল হয়েছিল। আর তা সংশোধন করতে গিয়ে আবারও তাঁরা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
ব্যবসায় শিা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক মো. সিরাজুল ইসলাম প্রথমআলোকে বলেন, ‘ভর্তিপ্রক্রিয়ার পুরো কাজের সঙ্গে শিকেরা জড়িত থাকেন। কাজেই সব ভুল শিকদের।’
গত ২৮ অক্টোবর ‘গ’ ইউনিটে ৯৮০টি আসনের বিপরীতে ৩৮ হাজার ৮৫৫ জন শিার্থী ভর্তি পরীায় অংশ নেন। ৩১ অক্টোবর ফল প্রকাশ করা হলে দুই হাজার ৭২৭ জন পরীার্থী উত্তীর্ণ হন। ১ নভেম্বর বেশ কিছু শিার্থী উত্তরপত্র মূল্যায়নে ভুল আছে বলে অভিযোগ করেন। এর ভিত্তিতে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়ন করে ২ নভেম্বর আবার ফল প্রকাশ করা হয়। এতে আগে পাস করা ৩৯ জন অকৃতকার্য হন, ১৯৪ জনের মেধাক্রম এক হাজারের ওপরে চলে যায়। এরপর কয়েক শ শিার্থী আবারও ফল পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানালে ১৯ নভেম্বর রাতে ডিনস কমিটির জরুরি সভায় ফল বাতিল করা হয়।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগীদের প থেকে হাইকোর্টে দায়ের হওয়া মামলায় তথ্যপ্রযুুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার তিনি প্রথমআলোকে জানান, একজন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল তাঁকে ২৮ নভেম্বর আদালতে যেতে বলেছেন এবং তিনি যাবেন। ইতিমধ্যে তিনি পত্রপত্রিকার খবরগুলো পড়েছেন এবং এ বিষয়ে আরও তথ্য জানা ও বোঝার চেষ্টা করছেন।
(আহমেদ আরিফ-এর প্রতিবেদন, প্রথমআলো ২৬ নভেম্বর ২০১১)
আহমেদ আরিফের এই প্রতিবেদন থেকে আমরা যা পচ্ছি তা হচ্ছে-- শিকদের অবহেলা এবং তাদের টাকার পেছনে ছোটবার অবিরাম পরিশ্রমের চিত্র। টাকার পেছনে ছোটার পরিশ্রমের মধ্যে আমি ততটা অপরাধ দেখিনাÑ যতোটা অপরাধ ছিল বোর্ডের চেয়ারম্যান কর্তৃক নমুনা প্রশ্নের ব্যাংকের বাণিজ্যিকী রূপান্তরের মধ্যে তার তুলনায় এটা নস্যি-- তবু সেই নস্যি ঘটনাই এমন বিপর্যয়ের জন্ম দিয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত যে অধ্যাপকদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের অনেককেই আমরা অনেকেই চিনি না কিন্তু যিনি জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োজিত তাঁকেই যখন গত শতকের শেষ দিকে যখন এদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা কাল-- তখন দেখেছি টাকার জন্য শিকদের ‘সাহা’ স¤প্রদায়ে নাম লিখিয়ে মুকুট মাথায় পরতে তখনই তো আতঙ্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বোধ করেছি। অসহায় বোধ করেছি-- সে অসহায়তারই শিকার হচ্ছি আজ হাতে-কলমে এই যা।
আমরা এক সহকর্মী দীপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে দীপু যখন তার বিভাগেই শিকতা পেশায় যোগ দিল তখন তার জন্য গর্ববোধ করেছি আমি নিজেও। কিন্তু কয়েক বছর পর একদিন হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা হয়ে যখন তার কাশ নেবার ফিরিস্তি শুনছিলাম তখন মনে হল সে নিজের অতিব্যস্ততা জাহির করছে। ওভারঅ্যাক্ট করছে Ñ সরাসরিই তাকে বললাম, বেশি জাহিরী করোনা, তোমার কেন এত কাশ নিতে হবে? কেনই বা জাতীয় অধ্যাপক মহোদয়ের কাশ তোমাকে তিনি নিতে দেবেন, খামোখা কেন বানিয়ে বলছো? বলে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ জাহির করছো?
বলা বাহুল্য দীপু যেমন ব্রিলিয়ান্ট তেমনই ছেলে হিসাবে সহজ সরলÑ তার পে আদৌ জাহিরী করা সম্ভব নয়, মিথ্যা বা বানিয়ে বলবার তো প্রশ্নই আসে না। আমার এমন ধারার ধারাল প্রশ্নের উত্তরে যাকে বলে ‘সলাজ হাসি’Ñ সেই হাসি হেসে ও বলল, ‘শুচি ভাই, জাতীয় অধ্যাপক স্যার বাইরের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কাশ নিলে পান ৪ হাজার টাকা, আর আমি তাঁর কাশটি নিয়ে পাই ৩শ’ টাকা। এজন্যই আমাকে তাঁর কাশ চালিয়ে নিতে হয়।’
যে জাতীয় অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাশ না নিয়ে ৪ হাজার টাকার পেছনে ধেয়ে যানÑ কিছু দিন আগে দেখি ‘বদলে যাও, বদলে দাও’Ñ বলে এক আন্দোলনে তিনি তার বদলে যাবার, বদলে দেবার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, তিনি তার বাড়ির কাজের ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তি করে দেবেন। মহামান্যের এই মহানুভবতায় কি প্রকৃত বদল ঘটবে কোন কিছুর?
অশিার বিরুদ্ধে আমরা শিার কথা বলছি কিন্তু চর্চা করছি কুশিার। প্রকৃত শিা শিার্থীকে তার সারা জীবনের জন্য সঠিক প্রশ্ন করতে শেখায় এবং সেই সঠিক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে সঠিক উত্তর অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে তাকে পৌঁছে দেয় সঠিক উপলব্ধি তথা প্রকৃত সত্যের সমীপে। কিন্তু কুশিার চর্চা তাকে ঠোল দেয় বিকৃত জীবনে, বিকৃত বোধে, বিচ্যুতির অন্ধকারে। আর সেই ঘটনাই অব্যাহতভাবে ঘটছে আমাদের সমাজে, শিাঙ্গনে তথ্য ব্যক্তি জীবনেও। এটি ঘটছে কারণ শিাকে নিয়ে সর্বোচ্চ কু-চর্চা আমরা করছি। বোর্ডের বই পুড়িয়ে বইকে শিার্থীদের কাছে দুর্লভ করা, বিদেশে বই ছাপাতে গিয়ে দেশের টাকা এবং সময়ের শ্রাদ্ধ করে শিার্থীদের হাতে বই না-পৌঁছে। নিষিদ্ধ নোট বই উচ্চমূল্যে শিার্থীদের কিনতে বাধ্য করে। শিকতার নামে প্রাইভেট পড়াকে ব্ল্যাকমেইলের হাতিয়ার করেÑ এ রকম আরো অসংখ্য কু-চর্চা করে। যার জাতীয়তার বোধটি পর্যন্ত নেই, তাকে জাতীয় অধ্যাপক বানিয়ে। শিাকে পণ্য বানিয়ে আমরা ভুলের চক্রে মাথা ঠুকছি। এ থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদেরকে প্রকৃত শিার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। মনোযোগ দিতে শিক মহোদয়ের প্রতিও। শিাকে সৈয়দ মুজতবা আলী-র পণ্ডিত মশাইয়ের তিন ঠেঙে কুকুরের হিসাব থেকে বের করে আনতে হবে। স্কুল ইন্সপেক্টরের তিন ঠেঙে কুকুরে পেছনে ব্যয় মাসে পঁচাত্তর টাকা। আর বিদ্যালয়ের পণ্ডিত মশাইয়ের মাসিক বেতন ৭৫ টাকাÑ তাহলে পণ্ডিত মশাইয়ের বেতন ইন্সপেক্টরের কুকুরের কয় ঠ্যাঙের সমান? এই একক অংক পরাধীন দেশের কিন্তু স্বাধীনতার ৪০ বছরেও হিসাবটি তেমনই রয়ে গেছে বলেই টাকার পেছনে বিস্কুট দৌড়ে শামিল শিক মহোদয়গণ।
প্রশ্নপত্রের এই ভুলের ঘূর্ণিপাক বিষয়ে কথা বলছিলাম আমার ফুপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যানের সঙ্গে। শুনে তিনি বললেন, ‘একটি প্রশ্ন প্রণয়নের জন্য একজন শিক্ষক পান এক হাজার টাকা আর সেটি যদি বিক্রি করা হয় তবে পাওয়া যায় লাখ টাকা! ভাগ্য যে, এক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি!’ শিক্ষা নিয়ে এবম্বিধ ব্যবসায় চলছে বলেই আমরা সমাজের সবক্ষেত্রে দুর্গতি দুর্ভাগ্যের শিকার হচ্ছি আজও।
এ কেবল তাদের পাপ নয়, এ পাপ সমাজেরও। আজকের পত্রিকাতেই একজন শিকের চিঠি ছাপা হয়েছে শিকের জন্য সরকারি দেয় বাড়ি ভাড়া ভাতা ১০০ টাকা। একশ’ টাকা মাসিক ভাড়ায় কেউ বাড়ি ভাড়া খুঁজতে গেলে তাকে উম্মাদাশ্রমের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন যে কেউ। তাহলে সরকারের নির্ধারিত এই বাড়ি ভাড়া ভাতার জন্য সরকারকে কোথায় পাঠানো উচিৎ?
আমি জানি না ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এই বিষয়গুলো আমলে নেবেন কি নাÑ না আমলে নেবে মাননীয় আদালত। তবে পাঠক, আমি আপনাদের বিবেকের কাছে বিষয়গুলো, অভিজ্ঞতাগুলো তুলে ধরছি যেন সমস্যার প্রকৃত স্বরূপ আমরা যথাযথ উপলব্ধি করি। সমস্যার প্রকৃত সমাধানে আমরা উপনীত হতে পারি।
ঢাকা, ২৭ নভেম্বর ২০১১
ংযঁপযরংুবফ@মসধরষ.পড়স

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




