ফেইসবুক বন্ধের দাবি আর আমাদের মৌলবাদিরা
২৪ মে দৈনিক কালের কণ্ঠে দেখলাম মুফতি ফজলুল হক আমিনী সামাজিক নেটওয়ার্ক সাইট ফেইসবুক বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলেছেন। এই দাবি পূরন না হলে তিনি হরতাল সহ নানা কর্মসূচি দেওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন।
কোনো কিছু হলেই ধর্মের অবমাননার ধূয়া তুলে এটা বন্ধ করে দেওয়া, ওটা ধ্বংস করে দেওয়ার রুগ্ন মানসিকা আমাদের কোনোভাবেই পিছু ছাড়ছে না। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে যখন থেকে এই জনপদে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে তখন থেকে ধর্ম মানব কল্যানের সমার্থক না হয়ে কায়েমি স্বার্থবাদীদের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এই ফতোয়াবাজরা কিন্তু সংখ্যায় কম। নেহাত হাতে গোনা। কিন্তু প্রত্যেক সরকার এদের তোয়াজ করে, গায়ে মাথায় তেল মর্দন করে। ভাবটা এমন ভোটের বৈতরনী পার হতে গেলে এই ফতোয়াবাজাদের বগল দাবায় রাখতে হবে। তবে ইতিহাস কয় ভিন্ন কথা। যতোবার ধর্মের সাম্প্রদায়িকতার জিগির তোলা হয়েছে, বলা হয়েছে ইসলাম গেলো গেলো, ঠিক ততোবার বাঙালি মুসলমানেরা তাদের নর্দমায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, বাঙালি মুসলামানদের ধর্ম অনুভুতি কমে গেছে। বাঙালি মুসলমানেরা তাদের ইসলাম, উম্মাকেও সমানভাবে উর্ধে তুলে ধরেছে। তারপরও কতিপয় নৃ-তত্বে বাঙালি আর অন্তরে মধ্যপ্রাচ্যের ফতোয়াবাজরা ধর্মের নামে ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ করেছে রাজনীতিবিদদের চিন্তা। মুফতি আমিনি যখন সাম্প্রতিককালে ফেইসবুক বন্ধ ঘোষণার পায়তারা দেয় তখন সমাজে যে তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার একটি বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই। সারা দুনিয়ায় ফেইসবুকে কী হচ্ছে তা কী আমাদের মুফতি আমিনিরা জানেন, বোঝেন? আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না মুফতি আমিনি ইন্টারনেট ব্যবহার করেন কিনা। তবে তার আগে জানা দরকার মুফতি আমিনি আদৌ কম্পিউটারের মত প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংসের সংস্পর্শে এসেছেন কিনা।
সারা দুনিয়ায় তথ্যপ্রযুক্তির এক বিরাট বিপ্লব ঘটে গেছে। আমরা অনেক দেরিতে হলেও সেই প্রযুক্তির সেবা নিতে শুরু করেছি। দেরি করাতে এমনিতেই আমরা পৃথিবী থেকে পিছিয়ে গেছি। দেরি করার পেছনে আমাদের দেশের শাসকশ্রেণীর তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে চরম মূর্খত্যা বড় কারন। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া সরকার গঠনের পর বিনামূলে সাব মেরিন কেবলের সাথে বাংলাদেশকে সংযুক্ত হবার জন্য বলা হয়েছিলো। সে সময় আমাদের দেশের সরকার সাব মেরিন ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। কারন হিশেবে তখন বলা হয়েছিলো বাংলাদেশের তথ্য পাচার হয়ে যাবে। পরবর্তীতে সেই সাব মেরিন ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত হবার জন্য বাংলাদেশকে শত শত কোটি টাকা দিতে হয়েছে। এই হলো আমাদের দেশের শাসকশ্রেণীর তথ্যপ্রযুক্তি চেতনা ও জ্ঞান। শুধু মুফতি আমিনিদের দোষ দিয়ে লাভ কী ? এই সরকারের কতজন এমপি, মন্ত্রীই বা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। কতজনই ফেইসবুক বা টুইটারের মত সামাজিক সাইটে একাউন্ট করেছেন। আওয়ামী লীগের এক ওবায়দুল কাদেরকে ছাড়া আমি আর কাউকে দেখিনি ফেইসবুকে একাউন্ট আছে। ফেইসবুককে সহজে ফেইস করা সহজ নয়। কারন এই সামাজিক সাইটটিতে আপনি আপনার মত করে কথা বলতে পারেন। যদি সরকার বিরোধী কথা হয় তাও কোনো রকম সেন্সর ছাড়া লেখা যায়। সেখানে কে ওবায়দুল কাদের আর কে প্রধানমন্ত্রী অথবা বিরোধী দলীয় নেত্রি তার আলাদা কোনো শ্রেণী বিভেদ থাকে না। ফলে জনগনের মধ্যেকার যে চিন্তা তা সম্পর্কে অন্যরা জানতে পারে। পারে সরকারী দলের কর্তা ব্যক্তিরা। আমরাতো সেই দিন চাই যখন আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্টের সকলের কথা মন দিয়ে শোনেন এবং বোঝার চেষ্টা করেন।
মুফতি আমিনিরা অবশ্য বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বানাতে চান। তাদের দিবা স্বপ্ন দেশটাকে য্যানো ত্যানোভাবে পাকিস্তান বানানো। আর এই কারণে পাকিস্তানের অনুকরণ করা তাদের রাজনীতির ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের সম্প্রতি ফেইসবুক ব্যবহারের ওপর নিষেধজ্ঞা এসেছে। এবার এই পাকি প্রেমিদের ইচ্ছে বাংলাদেশে ও যেনো ওইরকম কিছু একটা হোক। পাকিস্তানে সামরিক সরকার মতায় এলে যেমন সেকানের মৌলবাদীরা সামরিক সরকারের পে সাফাই গায় বাংলাদেশের মৌলবাদীদের ক্ষেত্রও এই কথা সমান সত্য। পাকিস্তান তালিবানস্থানে পরিণত হয়েছে এখন মুফতি আমিনিদের টার্গেট বাংলাদেশও যেনো তালিবানদের স্বপ্নের দেশে পরিণত হয়। ফেইসবুক বন্ধ, ইন্টারনেট বন্ধ, সেল ফোন বন্ধ; যোগাযোগের সব বাহন বন্ধ। আমরা তখন কী করবো? আমরা কী পায়রার পায়ে বেধে দিবো চিঠি? সেই চিঠি চলে যাবে মা অথা প্রিয়তমার কাছে।
আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণী দিন দিন রুগ্ন মধ্যবিত্তে পরিণত হচ্ছে। সমস্যা এইখানে। কোনো সমাজের যদি ভিত্তি ভূমিই নস্ট হয়ে যায় তবে সেই সমাজের ভবিষৎ বড়ই করুন। এখানকার মধ্যবিত্তদের মধ্যে কোনো তাড়না নেই। যদি থাকতো তা হলে মুফতি আমিনি ফেইসবুকের বিরুদ্ধে হরতাল করে দেশ বন্ধের পায়তারা দিতে পারতেন না।
বাংলাদেশে সমস্যার শেষ নেই। যদি দেশ বাচাতে চান, মানুষ বাঁচাতে চান তবে ইশ্যুর শেষ নেই। উত্তরবঙ্গে দিনের পর দিন মঙ্গা হয়। অর্ধাহারে অনাহারে পথের ধারে মানুষ মরে। লাখ লাখ শিশু স্কুলে যেতে পারে না। দিন দিন ধনি গরিবের বৈষম্য বাড়ছে। যদি ঈমানদার হন, যদি ঈমান আকিদার ওপর জোর থাকে তবে এইসব নিয়ে হরতাল ডাকেন। দেখবো হিম্মত কারে বলে। প্রশ্ন তুলুন ধনি গরিবের বৈষম্য নিয়ে, প্রশ্ন তুলুন লাখ লাখ বেকার কেন অন্ধকারে
?
.................
এই লেখাটি আমি যে পত্রিকায় কাজ করি সেখানে তাৎখনিক প্রতিক্রিয়া হিশাবে লিখেছিলাম। শেষ পযর্ন্ত আর লেখাটি দেয়া হয়নি। ফলে ছাপাও হয়নি। তবে আমিনীর হরতাল ডাকতে হয়নি। হরতাল পালিত হবার আগেই মহান অ(!)সাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ সরকার ফেইসবুক বন্ধ করে দিয়েছে।
কালের কণ্ঠের তথ্যমতে, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর প্রচারণার অভিযোগে সরকার দেশে সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফেইসবুক সাময়িকভাবে বন্ধ (ব্লক) করার নির্দেশ দিয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরের পর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) দেশের দুটি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়েকে ফেইসবুক পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। গতকাল রাতে বিটিআরসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।’ আর জের ধরে পুরান ঢাকা থেকে রডিন নামের এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই একই পত্রিকার তথ্যমতে, ‘ফেইসবুকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ছবি বিকৃত করে ব্যঙ্গ করার অভিযোগে র্যাব রাজধানীতে রডিন নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে। মাহবুব আলম রডিন (২৪) সাতটি ছদ্মনামে ফেইসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে অপপ্রচার চালাচ্ছিল। নামগুলো হচ্ছেথমাহবুব আলম রডিন, ব্রিগেডিয়ার মাহাদী, সিপাহি মাহাদী, ইমাম হোসেন, রডিন আল, মোহাম্মদ আল মাহদী ও জুনাইরা খোন্দকার জিহান।’
কী আর লিখুম, আমরা তো বেক্কল হয়ে গেলাম। ডিজিটাল সরকার ফেইসবুক বন্ধ করলো! যেসব তরুন এই ডিজিটাল সরকারকে ভোট দিয়েছিলেন (মহাজোটের জয়ের পেছনে তরুন ভোটারদের সব থেবে বেশি অংশগ্রহণ ছিলো) তাদের আরও সামনে অনেক কিছু দেখার বাকি আছে।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে মতের ভিন্নতা থাকবেই। তা না হলে আসুন সবাই মিলে আমরা আওয়ামী লীগ করি না কেন?
রডিন ছেলেটার কপালে খারাবিই আছে। তারে নাকি এখন জিহাদি জিনে পাইছে। তার বিরুদ্ধে আমাদের কামেল র্যাবেরা ইসলামী জঙ্গিবাদী মামলা দিতাছে। দ্যাশটার যে কী হচ্ছে? কথা নেই বার্তা নেই জিহাদী। আরে বাবা এতো এতো জিহাদী যদি দেশে থাকে তাইলে দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বোমা ফেলতে কেন আসে না? এতো জিহাদী থাকলেতো এতোদিন মার্কিন মেরিন সেনারা আমাদের গুল্লি কইর্যা মারতো। তয় এসব হইলো তাগোর আসার ক্যারামতি।
আমরা এই সরকারের এই সিদ্ধান্তে কী করতে পারি? কার কাছে নালিশ জানাতে পারি। ফেইসবুক থাকার সময়তো আমরা আমাদের বন্ধদের সাথে বিষয়টি শেয়ার করতাম। ভালো মন্দ দু চারটে বিষয় নিয়ে আলাপ করতাম। এখন এই দুঃখ আমরা কার কাছে বয়ান করবো। আবার হাসিনার নিয়ে কিছু বললে ধরে নেবার ভয়তো আছেই।
তয় এই দেশে কোনো গণতন্ত্র নাই। আছে শুধু পারিবারিক ফ্যাসিবাদ। বাকশালের দিন আসতাছে। কিন্তু এবার বাকশাল শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তাগোর সঙ্গে এক সময়ের কথিত পিকিংপন্থি বামাস্যরা আছে।
কী আছে কপালে বুঝতে পারছি না। আসুন আমরা একটা দোয়া দিবস করি। যাতে আমাদের ওপর থেকে বালা মুসিবদ দূর হয়ে যায় কিনা।