somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘গরিব মানুষ চোর হয়না,’

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শুচি সৈয়দ
সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে। প্রতি বছর বাজেটের মাস এলেই জমে ওঠে কিছু তর্ক-বিতর্ক। অর্থমন্ত্রী সমাজের নানা পেশার প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও তার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মত বিনিময় করেন। সে সব মত বিনিময় সভার ভেতরে বাইরে নানাবিধ স্বার্থসংশ্লিষ্টদের স্বার্থের বিনিময় ঘটে। বার্র্ষিক রাষ্ট্রীয় লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ নির্ধারণ শেষে প্রণীত হয় বাজেট।
এবছরও তার ব্যতিক্রম নেই। যেমন জমে উঠেছে ‘কালো-টাকা’ ‘শাদা-টাকা’র বিতর্ক। অর্থমন্ত্রী এক সভায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের টাকার মাধ্যমে কালো টাকা তৈরি হয় বলে এক বিতর্কিত মন্তব্য করে তুমুল সমালোচিত হয়েছেন। অর্থমন্ত্রীর এমনধারার ‘কালো-টাকা’র সংজ্ঞায়নে আমপাবলিক আমরা যারা অর্থনীতির ‘অ আ ক খ’ বুঝিনা তারা ভাবতেই পারি অদূর ভবিষ্যতে বাজেটের আগে লাল টাকা, নীল টাকা, হলুদ টাকা, সবুজ টাকাÑ টাকার এরকম সংজ্ঞায়নের উদ্ভব ঘটে যাবে।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে অর্থসচিবও কালোটাকা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। ট্যাক্স আদায় করে কালোটাকাকে সাদাটাকায় রূপান্তরিত করার কথা বলেছেন। বলা হচ্ছে, কালো টাকা হচ্ছে অপ্রদর্শিত আয়। কালোটাকার বিষয়টা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সেই ধর্ম ব্যাখ্যায় পরিণত হচ্ছেÑ একই পানিÑ তাকে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা বলছেন ওয়াটার, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বলছেন জল আর মুসলমানরা বলছেন পানি! আর তা নিয়েই বিবাদ-বিসম্বাদ। ঘাটে ঘাটে বদলে যাচ্ছে বস্তুর অভিধা। আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে গ্রামের ডিমের শহরে এসে মামলেটে পরিণত হবার ঘটনা।

বাজেটের মাসে যেসব মত বিনিময় সভায় অর্থমন্ত্রী মিলিত হন সেসব সভার একটিতে একবার দৈবক্রমে আমার উপস্থিত থাকার ‘সৌভাগ্য’ হয়েছিল। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সেবার মিলিত হয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ সমিতির নেতাদের সঙ্গে। সাংবাদিক সহকর্মীদের সঙ্গে আমি প্রবেশাধিকার পেয়ে ঢুকে ছিলাম সচিবালয়ের সেই সভায়। সেদিন উপস্থিত ছিলেন ড. আবুল বারকাত, আতিউর রহমানসহ অর্থনীতিবিদ সমিতির আরও বিশিষ্ট কিছু নেতা। ড. আবুল বারকাত তার হাতে থাকা অর্থনীতিবিদ সমিতির সুপারিশ পাঠ শুরু করার দশ-পনের মিনিটের মাথায় অর্থমন্ত্রী সবজান্তা সমশেরের ভঙ্গিতে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বক্তৃতা শুরু করেছিলেন। তার বক্তৃতার সারবত্তা ছিল এই যে, বাজেট প্রণয়নে তার ভূমিকা স্রেফ টায়ার পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির ড্রাইভারের মত। তাকে সেই চাকা ঠিক করতে হবেÑ এমনকি রিয়ারভিউ মিররে তাকিয়ে পেছনে দেখার মত পরিস্থিতিও তার নেই। দাতারা তাকে টাকা দেবে সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য নয়। দাতাদের কাছে তার অঙ্গীকারের রজ্জুতে তিনি যে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা সেকথা বলেছিলেন বিশেষ আÍশ্লাঘার সক্সেগ। অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান দাতাদের সাথে তার সুসম্পর্ক নিয়ে গর্বিত ছিলেনÑ তিনি দাতাদের সুযোগ্য প্রতিনিধি রূপে দায়িত্বও পালন করেছেন।

আমাদের দেশে বাজেট প্রণীত হয় নানা শ্রেণীর স্বার্থেÑ সেখানে দেশের গরিব মানুষদের প্রাপ্য অধিকারের দাবি জানালেÑভয় দেখানো হয় সমাজতন্ত্রের জুজুর!
কয়েক দিন আগে পরলোকগমন করেছেন দেশের প্রবীণ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। অনেক দিন আগে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, পিঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া আমাদের দেশের গরিব কৃষকরা কোন সংকট তৈরি করেনা, তারাই আমাদের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। সংকট তৈরি করে উচ্চবিত্ত ধনী শ্রেণী। তাদের ভোগের জন্য নানাবিধ বিলাস উপকরণ আনতে গিয়েই দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় করা হয়। ধনীরা আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং করে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে স্থানান্তর করে যে সংকট তৈরি করে গরিব মানুষ তার অসহায় শিকার হন। তারাই অর্থনীতির সমস্ত সংকট তৈরি করে। ঠিক এইখানটিতেই পার্থক্য সাইফুর রহমানদের সঙ্গে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ কিংবা ড. আবুল বারতাতদের মধ্যে। পার্থক্য দৃষ্টিভঙ্গির। পার্থক্য কার পক্ষে দাাঁড়াবেনÑ সমষ্টির পক্ষে না গোষ্ঠির পক্ষে না ব্যক্তির পক্ষে! কৃষককে সহযোগিতা করলে সেটা ‘ভর্তুকি’ অভিধা পাবে নাকি বিবেচিত হবে ‘বিনিয়োগ’ হিসেবেÑ সেটা দাতাদের চশমা চোখে লাগিয়ে যথার্থভাবে উপলব্ধি করা যাবেনা।
এ মাসের ১৭ তারিখে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ড. আবুল বারকাত বক্তব্য রাখছিলেন তামাকের অর্থনীতির ওপর। সেখানে প্রশ্নোত্তর পর্বে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। বিনাসুদে কৃষকদের ঋণ প্রদানের একটি প্রকল্পের সাফল্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি যা বললেন তাতে স্বতঃস্ফুর্ত করতালিতে হল ভরে যায়। খুব প্রত্যয়ের সঙ্গে ড. বারকাত বললেন, ‘আমার গরিব মানুষ চোর হয়না!’ এটি এই দেশের সব চাইতে বেশি সত্য কথা। অথচ যখনই দেশে কোনও নেতা নির্বাচনের কথা ওঠে তখন সবাই সৎ মানুষের খোঁজে হন্যে হয়ে ওঠে। এদেশে নাকি সৎ মানুষের অভাব! এই কথা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রায় ষোল কোটি মানুষের দেশে অসৎ মানুষ ষোলও লাখও নয়। বলা চলে সৎ মানুষদেরই দেশ এটা। ‘গরিব মানুষ চোর হয়না,’ অসৎ হয়না, মিথ্যুক হয়নাÑ এ আমাদের কমবেশি সকলেরই অভিজ্ঞতা। জনতা ব্যাংকের বিনাসুদে দেয়া ঋণের অভিজ্ঞতায়ও সেটাই প্রমাণিত হয়েছেÑ বলছিলেন ড. বারকাত। তিনি বলেন, ৬ থেকে ১০ বার যদি সুদ বিহীন এই ঋণ সুবিধা গরিব মানুষকে দেওয়া যায় তাহলে সে দাঁড়িয়ে যাবে।
জানালেন, সুদ বিহীন এই ঋণকে প্রচলিতধারার ব্যাংকাররা ঋণ বলে স্বীকার করতে নারাজ! মাত্র ৬ মাসের জন্য দেওয়া এই সুদবিহীন ঋণের রিকভারি রেট ৮৮ পার্সেন্ট। কৃষকরা ঋণ নিয়েছেন এবং ঋণের টাকা ফেরত দিয়েছেন যথাসময়ে। ফেরত দেবার সময় ছলছল চোখে শুধু একথা বলেছেন, ‘আবার দেবেন তো?’ অর্থাৎ তারা তাদের ওপর আস্থা অব্যাহত রাখার আকুতি প্রকাশ করেছেন মাত্র। যেন দুর্দিনে তারা এমন ঋণ পান, সে ঋণ ব্যবহার করে দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারেন। এই ঋণ পেয়ে উপকৃতদের সবাই যে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তা হচ্ছেÑ এই ঋণ নিয়েও ‘রাতে তাদের ভাল ঘুম হয়েছে।’ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছেন, আতঙ্কে ঘুম হারাম হয়নি তাদের। যে সব এলাকায় এই পরীক্ষামূলক প্রকল্প চলছে সেসব এলাকার এনজিও গুলো তাদের ঋণের সুদের হার কমাতে বাধ্য হয়েছেন। এই ঋণের কস্ট অব ফান্ড তাঁর হিসেবে ৫ পার্সেন্ট। এর সঙ্গে আরও ৫ পার্সেন্ট যোগ করে যদি ১০ পার্সেন্ট তাদের কাছে সুদ হিসবে নেওয়া হয় ধারণা করা যায় তারা সেটা সানন্দে পরিশোধ করবেন। শুধুমাত্র প্রয়োজনের মৌসুমে, ফসলের মৌসুমে তাদের কাছে কোনওরকম জটিলতা ছাড়া তুলে দেওয়া যায় এটি। জনতা ব্যাংক এই ঋণ বিতরণ করে কারো গ্যারান্টি, সুপারিশে নয়, জনসমক্ষেÑ যার প্রয়োজন তাকে সনাক্ত করে। আসল কথা এবং কাজ হচ্ছে গরিবের ওপর আস্থা রাখাÑ কেননা দুর্নীতিতে বারবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া এই দেশটির অর্থনীতি বাঁচিয়ে রেখেছেন এদেশের খেটে খাওয়া এই জনগোষ্ঠিই।
আজকের একটি পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছেÑ মাত্র পাঁচ ভাগ লোকের হাতে দেশের চল্লিশ ভাগ সম্পত্তি। গত চার দশকে অর্থনীতির সূচকের উন্নতি হলেও ধনী দরিদ্রের বৈষম্য কমেনি। দেশের ৫ ভাগ লোক অর্থাৎ ৮০ লাখ মানুষের হাতে ৪০ শতাংশ সম্পত্তি পুঞ্জিভুত। অথচ এদের মধ্যে সরকারকে কর দিচ্ছে মাত্র ১০ লাখ লোক। এটি হচ্ছে দেশের আভ্যন্তরীণ চিত্র। পাশাপাশি দাতাদের চিত্রটি কি? সে চিত্রটি বিচিত্র বটেÑ‘ঋণ পরিশোধেই ব্যয় হচ্ছে অর্ধেক সহায়তা, বাড়ছে প্রতিশ্র“তি মিলছে না অর্থ ছাড়’Ñঅর্থাৎ দাতাদের আগের ঋণের অর্থ তারা নতুন ঋণ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেÑ কাগজে জমছে নতুন ঋণের পাহাড়।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিচার চাই? না ভাই, আমরা "উল্লাস" চাই

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৩৭





দীপু চন্দ্র দাস একটি পোশাক শিল্প কারখানায় চাকরি করতো। সম্প্রতি দীপু দাস তার যোগ্যতা বলে সুপার ভাইজার পদে প্রমোশন পেয়েছিলো।

জানা যায়, সুপারভাইজার পজিশনটির জন্য আরও তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×