[] শুচি সৈয়দ []
দেখতে দেখতে বছরটি শেষ হয়ে এলো। প্রতিদিনের সংবাদপত্রে আমি সংবাদ খুঁজি আশার, কিন্তু সেগুলো ভরা থাকে নিরাশার সংবাদে। সংবাদপত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় পৃষ্ঠা হচ্ছে খেলার পৃষ্ঠা। অথচ এ পৃষ্ঠা দুটিই আমি সযতনে এড়িয়ে যাই। বলা যায়, প্রায় পড়িই না। এমনকি সেই খেলাধুলার পৃষ্ঠার সংবাদ যখন খেলার পাতার বাইরেও স্থান করে নেয় তখনও তা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। ফলে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হওয়া সাকিব আল হাসানের কৃতিত্বের খবরটি যখন আমার স্ত্রী পাঠ করেন তখন আমি চমকিত হই। তার তারিফ করি ভালো খবর খুঁজে বের করার জন্য। আমি আমার সংবাদপত্র পাঠ প্রবণতার ত্র“টির বিষয়টি অবহিত ছিলাম নাÑ সেটি উপলব্ধি করেছি সম্প্রতি একটি মহাজনি বাক্য পড়ে। উদ্ধৃতি হিসেবে ছাপা হয়া সেই সুন্দর বক্তব্যটি যতদূর মনে পড়ছে এরকমÑ সংবাদপত্রে একমাত্র খেলার পাতা এবং বিজ্ঞানের পাতায় আশাবাদিতার খবরগুলো ছাপা হয়। হ্যাঁ, এটি খুবই সত্যি কথা। বিজ্ঞান বিষয়ক খবরা-খবরগুলো অবশ্য আমাকে চুম্বকের মতোই টানে। তবে খেলার পাতার বিষয়ে আমার যে উদাসীনতা তা একেবারেই ক্ষমাহীন বলেই মনে হচ্ছে। কেননা, যে টেস্টে বাংলাদেশ জেতেনি সে টেস্টেই সাকিব জিতে নিয়েছে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের বিরল সম্মান! অথচ আমি বাংলাদেশের হারাটাকেই কেবল দেখছিÑ সাকিবের অর্জনটাকে নয়। আমার মতোই নেতিবাচক মনোভাবের অধিকারী অধিকাংশ সংবাদপত্র পাঠক এবং সমাজের বেশির ভাগ মানুষই বোধ করি। তাই আমরা আশার সংবাদ খুঁজে পাই না।
গত ২৩ ডিসেম্বর সুন্দরবনের মাথাভাঙ্গা নদীতে কাঁকড়া ধরতে যাওয়া পিতা নিরঞ্জন মণ্ডল বাঘের কবলে পড়লে পুত্র তাপস মণ্ডল বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বাঘের মুখ থেকে পিতাকে রক্ষা করেছে, তাকে আমরা কি খেতাব দেব? আবার ২৫ ডিসেম্বরের পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, পিতার সামনে শিশুকন্যাকে খুন করেছে ঝগড়াটে প্রতিবেশী। পশুর সঙ্গে লড়াইয়ে জয়ী মানুষ, মানুষের পশুত্বের কাছে পরাজিত হচ্ছেÑ এই পরস্পরবিরোধী উপাদানের ভেতরই চরৈবেতি আমাদের জীবন।
কয়েক সংখ্যা আগের মত ও পথে আমি কয়েকটি মৃত্যুকে ঘিরে শিরনামের লেখায় মোটরচালকদের পেশাটির ওপর পক্ষপাত দেখিয়ে বলেছিলাম, একটি আসনে একনাগাড়ে ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা বসে থেকে যারা যান চালনার কাজটি করেন সেটা খুব শক্ত কাজ। এ সময় তাদের অনেক বিষয়ে সচেতন থেকে যান চালনা করতে হয়। আমার কথাগুলো এবং অনুভূতির প্রমাণ দিয়েছেন এক মহৎ মোটরচালক ফরিদপুরের সুবল সাহা। গাড়ি চালাতে চালাতে যিনি হার্ট অ্যাটাকে নিজে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন অথচ গাড়ির ৫২ জন যাত্রীর প্রাণরক্ষা করে শেষ মুহূর্তেও ব্রেক করে নিরাপদে যানটি থামিয়ে। কী বলবেন এ চালকের বিষয়ে? আমরা তো ঘাতক ট্রাক, ঘাতক বাস, ঘাতক চালক বলতে বলতে একটা মর্মর মূর্তি তৈরি করে ফেলেছিÑ গোটা পেশাটির লোকজনের। একদিকে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের মৃত্যুতে আমরা যেমন তাদের একতরফা নিন্দা ও আক্রোশের ভেতর ঠেলে দিয়েছিÑ তেমনই মোটর শ্রমিকনেতা মন্ত্রীর মোটর শ্রমিকরা ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে পাদুকাঘাতে যে উš§ত্ততা দেখিয়েছে তার বিপরীতে এ চালককে যদি ‘শহীদ’ও বলিÑ তাকে নিয়ে তাদের কারোরই মাথাব্যথা নেই। তবে ব্লগের কিছু তরুণের দৃষ্টি এড়ায়নি খবরটি। তারা চালকের পরিবারের জন্য কিছু করার উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ মোটর শ্রমিকরা তাদের এ কমরেডকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত রূপে তুলে ধরতে পারত। কেননা এ লোকটি তাদের সবার ‘ব্র্যান্ডনেম’ হয়ে উঠতে পারেন।
চালক সুবলের আÍত্যাগ দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে অনেকেরই। আমাদের অতিব্যস্ত জীবনের এমন মূল্যবান অনেক সংবাদ অগোচরে হারিয়ে যায় দ্রুত। আমি সুবলের সংবাদসহ সংবেদনশীল তরুণদের লেখাটি সম্পূর্ণ তুলে ধরতে চাই মত ও পথের পাঠকদের সম্মুখেÑ
‘‘গাড়িচালক বাঁচিয়ে গেলেন ৫২টি প্রাণ
গাড়ি চালানো অবস্থায় হƒদেরাগে আক্রান্ত হন চালক সুবল সাহা। সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক চেপে ও চোখলিভার টেনে গাড়িটি মহাসড়কের মধ্যেই থামিয়ে দিয়ে ঢলে পড়েন ইঞ্জিন কভারের ওপর। তৎক্ষণাৎ স্থানীয় একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এভাবেই মৃত্যুর আগমুহূর্তে ফরিদপুরের গাড়িচালক সুবল বাঁচিয়ে গেলেন ৫২টি তাজা প্রাণ। গত রোববার বিকেলে এ ঘটনাটি ঘটে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার বনমালিদিয়া এলাকার শাহ হাবীব মাদ্রাসার সামনে। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার বাসিন্দা সুবল সাহা শহরের গোয়ালচামট মহল্লার লাহেড়ীপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। স্ত্রী ছাড়াও তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে।
ফরিদপুরের বিভিন্ন পথে ৩০ বছর ধরে গাড়ি চালান সুবল সাহা (৫৫)। কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি তাঁর হাতে। গত রোববার মৃত্যুর আগমুহূর্তেও নিজের প্রত্যুৎপন্নমতির জোরে বাঁচিয়ে গেলেন বাসের ৫০ জন যাত্রী, সুপারভাইজার ও হেলপারসহ ৫২টি প্রাণ।
বাসের সুপারভাইজার আবদুল কুদ্দুস জানান, মাগুরা থেকে বেলা তিনটা ৩২ মিনিটে বাসটি চালিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা হন সুবল সাহা। বিকেল সাড়ে চারটায় মধুখালীতে এসে ১০ মিনিট বিরতি দিয়ে তিনি আবার বাস চালানো শুরু করেন। আবদুল কুদ্দুস হঠাৎ দেখতে পান মহাসড়কের মাঝখানেই ব্রেক চেপে ও চোখলিভার টেনে গাড়িটি থামিয়ে দিয়েই চালকের আসন থেকে ইঞ্জিন কভারের ওপর ঢলে পড়েন সুবল।
ফরিদপুর মোটর ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি জুবায়ের জাকির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে চালকদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ও বদনাম আছে। সুবল সাহা যেন আমাদের এই বদনাম ঘোচাতে জীবনের শেষ সময়ও চেষ্টা করেছেন।’
(প্রথম আলো, ১৩ ডিসেম্বর ২০১১)
এই সংবাদের প্রেক্ষিতে ১৯ তারিখের প্রথম আলোয় লিখেছেন একদল তরুণ দায়িত্বশীল ভাবুক, শিক্ষক, সাংবাদিক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও উন্নয়নকর্মী আলী রীয়াজ, ইমতিয়াজ আহমেদ, রেজা সেলিম, কাবেরী গায়েন, সুপ্রীতি ধর, শাহরীয়ার রেজা, মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান, রাজীব নন্দী, প্রাঞ্জল চক্রবর্তী, জান্নাত ইলা
‘সুবল সাহা, আমরা আপনার কাছে ঋণী, চিরঋণী’
গত ১৩ ডিসেম্বরের দৈনিক প্রথম আলোর বিশাল বাংলা পাতায় ছাপা একটি ছোট খবর হয়তো অনেকেরই চোখে পড়েনি। ‘গাড়িচালক বাঁচিয়ে গেলেন ৫২টি প্রাণ’ শিরোনামের খবরের সূত্রে আমরা সবাই পরিচিত হয়েছি সুবল সাহা নামের একজন বাসচালকের সঙ্গে, যিনি মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজ দায়িত্ব পালন করে অর্ধশতাধিক মানুষের জীবন রক্ষা করেছেন। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে বাস চালানো অবস্থায় হূদরোগে আক্রান্ত হন সুবল সাহা, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাসের ব্রেক চেপে ও চোখ লিভার টেনে বাস থামিয়ে একটি অনিবার্য দুর্ঘটনা থেকে সবাইকে রক্ষা করেন।
খবরটি পড়ে অজান্তেই শ্রদ্ধাভক্তি আর অসীম কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে। একধরনের চাপা কান্নায় অস্থির হয়ে উঠি আমরা। অদ্ভুত এক বিহ্বলতা আমাদের গ্রাস করে। সড়ক দুর্ঘটনার খবর প্রতিদিন পড়তে পড়তে, প্রতিদিন প্রিয়জনদের হারাতে হারাতে আমরা অনেকাংশেই ধরে নিয়েছি যে কেউই হয়তো এখন আর নিজ দায়িত্ব পালন করেন না। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কিংবা প্রশাসনযন্ত্রের অনিয়ম আর দুর্নীতিই যেন শেষ কথা। চালকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা আর অনিয়মই যখন স্বাভাবিক ঘটনা বলে বিবেচিত হচ্ছে, ঠিক সে সময় সুবল সাহা তাঁর দায়িত্ববোধ দিয়ে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন, এখনো আশা আছে।
সুবল সাহার এই খবর পড়ে প্রথমেই আমাদের মনে হয়েছে এই দায়িত্ববান মানুষটির কথা সবার কাছে বারবার বলা প্রয়োজন। প্রয়োজন তাঁর এই কর্তব্য পালনে নিষ্ঠার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা জানানো। যাঁরা দায়িত্বে অবহেলা করছে- রাষ্ট্রযন্ত্র, আমলাতন্ত্র, প্রশাসন, গাড়িচালক; তাদের সমালোচনার পাশাপাশি এ ধরনের অনুকরণীয় চেষ্টাকে প্রশংসিত করাকেও আমাদের দায়িত্ব বলে মনে হয়েছে। সেই দায়িত্ববোধ থেকে এ নিয়ে কথা বলতেই আমরা কয়েকজন লেখাটি তৈরি করেছি।
কিন্তু কেবল প্রশংসাবাক্যই যথেষ্ট নয়। ১৩ ডিসেম্বরের ওই খবরের একটি অংশে আমাদের চোখ এসে থমকে দাঁড়িয়েছে: ‘স্ত্রী ছাড়াও তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে’। সুবল সাহার মৃত্যু এই পরিবারকে অসহায় অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই যেন সরকার, বিশেষত যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এই পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করে, সুবল সাহার সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করে। সরকারের কাছে আবেদনের পাশাপাশি আসুন, আমরাও সবাই মিলে সুবল সাহার পরিবারের পাশে দাঁড়াই। এই পাশে দাঁড়ানো কেবল তাদের বিপদে সহায় হওয়ার জন্যই নয়; একই সঙ্গে সুবল সাহার পরিবার ও সন্তানদের কাছে এই কথা বলার জন্য যে এ দেশে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে নিষ্ঠার মূল্য দেওয়ার মানুষও আছে।
আমাদের সম্মিলিত চেষ্টায় যতটুকু সাহায্যই আমরা করতে পারি না কেন, তার চেয়েও বড় হলো অন্যান্য ‘দায়িত্বশীল’ চালকের কাছে এ কথা পৌঁছে দেওয়া যে, ‘আমরা সব সময় আপনাদের পাশে আছি, থাকতেও চাই।’ সেই সঙ্গে সুবল সাহার বাসের যাত্রীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি, ‘সুবল সাহা, আমরা আপনার কাছে ঋণী, চিরঋণী’।
সংযুক্তি : এই লেখার প্রাথমিক খসড়া যখন প্রস্তুত হচ্ছে তখন ফেসবুকের ‘ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী জনতা’র গ্রুপে সুবল সাহার পরিবারের জন্য সবাইকে আর্থিক সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানানো হয়। ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায় বন্ধুদের কাছ থেকে। কয়েকজন বন্ধু প্রবাস থেকে এরই মধ্যে টাকা পাঠিয়েছেন। তাই আসুন, যার যতটুকু সামর্থ্য আছে, তাই দিয়েই আমরা ন্যায়নিষ্ঠ চালক সুবলের পরিবারের পাশে দাঁড়াই।
(প্রথম আলো, ১৯ ডিসেম্বর ২০১১)’’
কত গভীর পেশাদারিতা থাকলে একজন চালক তার জীবনের শেষ মুহূর্তেও এমন অসাধারণ দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দিতে পারেন তার আমাদের মনে রাখতে হবে। সব পেশার সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে থাকা সত্য হচ্ছে ‘সেবা’ অথচ এই শব্দটিই আমরা ভুলে গিয়েছি, জীবনের সব ক্ষেত্রে আমরা কাজকে বোঝাস্বরূপ বিবেচনা করছি। তাই কাজ আনন্দের উৎস না হয়ে হয়ে উঠছে নির্যাতনের উপকরণস্বরূপ। সুবল সাহা তার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সেবা-র কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন।
২
সর্বত্র আস্থাহীনতার ভেতর আমি আস্থা খুঁজে পেতে চাইÑ সৌদি আরবে বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রকাশ্য শিরñেদের প্রতিবাদে আমাদের দেশের তরুণদের প্রতীকী প্রতিবাদ পৃথিবীব্যাপী প্রচার পেয়েছিলÑ ফলে আরও কিছু শ্রমিক এ নৃশংসতা থেকে রক্ষা পেয়েছে আপাতত। প্রবাসে বর্তমানে আমাদের প্রায় ১ কোটি মানুষ শ্রমদানে ব্যাপৃত। বিশ্ব সভ্যতায় তারা হয়তো আধুনিক মানবদাস হিসেবেই তাদের অবদান রাখছে কিন্তু আমাদের জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে তাদের অবদান অসামান্য। নামহীন, গোত্রহীন এ মানবদাসদের পাঠানো রেমিট্যান্সই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত। আমাদের উচিত তাদেরকে চোখেরমণির মতো আগলে রাখা কিন্তু ঘটছে তার বিপরীত। বিদেশে আমরা দূতাবাসে দায়িত্ব পালনের জন্য যাদের পাঠাচ্ছি প্রায়ই তারা সে দায়িত্ব পালনে অপারগতার পরিচয় দিচ্ছেন। সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে নেপালে পাঠানো একজন নাকি হিন্দি ছবির বিখ্যাত নায়িকার পিছু নিয়েছেন। কিছু দিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় যান প্রধানমন্ত্রী। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে গেছেন দূতাবাসের এক কর্মকর্তা। আজকের একটি পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়েছে আরব আমিরাতে নিযুক্ত কনসাল জেনারেলের বক্তব্য, সেখানে বাংলাদেশী মহিলা কর্মীরা নাকি নানা অপতৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে। বিদেশে দায়িত্বপালনের জন্য প্রেরিত কনসাল জেনারেলের কাছ থেকে দেশের শ্রমজীবী কর্মীদের সম্পর্কে এমন বক্তব্য অভিপ্রেত নয়। এতে আমাদের বিপন্ন প্রবাসীদেরকে আরও বিপন্নতার মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। পরদেশে গিয়ে অপতৎপরতায় লিপ্ত হতে দাউদ ইব্রহিমের মত সন্ত্রাসীরাও হিমশিম খায়। আর আমাদের মহিলা কর্মীরা অনায়াসে তাতে লিপ্ত হবার ক্ষমতা রাখে এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? এমন কথা বলার আগে ভাবা উচিত। খতিয়ে দেখা প্রয়োজন কাদের অপতৎপরতার দায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে নিরীহ বাংলাদেশী প্রবাসী খেটে খাওয়া মানুষদের কাঁধে?
প্রবাসীদের ওপর অনেকেই রুষ্ট যে তারা আপন সুখ-সুবিধার সন্ধানে প্রবাসমুখী। অনেক আগে কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেনÑ ‘বিদেশের কুকুর ধরি/ স্বদেশের ঠাকুর ফেলিয়া’। বিষয়টি সেই বাস্তবতায় আজ আর নেই।
বিশ শতকে বিদেশগমনকে অর্থনীতির ভাষায় ব্রেইন ডেইন বা মেধাপাচার বলে অভিহিত করা হতো। কিন্তু একুশ শতকে সেটা রূপ নিয়েছে বিপরীতÑ যাকে বলা যায় ব্রেইন গেইন। পৃথিবীর ছোট্ট একটি সম্পদশালী দেশ ব্র“নাই। সে দেশের সুলতানের একটি সাক্ষাৎকারে প্রথম পড়েছিলাম এই কথাগুলো। যতদূর মনে পড়ে তাতে তিনি বলেছিলেন, ব্রেইন ডেইনকে ভয় পাবার কিছু নেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর। এখন তারুণ্যে যারা বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশমুখী সেই মধাবীরা একটা বয়সে দেশঅভিমুখী হবেন তখন সেটা ব্রেইন গেইন রূপে বিবেচিত হবে। কেননা তখন তারা ফিরবেন অনেক অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়ে, দেশকে কিছু দেবার যোগ্যতা নিয়ে, আর্থিক সামর্থ্য নিয়ে। কথাগুলো খুব সত্যি। লর্ড ক্লাইভেরা ডাকাতি লুণ্ঠন করে আমাদের দেশ থেকে নেয়া অর্থে তাদের দেশ গড়েছে। আর আমরা পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে, সেবা দিয়ে অর্জিত অর্থে দেশ গড়তে পারবো না? নিশ্চয়ই পারবো কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন দরদী অভিভাবক যারা দেশে দেশে ছড়িয়ে থাকা এ মাটির সন্তানদের বুক দিয়ে আগলে রাখবেন। সর্বদা জেগে থাকবেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে ঘুমিয়ে দেশের মাথা হেট করবেন না।
অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে রামরুু। তারা আগামী এক দশক অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি মনোযোগ দেবার দাবি জানিয়েছে। আমার ধারণা এটি এখন দাবির বিষয় নয়, এটি এখন বা¯তবতা।
টেলিভিশনে দেখলাম নতুন যোগাযোগ মন্ত্রী বলছেন, এক বছরের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে এ কথা অধিকাংশ মানুষই আস্থায় নিতে পারছেন না, কারণ অনেক প্রতিশ্র–তি দেওয়া হয়েছে পালিত হয়নিÑ তাই কাজ করার এবং সততার সঙ্গে কাজ করার উপদেশ দেন বিআরটিএ-র কর্মকর্তাদের। রাস্তায় চলাচলের অসম্পূর্ণ অনুপযোগী বাসকে রুট পারমিট প্রদানের সমালোচনা করেন তিনি। যাদের ব্যক্তিগত লোভ, অসততা অনেক মানুষের জীবনহানির কারণ হচ্ছে তারা মন্ত্রীর এই নসিহত আদৌ উপলব্ধি করবেন কিনা জানিনা তবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এটা বুঝি যে, কথা আসলে অনেক হয়েছে এখন কাজ করে দেখাতে হবে। মানুষ আর মিথ্যাবাদী রাখালের গল্প শুনে প্রতারিত হতে চায়না, সত্যিকার প্রয়োজনে বরং সরাসরি বাঘের সঙ্গে লড়তে চায়, লড়ে প্রাণ বাঁচাতে চায়। আশাবাদের জায়গাটি এখানেই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




