somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘেরাটোপে বন্দি নারী : শাস্ত্র থেকে মিডিয়া

১৯ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৮:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'“‌‌‌ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে এথেন্সবাসী করেছেন, বর্বর করেননি, তাঁকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে মুক্তপুরুষ তৈরি করেছেন, স্ত্রীলোক বা ক্রীতদাস করে তৈরি করেন নি।”' উক্তিটি যেন-তেন কারো নয়; বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো-র। কারো কারো মতে যিনি নারীমুক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক এবং বিশ্বাসী। তৎকালীন সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নাকি ব্যক্তিগত মানসিকতা, মনস্তাত্ত্বিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী প্লেটো উক্তিটি করেছেন তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। সে বিতর্কে যাবার জায়গা এটা নয়। তবে উক্তিটিতে স্পষ্টভাবেই তিনি নারীকে ক্রীতদাসদের সমতূল্য বিবেচনা করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে করা প্লেটোর এ উক্তির বাস্তবতা যে আজও বহাল তবিয়তে রয়েছে তা জানতে আমাদের বেশি দূর যেতে হয় না। এর জন্য পাবলিক বাসগুলোর দিকে তাকানোই যথেষ্ট; যেখানে কিছু আসন সংরক্ষিতকরণের চিহ্নস্বরূপ লেখা থাকে- মহিলা/শিশু/প্রতিবন্ধি। ইঙ্গিতটি স্পষ্ট। নারীকে বিবেচনা করা হচ্ছে শিশু ও প্রতিবন্ধিদের মতো দুর্বল হিসেবে; যাদের বাড়তি সুবিধার প্রয়োজন। বাসওয়ালারা যে অবচেতন মনেই এ কাজটি করেছেন তা ধরে নেয়া যায়। আমাদের শক্তিশালী সামজিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিলিকৃত মতাদর্শ আমাদের এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে শুধু এই অর্ধশিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর বাসওয়ালারাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরাও নারীকে এরকম দুর্বল, অধস্তন, পুরুষের প্রতি নির্ভরশীল, সৌন্দর্য ও যৌনপ্রতীক হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রচলিত গালি, প্রবাদ, সঙ্গীত কিংবা কৌতুকেও এর প্রকাশ ঘটে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় আমাদের প্রচলিত গালিগুলো যাকে উদ্দেশ্য করেই নিক্ষিপ্ত হোক না কেন, গালির মাধ্যমে যাকে আক্রমণ করা হয় সে হলো কোন নারী, মা বা বোন বা স্ত্রী। কোন পুরুষকে অপদস্ত করবার সবচেয়ে কার্যকর পথ হচ্ছে তার মা, বোন, কন্যা বা স্ত্রীর ‘সতীত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন বা তাদের কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত। এছাড়া প্রতিটি ভাষায় বিশেষ্য-বিশেষণ পদগুলো খেয়াল করলে দেখা যায় তার অধিকাংশই পুরুষবাচক; আকার-ইকারযোগে শব্দের রূপান্তর ঘটিয়ে নারীবাচক শব্দ তৈরি করা হয়েছে। এতেই বোঝা যায় আমাদের সংস্কৃতি-সভ্যতা নির্মাণ ও টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে পুরুষ কতটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই শক্তিশালী যে খোদ নারীরাও নিজেদেরকে এরকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিসেবে বিশ্বাস করে। সিমঁ দ্য ব্যুভুয়া যেমনটা বলেছেন, “নারীর কোনো পৃথক জগৎ নেই। জগতের তাবৎ বিষয় সে বিচার করে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। নারীর বাস্তবতা আসলে পুরুষেরই বাস্তবতা।” এ বাস্তবতা তৈরিকরণ ও শক্তিশালীকরণে যেসব সামাজিক প্রতিষ্ঠান মূল ভূমিকা পালন করেছে ও করছে তার মধ্যে পরিবার, রাষ্ট্র, ধর্ম ও মিডিয়াই অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠানের শক্তিশালী ভূমিকার কারণেই নারী আজ ঘেরাটোপে বন্দি। উৎপাদনের উপায় থেকে বিচ্ছিন্ন নারীর ভূমিকা শুধু সন্তান লালন-পালন ও শ্বশুর-শ্বাশুরী-পতিদেবতার সেবা-শুশ্রƒষার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সংসার চালাতে ঠেকায় পড়ে আজ অনেক নারীকে ঘরের বাইরে যেতে সমাজ স্বীকৃতি দিলেও তাকে তার জন্য নির্ধারিত ঘর-গৃহস্থালির কাজ সামলিয়েই অন্য কাজ করতে হচ্ছে।
অথচ মানবজাতির শুরুটা এরকম ছিল না। তখন নারী-পুরুষ উভয়েই সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। কোন কোন ক্ষেত্রে নারীপ্রাধান্যও বিরাজমান ছিল। যার রেশ আমাদের গারো ও খাসিয়া সমাজে এখনো টিকে আছে। হিন্দু ধর্মের দিকে তাকালেও বিষয়টি বোঝা যায়। যেখানে শক্তির দেবী দূর্গা আর বিদ্যার দেবী স্বরসতী; যারা প্রত্যেকেই নারী। কিন্তু একপর্যায়ে পুরুষ শ্রেণীসচেতন হয়ে উঠলো। আর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখতে প্রচার করতে শুরু করলো নারীকে শৃঙ্খলিতকরণের বিভিন্ন মতাদর্শ। যার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় ধর্মকে। কোন নারী প্রতিবাদ করলে চালানো হয় শারীরিক আগ্রাসন। ঈশ্বরের দোহাই দিয়েই আদিম পুরুষ প্রথমে নারীকে গৃহবন্দি করে। যার কার্যকারিতা এখনো খুব শক্তিশালীভাবেই রয়েছে। একে আরো কার্যকরভাবে টিকিয়ে রাখতে বর্তমান পুরুষ ধর্মের চাইতেও মোক্ষম অস্ত্রটি হাতে পেয়ে গেছে; যার নাম মিডিয়া। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রও কাজ করে চলেছে প্রত্যক্ষভাবেই। তবে এখানে আমরা বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। সভ্যতার শুরুতে নারীর পায়ে শিকল পরানোর জন্য শাস্ত্রকে প্রত্যক্ষভাবে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা দেখার পাশাপাশি বর্তমান যুগে এ কাজটি সুকৌশলে মিডিয়ার দ্বারা কীভাবে করা হচ্ছে তা সংক্ষেপে দেখার চেষ্টাই এখানে করা হবে।

শাস্ত্রের শৃঙ্খল এবং নারীর বন্দিত্ব
উৎপাদনের উপায় পুরুষের হাতে থাকায় ব্যক্তিগত মালিকানা উদ্ভবের পরই পুরুষ শ্রেণীসচেতন হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন আসলে পুরুষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীকে শৃঙ্খলিত করা শুরু করে। চালু করে এক পুরুষ ও বহু স্ত্রী বিবাহ। গৃহাভ্যন্তরে বন্দি নারী তখন পুরুষের চোখে পরিণত হয় শুধু সম্ভোগের সামগ্রীতে। পরবর্তীতে এটিকে হালাল করতে পুরুষ শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে বিলোতে শুরু করে মতাদর্শ। যাতে নারী তার অধস্তন অবস্থাকেই মেনে নেয় বিনা বাক্য ব্যয়ে। এক পর্যায়ে পুরুষের কামজ ঈর্ষার পরিণতিতে চালু হলো বালিকা-কিশোরী বিবাহ প্রথা। অন্য কোনো পুরুষের স্পর্শ পাওয়ার সম্ভাবনা নির্মূল করতেই যে এ প্রথা চালু করা হয় তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। উদ্ভাবন করা হয় ‘'সতীত্ব তত্ত্ব'। শুধু উদ্ভাবন করেই ক্ষান্ত হল না পুরুষ, এ তত্ত্বটিকে মনে-প্রাণে মেনে নিতে নারীকে বাধ্য করানোও হল। যা একবিংশ শতকের বর্তমান ‘আধুনিক’ পৃথিবীতেও শক্তিশালীভাবে বর্তমান। অবগুন্ঠন অবরোধ পর্দাপ্রথার প্রচলনও হল এ কারণেই। স্থূল যুক্তিতে সন্তানের পিতৃপরিচয় অসংশয়িত রাখাই নারীর ‘সতীত্বে’ গুরুত্ব আবশ্যিক বলে মানা হলেও ঈর্ষার কারণেই ভারতীয় সমাজে আট-নয়-বারো বছরের মধ্যে কন্যার বিবাহ না দিলে মা-বাবার নরকবাস সুনিশ্চিত হয়ে যেত এবং ওই ঈর্ষার তীব্রতাই পুরুষসৃষ্ট বিধবার কৃচ্ছতাক্লিস্ট জীবনযাপন বা সহমরণ আর অধবার পতিতা হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কারণ পুরুষস্পর্শ্যা বলেই সে ছিল ঘৃণ্য। এভাবেই নারী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তার চারপাশের জগৎ থেকে। অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়ের জন্য হয়ে পড়ে স্বামীনির্ভর। এজন্যেই দেখি হিমালয়-মেনকাও গৌরী সম্প্রদানকালে শিবের হাত ধরে মিনতি জানায়, “'কুলীনের পো তোমায় কি বলিব আর। হাঁটু ঢাকি বস্ত্র দিও পেট পুরে ভাত।'”
স্বাভাবিকভাবেই এক সময়ের স্বাধীন-শক্তিশালী-আত্মবিশ্বাসী নারী এ অধীনতা সহজভাবে মেনে নিতে পারে নি। প্রতিবাদ করেছে, বিদ্রোহ করেছে ঘরে-বাইরে। আর এ প্রতিবাদ-বিদ্রোহকে দমন করার জন্য শাসকশ্রেণীর ঐতিহাসিক চরিত্র অনুযায়ীই পুরুষ নারীর ওপর অব্যাহতভাবে চালিয়েছে মতাদর্শিক ও শারীরিক আগ্রাসন। আগেই বলেছি মতাদর্শিক আগ্রাসনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে নতুন নতুন আইন-বিধি-ব্যবস্থা, ঐশ্বরিক বিধান বা শাস্ত্রকে। যেমন ইসলাম ধর্মে আল্লাহ্কে উদ্ধৃত করে বলা হয়, “আমি পুরুষকে (স্বামীকে) নারীর অভিভাবক করে দিয়েছি এবং অন্যত্র তুমি স্ত্রীকে (এবং একাধিক) যেমন খুশি তেমনভাবে সম্ভোগ কর।” এখানেও নারী যে সম্ভোগ্যা তা বলা হল। সাংখ্যদর্শনে পুরুষপ্রকৃতি তত্ত্বেও পুরুষ হচ্ছে বীজ বপনকারী নারীযোনী বা গর্ভরূপ ক্ষেত্রে। স্বামীর অসামর্থ্যে স্বামীর নির্বাচিত ও নিমন্ত্রিত অন্য পুরুষও ক্ষেত্ররূপ নারীতে শুক্ররূপ বীজ বপন করতে পারত। মহাভারতে এমনি ঘটনার ছড়াছড়ি দেখা যায়। নারী সম্বোগ্যা প্রাণী বলেই বহু আসমানী শাস্ত্রানুসারেই পুরুষমাত্রই যুগপৎ একাধারে একাধিক, হাজার, অসংখ্য নারী গ্রহণের ও সম্ভোগের অধিকারী। হাজার লক্ষ বছরে নারীর অধীনতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এভাবেই চেষ্টা চালানো হয়েছে। পুরুষ এর ফলও পেয়েছে হাতে হাতে। ফলে আজকের শিক্ষিতা চাকুরে রোজগেরে নারীও কেবল বাহ্যত স্বাধীন। মানসিকভাবে আজো সে দাসী, সেবিকা, চরণাশ্রিতা; কেননা সে বিশ্বাস করে স্বামীর পায়ের তলেই তার স্বর্গ।

মিডিয়ার মায়াজাল এবং নারীর ঘোর
মধ্য যুগে রাষ্ট্র ও ধর্মগুরুদের অধীনেই সমাজ পরিচালিত হত। তারাই নির্ধারণ করে দিত মানুষের সমস্ত কার্যকলাপের সীমা-পরিসীমা। দৈহিক এবং মানসিক দুটোই। সমস্বার্থগত সম্পর্ক থাকার ফলে দুজনই একে অপরকে ব্যবহার করত নিজেদের সুবিধা মত। নারীদের অধীনস্ত রাখার ক্ষেত্রে তা কীভাবে করা হতো এতক্ষণের আলোচনায় তা কিছুটা দেখা গেছে। পরবর্তীতে একটা সময় আসে যখন ব্যবসায়ী শ্রেণীটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইউরোপের ক্ষেত্রে আমরা দেখি উপনিবেশিকতা থেকে প্রাপ্ত মূলধনের মাধ্যমে পুঁজিপতি শ্রেণীটি এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে তারা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানায়। আর এর ফলেই আমরা জানি সামন্তপ্রথার বিলোপ ঘটে। মানব জাতি প্রবেশ করে পুঁজিবাদের যুগে। পুঁজিবাদের ধর্মই হল সে তার মুনাফার পথে যেকোন বাধাকেই গুড়িয়ে দেয়। ফলে ক্রমবর্ধমান মুনাফার পথ পরিস্কার করতে তাকে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হয়। তৈরি করতে হয় বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। কিংবা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতে হয় নিজের মত করে। তার ফলেই এক পর্যায়ে আমরা দেখি আবির্ভাব ঘটে মিডিয়ার; যা ক্রমে ধর্মের স্থানও দখল করে নেয়। আগে ধর্মের মাধ্যমে যে কাজটা করা হত আধিপত্যশীল শ্রেণীর পক্ষে সেই মতাদর্শ বিলানোর কাজটি করানো হয় মিডিয়ার মাধ্যমে। তাই এখন আমরা দেখি রাষ্ট্র কিংবা ক্ষমতা এবং মিডিয়ার সমস্বার্থগত সম্পর্কের মাধ্যমেই সমাজ পরিচালিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়া ওই ক্ষমতা কাঠামো অর্থাৎ পুঁজিপতি শ্রেণী ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারছে না। তাকে সেই কথাটিই অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হচ্ছে যা এই ক্ষমতা কাঠামো চায়। পুঁজিবাদের আরেকটি ধর্মের কথা আমরা জানি; তাহলো সে কখনো সমাজের স্থিতাবস্থা ক্ষুন্ন হোক তা চায় না। সে চায় না সমাজে বৈপ্লবিক কোন পরিবর্তন হোক। কারণ তা হলে মুনাফার সুযোগ ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। নারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নারীকে সেভাবেই উপস্থাপন করা হচ্ছে যেভাবে আধিপত্যশীল শ্রেনীটি চায়। বিশিষ্ট নারীবাদী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ কমলা ভাসিনের যেমন বলেছেন, '“গণমাধ্যম শ্রেণী বা জেন্ডার সম্পর্কের পরিবর্তনকে উপেক্ষা করে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখার পক্ষে। গণমাধ্যম এমন কোনো পরিবর্তন চায় না যা সাধারণের মনোজগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করবে; পরিবর্তন করবে সমাজস্থ সংস্কৃতি ও দর্শন।”' আর আমরা জানি পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে আধিপত্যশীল শ্রেণীটি নারীকে সবসময় দুর্বল, পুরুষের প্রতি নির্ভরশীল ও সম্ভোগের সামগ্রী হিসেবেই দেখতে চায়। ফলে মিডিয়ায় নারীকে সেভাবেই উপস্থাপন করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে মধ্য যুগে নারীকে অধীনস্থ রাখার জন্য ধর্ম তথা শাস্ত্রকে মতাদর্শ বিলানোর হাতিয়ার হিসেবে যেভাবে ব্যবহার করা হতো এখন সে কাজটি করা হচ্ছে মিডিয়ার মাধ্যমে।
আনু মুহাম্মদ তাঁর ‘নারী, পুরুষ ও সমাজ’ গ্রন্থে আমাদের সমাজে নারী পুরুষ উভয়ের মধ্যে নারী সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধের প্রধান ধারা বিশ্লেষণ করলে নারী সম্পর্কিত চিন্তা বা আদর্শ নারীর যে ভাবমূর্তি পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেছেন তা নিম্নরূপ :
(১) মেয়েরা ঘরের শোভা (২) যতই শিক্ষিত হোক বা চাকরি করুক মেয়েদের আসল কাজ ঘরে (৩) বাচ্চা, স্বামী ও স্বামীর পরিবারের কাজ ঠিক রেখে চাকরি করতে পারলে করুক (৪) ভাল মেয়ে : নরম, নমনীয়, কমনীয়, দুর্বল, চাপা, স্বামী বা পরিবারের ইচ্ছার কাছে সমর্পিত (৫) মেয়েরা ছেলেদের চাইতে শারীরিকভাবে দুর্বল এবং মেধা, মনন ও কর্মক্ষমতার দিক থেকে নিকৃষ্ট (৬) স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত (৭) নিয়ন্ত্রণ না করলে মেয়েরা বিপজ্জনক ইত্যাদি।
মিডিয়া যেহেতু সমাজেরই একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান, তাই মিডিয়াতেও নারীর এরূপ চরিত্রেরই পুনঃরূপায়ন ঘটে এবং তা ক্রমে শক্তিশালী হয়। কারনটি সোজা। এটি তার সার্কুলেশন, মুনাফা ও পুরুষতান্ত্রিক মালিকানার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্কযুক্ত।

শেষের কথা
প্রচলিত একটি প্রবাদ হচ্ছে “জোর যার মুল্লুক তার”। আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কথাটি খাটে। বলা যায়, গায়ের জোরেই পুরুষ নারীকে তার অধস্তন করে রাখছে। সভ্যতার শুরুতে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা এখনো চলছে একই রকমভাবে। নারীর মেধা, মনন ও কর্মদক্ষতার বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে তাকে দেখা হচ্ছে সম্ভোগের সামগ্রী হিসেবে। আমরা দেখেছি সভ্যতার শুরুর দিকে নারীর সমঅধিকার থাকলেও পুরুষ গায়ের জোরে ক্রমে তা হরণ করে। নারীকে বন্দি করে ঘরের ভিতর। আর সে কাজটিকে হালাল করতে ব্যবহার করা হয় ধর্মকে। পুঁজিবাদের এ যুগেও পুরুষ তার অবস্থান থেকে এক চুল সরেনি। বরং ক্রমে নারীর দুর্বল, অধস্তন, সম্ভোগ্যার রূপকে আরো পাকাপোক্ত করেছে। এ কাজটিকে হালাল করতে এ যুগে ব্যবহার করা হচ্ছে মিডিয়াকে। মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত নারীর এ রূপ দেখতে দেখতে পুরুষের পাশাপাশি নারী নিজেও তাকে এর বাইরে ভাবতে পারছে না। ফলে ফ্যাশন, প্রেম, রান্না, স্বামী-সন্তান-শ্বশুর-শ্বাশুরীর সেবা ইত্যকার বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থেকেই সে নিজেকে ধন্য মনে করছে। অন্যভাবে বলতে গেলে সে জীবনযাপন করছে একটা ঘেরাটোপের মধ্যে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অনেক আগেই নারী অধিকারের আওয়াজ ওঠেছে। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের এতটাই গভীরে প্রবেশ করেছে যে তা অর্জন করা যাচ্ছে না কিছুতে। প্রকৃতপক্ষে নারী নিজে যতদিন পর্যন্ত এ ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে নিজের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে সচেতন না হবে ততদিন যে মুক্তি অর্জন সম্ভব হবে না এ কথা বলাই যায়। হুমায়ুন আজাদ যেমন বলেছেন,' “নারীকে ঘৃণা করতে শিখতে হবে সম্ভোগের সামগ্রী হ’তে, এবং হ’তে হবে সক্রিয়, আক্রমণাত্মক। নিজের ভবিষ্যৎ সৃষ্টি ক’রে নিতে হবে নিজেকে...নারীর ভবিষ্যৎ মানুষ হওয়া, নারী হওয়া নারী থাকা নয়।”' তবে এক্ষেত্রে পুরুষেরও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীকে অধস্তন রাখার জন্য ধর্ম কিংবা মিডিয়াকে ব্যবহার না করে কীভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সামনে আগানো যায় সে চেষ্টা করতে হবে। কারণ জনসংখ্যার অর্ধেককে পঙ্গু করে রেখে কখনোই যে পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন সম্ভব নয় তা সহজেই বোঝা যায়। সভ্যতার শুরু থেকে এ পর্যন্ত যা কিছুই অর্জন হয়েছে তা উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টারই ফসল। এ কথাটি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেই কবেই বলে গেছেন,
“ পৃথিবীতে যা কিছূ মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”

(বলে রাখা ভাল, পোষ্টটি নারী বিষয়ক আমার প্রাথমিক কিছূ ধারণার রূপায়ন মাত্র। নারী বিষয়ে অনেকেই অনেক লেখালেখি করেছেন। সেখান থেকে কিছু পড়ে এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এ বিষয়ে আমার যে ধারণা গড়ে ওঠেছে, তা ওইসব লেখকদের সাহায্য নিয়ে একসাথে জড়ো করার চেষ্টা থেকে কিছুদিন আগে একটা লেখা দাঁড় করাই। সেটার সংক্ষেপিত রূপ এখানে দেয়া হলো।)

সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৮:৪১
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×