somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার প্রথম বিদেশ যাত্রা এবং সবুজ পাসপোর্ট

১৬ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৯:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদেরকে কি আটকিয়ে রাখবে? বিমানে উঠতে দিবে না? এতদিনের স্বপ্ন-পরিশ্রমের কি তাহলে এখানেই সলিল সমাধি হবে? ফিরে যেতে হবে দেশে? মুহুর্তের মধ্যে এরকম হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। ভয়, আতঙ্ক ও কিছুটা হীনমন্যতাবোধে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেও ঘামতে শুরু করলাম। হীনমন্যতাবোধটা আমার পাসপোর্টের জন্য।

আমাদের গর্বের সবুজ পাসপোর্ট। আমাদের ভালোবাসা। তবে অনেক গল্প, উপন্যাস কিংবা আত্মজীবনী মারফত এই গর্ব-ভালোবাসার জিনিসটি নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ার কাহিনীও আমরা অনেক জানি। জানতাম আমিও। তবে বাস্তবে এটা মোকাবেলা করা যে কত কঠিন ও বিব্রতকর তা টের পেলাম গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কাতারের দোহা বিমানবন্দরে। আর সেখানেই গন্তব্যে পৌঁছতে পারার অনিশ্চয়তার পাশাপাশি আমার মধ্যে প্রথমবারের মতো পাসপোর্টের জন্য হীনমন্যতাবোধ সৃষ্টি হয়েছিল।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সুইডেনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট একচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায় আমি আমার এক সহপাঠীর সাথে সুইডেন যাচ্ছিলাম। বিমানে উঠা তো দূরের কথা। জীবনে এর আগে কখনো বিমানবন্দরেও আসা হয় নি। তাই ইমিগ্রেশন, কাস্টম জাতীয় ব্যাপারগুলো সম্পর্কে কিছুটা ভয়, কিছুটা আতঙ্ক ও জড়তা নিয়েই ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে প্রথমবারের মতো ঢুকেছিলাম জিয়া বিমানবন্দরে। তবে মনে একটা সাহস ঠিকই ছিল। আর তা হলো আমরা নিজেদের উদ্যোগে যাচ্ছি না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরকে পাঠাচ্ছে। তাই যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সময়ও আমাদেরকে কোন দুশ্চিন্তা করতে হয় নি। নিশ্চয় বিমানবন্দরেও কোন ঝামেলা হবে না। কারণ আমাদের সাথে আমাদের ও সুইডেন দুই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে।

জিয়াতে সাহসেরই জয় হলো। ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা সব কাগজপত্র দেখে সাধারণ কিছু প্রশ্ন জিঙ্গাসা করেই ছেড়ে দিল। তবে তখনই বুঝতে পারছিলাম প্রথম বারের মতো বিদেশ যাচ্ছি বলেই আমরা অনেকের সন্দেহের চোখে পড়বো। তাও আবার সুইডেন! তখনো কাতারের দোহা ও সুইডেনের আরলান্ডা বিমানবন্দর মোকাবেলা করা বাকি।

বিব্রতকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো দোহাতেই। আমাদের টিকিট ছিল কাতার এয়ারওয়েজের। তাই স্টকহোমগামী বিমানে উঠার জন্য টিকিট ও পাসপোর্ট নিয়ে কাতার এয়ারওয়েজের বুথের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কী করবে না করবে কিছুই জানি না। তাই সামনের লোকদের কী করে তাই খেয়াল করছিলাম। তবে তারা সবাই ছিল সাদা চামড়ার। পাসপোর্টের রং দেখলাম লাল। আরো দেখলাম দায়িত্বরত লোকটি শুধু পাসপোর্ট ও টিকিটটা এক পলক দেখেই সবাইকে ছেড়ে দিচ্ছে। মনে একটু বল পেলাম। মুহুর্তের মধ্যেই সবার চেকিং শেষ হয়ে গেল। আমার পালা এলো। আমি পাসপোর্ট আর টিকিট একসাথে এগিয়ে দিলাম। খেয়াল করলাম এতক্ষণ ধরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের লাল পাসপোর্ট চেক করার সময় তার মুখে যে কর্পোরেটিয় হাসি লেগেছিল আমার সবুজ পাসপোর্টটি দেখার পর তা মুহুর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। হঠাৎ করে তাকে খুব সচেতন মনে হলো। সুইডেনের কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি এ জাতীয় অনেকগুলো প্রশ্ন করলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজপত্র দেখতে চাইল। সবকিছুই ঠিক আছে দেখার পর সে নখ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভিসা পরীক্ষা করলো। সবকিছু শেষ করে মনে হলো কিছুটা অতৃপ্তি নিয়েই সে আমাকে ছেড়ে দিল। যাই হোক শেষপর্যন্ত বিপদ কেটে গেছে ভেবে ভালো লাগল। ভিতরে গিয়ে অন্য যাত্রীদের সাথে বসে কাগজপত্র গোছানো আর মনে মনে ওই কর্মকর্তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্দার করা শুরু করলাম। আমি ভেবে পেলাম না আমাকে আটকালে স্টকহোমে আটকাতে পারে ও জিঙ্গাসাবাদ করতে পারে। কারণ আমি তাদের দেশে ঢুকছি। তারা যাচাই করতেই পারে। কিন্তু কাতার এয়ারওয়েজের ওর এত মাথাব্যাথা উঠলো কেন?
এসব যখন ভাবছি তখন হঠাৎ আবারো আবির্ভূত হলো কর্মকর্তাটি। সে আমাকে আবার ব্যাগ নিয়ে উঠে আসতে ইশারা করলো। বিপদের আশঙকা করলাম। কাছে যেতেই সে আমাকে টিকিট ফেরত দিয়ে আমার সহপাঠীর সাথে উপর তলায় সিকিউরিটির কাছে যেতে বললো। তখন আরেকটা ব্যাপার ঘটলো। আমাদেরকে এ কথা বলার পরপরই সে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য যাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমরা অবাক হয়ে খেয়াল করলাম সে আবার আগের মতো কর্পোরেটিয় হাসি মুখে নিয়ে একপলক লাল পাসপোর্টটি দেখেই সবাইকে ছেড়ে দিচ্ছে। শুধু আমাদের দুজনকেই পরীক্ষা দেয়ার জন্য উপরে পাঠালো। আমরা ভয়ে ভয়ে উপরে গেলাম। মনে হলো সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জা ও জড়তায় কুঁকড়ে গেলাম।

হঠা‌‌ৎ করে সে আবার উপরে পাঠালো কেন জিঙ্গেস করতে সহপাঠীটি বললো কর্মকর্তাটি আমার মতো তারও সব কাগজপত্র পরীক্ষা করে। এক পর্যায়ে কর্মকর্তাটি যখন তার বয়স জিঙ্গেস করে সে থতমত খেয়ে যায়। কারণ তার পাসপোর্ট ও মূল বয়স এক না। ফলে সে যখন মনে মনে বয়স হিসেব করা শুরু করে কর্মকর্তাটির সন্দেহ বেড়ে যায়। আর তাই আমাদেরকে এক সাথে উপরে পাঠিয়ে দিয়েছে।

সিকিউরিটির কাছে গিয়ে দেখি কালো পোশাকপরা বিশালদেহী কয়েকজন নিগ্রো বসে আছে। ধীরে ধীরে আমরা আমাদের পাসপোর্ট, কাগজপত্র ও টিকিট এগিয়ে দিলাম। তার চোখেও সন্দেহের দৃষ্টি। সবকিছু দেখার পাশাপাশি সে গতানুগতিক বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকলো। এক পর্যায়ে সে জিঙ্গাসা করলো, "হোয়াট ডু ইউ গো দেয়ার?" আমি কিছু না বুঝে সরি বললাম। সে আবারো একই কথা বললো। এমনিতেই ভয়ে ছিলাম তার উপর সে কী জানতে চাইছে তা বুঝতে না পেরে আরো ভয় পেয়ে গেলাম। আমার অবস্থা বুঝে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সহপাঠীটি যখন আমাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল তখন লোকটি তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল। আমাদেরকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলে তারা নিজেরা তখন আমাদের পাসপোর্ট-ভিসা পরীক্ষা করা শুরু করলো। একপর্যায়ে খেয়াল করলাম আমাদের ভিসাকে একজন আরেকজনকে জাল বলছে। তখনই আসল ভয়টা পেলাম। আর মুহুর্তের মধ্যে শুরুর প্রশ্নগুলো মাথায় চলে এলো। তবে মনে একটা আশা ঠিকই ছিল। কারণ আমরা জানি আমাদের সবকিছুই ঠিক আছে। তাই ওরা হয়ত আরো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আমাদেরকে এই ফ্লাইটে না যেতে দিয়ে আটকিয়ে রাখবে। কিন্তু পরে যখন দেখবে সব ঠিক আছে তখন পরের ফ্লাইটে ঠিকই উঠিয়ে দিবে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছি আর ঘামছি। একটু পরপর ঘড়িতে দেখছি ফ্লাইটের আর কতক্ষণ বাকি। সময় যেন কাটছিলই না। যখন ফ্লাইটের আর বেশি বাকি নেই তখন সিকিউরিটির লোকটি আমাদের পাসপোর্ট দিয়ে দিল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নিচে নেমে ইচ্ছে হচ্ছিল কাতার এয়ারওয়েজের ওই কর্মকর্তাটির মুখের মধ্যে পাসপোর্টটি ছুঁড়ে মারি। অরেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শেষ পর্যন্ত দৌড়ের মধ্যে আমাদের স্টকহোমগামী বিমান ধরতে হয়েছিল।

১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে স্টকহোমের আরলান্ডা বিমানবন্দরেও প্রথমে দোহার মতোই অভিজ্ঞতা হয়। সেখানে ইমিগ্রেশনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও এর বাইরের নাগরিকদের জন্য আলাদা লাইন। আমরা আমাদের লাইনে দাঁড়িয়ে দেখলাম ইউরোপিয়দের লাইন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে। আমাদের আগে যারা ছিল তারা একেক জন একেক দেশের। তাদের কাজ শেষ হতেও বেশি সময় লাগল না। আসলো আমাদের পালা। এবার সহপাঠীটি আমার আগে। তার কাছ থেকে যখন কর্মকর্তাটি জানতে পারলো আমরা দুজন একই সাথে এসেছি তখন আমাদের অপেক্ষা করতে বলে আমাদের পাসপোর্ট ও কাগজপত্র নিয়ে সে আলাদা রুমে চলে গেল। কতক্ষণ পর এসে সে যখন এগুলো আমাদেরকে আবার ফিরিয়ে দিল তখন সেখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। আমরা শেষ যাত্রী হিসেবে আমাদের লাগেজ তুলে নিলাম। পরে জানতে পেরেছিলাম কর্মকর্তাটি অন্য রুমে গিয়ে সুইডেনে আমাদের প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটরকে ফোন করে আমাদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিল।

আমাদের পাসপোর্টে সুইডেনের ভিসা ছাড়া আর কোন ভিসা নেই। বুঝতে পারছিলাম আমাদেরকে সন্দেহ করার এটা একটা কারণ। তবে আমাদের সবুজ পাসপোর্টধারীদেরও যে তারা সহজে বিশ্বাস করতে চায় না তাও মনে হয়েছিল প্রবলভাবে। মনে মনে এই অবিশ্বাসের কারণ জানার চেষ্টা করছিলাম আর হীনমন্যতায় ভুগছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৫২
১৫টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×