somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাকড়সার জাল

২৯ শে জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৫:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জীবনটাকে অনেক ভালবাসতাম। অনেক স্বপ্ন ছিল জীবনে বড় কিছু হব। আমি চাইতাম মাকে নিয়ে বিশ্ব ভ্রমনে বেরিয়ে যাব। মা আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন। মাকে ছাড়া আমার দিন শুরু বা শেষ কোনটাই হয় না। মাকে নিয়ে আমার অনেক পাগলামি ছিল। ঘুম থেকে উঠেই মাকে জড়িয়ে ধরা কিংবা রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে তার কপালে আলতো চুমু, আসলে মা ছিল আমার দুনিয়া। কিন্তু একদিন আমার জীবনটা কেমন করে যেন হাত থেকে ফসকে গেল। ব্যাপারটা যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত।

মাকে মাঝে মাঝে কাঁদতে দেখতাম। সোফায় বসে টিভির ভলিউম বাড়িয়ে মা কাঁদত, যেন তার কান্নার শব্দ আমার কানে না আসে। মায়ের এই কান্নার কারন আমি বুঝতাম। বাবা প্রায়ই মাকে মারধর করত। বাবাকে মা কোনদিন ছাড়তে পারেনি, কারণটা সম্ভবত আমি। আমাদের সামাজিক রীতিনীতির উল্টো পথে মা হাঁটতে চায় নি শুধু আমার সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমি আর কোন ভাইবোন চাই নি, কেননা অত্যাচারিত মায়ের মুখচ্ছবি আর কেউ এসে দেখুক আর আমার মত কষ্ট পাক এটা আমি চাই নি। মাঝে মাঝে মন চেয়েছে মাকে নিয়ে সবার দৃষ্টির আড়ালে চলে যাই। জানি মা কোন দিন রাজি হবেন না। মাঝে মাঝে মনে হত, আমার এই অত্যাচারী বাবাকে অনেক ভালবাসে। আমি বুঝতাম না এ কেমন ভালবাসা!

বাবার প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা ছিল। তাকে যতোটা ভালবাসতাম তার চেয়ে বেশি সমীহ করে চলতাম। সঙ্গত কারনে তার সাথে খুব অল্প কথা হত। কিন্তু যখন থেকে আমি বুঝতে শিখলাম, যখন থেকে আমি মায়ের ব্যথা অনুভব করতে শিখলাম, আমার চোখ যেদিন দেখল আমার অত্যাচারী বাবার মুখচ্ছবি ঠিক সেদিন থেকে তার প্রতি সকল ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ নিমিষে ক্রোধ আর ঘৃণায় রুপ নিয়ে নিল। বাবার সবকিছু নীরবে সহ্য করে নিতাম শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে। আমাকে নীরব থাকতে হত, যদি একটু ক্রোধ প্রকাশ করতাম তবে মা আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিত। মাঝে মাঝে পাগলের মত লাগত, মায়ের কষ্ট কোন ছেলে সহ্য করতে পারে? যদি পালাতে পারতাম এত যন্ত্রণা থেকে! অনেক কিছুর ইচ্ছা ছিল, শুধু উপায় ছিল না।

ইউনিভার্সিটি'র শেষ কিছু দিন চলছিল। ইন্টার্নিশিপ শুরু করব, আমার গার্লফ্রেন্ডকে প্রপস করব, দুই বছর পর বিয়ে করব, সব পরিকল্পনা করা ছিল। মানহা শুধু আমার গার্ল ফ্রেন্ড না আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। ও ছিল আমার জীবনের কিছু খুশির মুহূর্ত। ওকে আর মাকে নিয়ে একটি সুন্দর সংসার গড়ে তোলার ইচ্ছে ছিল।

সেদিন দুপুর ২টা বাজে। বাসায় কেউ ছিল না। মা আমাকে না বলে বের হয়ে যেত না। একটু চিন্তিত ছিলাম, কারন মাকে ফোন করেও পাচ্ছিলাম না। আজকের ডিনারে মানহা ওর মা-বাবাকে নিয়ে আসবে। মা জানতেন, বাবাকেও মা বলেছিলেন। ভাবলাম মা বাজার করতে বেরিয়েছেন। টিভিতে হঠাত ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে, ঢাকায় সব চেয়ে বড় শপিং মলে জঙ্গি হামলা। নিহত ১০০০, আহত ২০০০! কেন যেন সব থেমে গেল। কিছু ভাল লাগছিল না। আমি মানহাকে কল করেও পেলাম না। ফোন বন্ধ পেলাম। মাকেও ফোন দিলাম কিন্তু তার ফোনও বন্ধ। ভাবলাম নেটওয়ার্ক সমস্যা।

হঠাত ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল। বাবা বেশি কিছু না বলে আমাকে হাসপাতালে যেতে বলল। হাসপাতালে পা ফেলানর জায়গা নেই। মলের সব আহত মানুষদের এই হাসপাতালে আনা হয়েছে। খুব মর্মান্তিক অবস্থা। রক্ত চারিদিকে, বাচ্চাদের কান্না। অনেকে ব্যাথায় ছটফট করছে। একটি রুমে অনেক গুলো স্ট্রেচার। বাবাকে দেখলাম হুইল চেয়ারে বসে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজ, পায়ে প্লাস্টার করান। কেমন যেন চুপচাপ বসে আছেন। কাছে গিয়ে উনার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা কি হয়েছে? বাবা কথা বলতে পারছিলেন না। চোখ দুটি রক্ত লাল। হঠাত বলে উঠলেন, তোর মা ওদিকে, যা দেখে আয়। মা?? মা এখানে কেন? কি বলছেন এসব? বাবা কিছু বললেন না।

ডাক্তার তার চেম্বারে নিয়ে বললেন মা এবং মানহার মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে শপিং মল থেকে। কেন যেন বিশ্বাস হল না। কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছু বলতেও পারছিলাম না, শুনতেও পারছিলাম না। হাত পা কাপছিল। মা আর মানহা পৃথিবীতে নেই। আমি তাদের দেখতে চাইছিলাম কিন্তু আমাকে মানা করা হল। পোস্টমর্টেমের পর মৃত দেহ পরিবারকে দেয়া হবে।

আমি চুপচাপ হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলাম। হঠাত ফোন আসল, আসসালামু আলাইকুম বস। মিশন সফল হয়েছে। আমাদের যে সকল ভাইয়েরা মারা গেছেন, সকলকে আল্লাহ জান্নাতে কবুল করুন, আমিন।

আমি আম্মান হোসেন, ঢাকার বিখ্যাত শপিং মলে সন্ত্রাসী হামলাকারী। আমি আমার জীবন, আমার মা আর মানহার হত্যাকারী। যদিও কখনও বুঝি নি যে আমি আমার মাকে হত্যা করব। এটাই নিয়ম, যাকে সারা জীবন ঘৃণা করে গেলাম তাকে চোখের সামনে দেখছি আর যাকে নিজের জীবনের চেয়ে ভালবাসতাম তাকে হত্যা করেছি।

এটা ছিল এক সাংবাদিককে লেখা আম্মান হোসেনর শেষ চিঠি । তিনি চেয়েছেন এই চিঠি এটা কোন সংবাদপত্রে ছাপান হয়। তিনি মানবতার সাথে যে অন্যায় করেছেন, যে মর্মান্তিক ভুল করেছেন তা অন্য কেউ যেন না করে। কেউ যেন নিজের কষ্টের জন্য অন্যকে কষ্ট না দেয়।

পরিবারের অশান্তি,বাবা মায়ের ঝগড়া, মারামারি, গালাগালি, বাচ্চাদের মনে গেঁথে যায়। বাচ্চারা নিজেদের দোষী মনে করে, নিজেদের ঘৃণা করতে শেখে অথবা তাদের মধ্যে ক্রধের জন্ম নেয়, তারা শবাইকে ঘৃণা করতে থাকে। আম্মান হোসেন তার বাবাকে একজন অত্যাচারী হিসেবে দেখেছে। তার মায়ের উপর অত্যাচার হত, কিন্তু সে কিছু করতে পারত না। তাকে বাধা দেয়া হত, তার কথা কেউ শুনত না। বাইরে থেকে দেখলে মনেই হবে যে তার জীবনযাপন ছিল সাধারণ কিন্তু সে নিজেকে এমন এক মাকড়সার জালে জড়িয়েছিল যেখান থেকে আশার আলো দেখতেন না। ছোট বেলার ঘৃণা কষ্ট মানসিক ভারসাম্যহীনতা আর বাবা মায়ের মধ্যে বিষাক্ত সম্পর্ক তার ব্যাক্তি জীবনে অনেক বড় প্রভাব পড়ল, তিনি পারলেন না সেখান থেকে উঠে আসতে। তিনি বেছে নিলেন সন্ত্রাসের পথ। সেই পথে তিনি যেমন হারিয়ে গেলেন তেমনি হারিয়ে ফেললেন তার ভালবাসার দুটি সত্তাকে।

মুল ভাবনা: সাদিয়া তাহসিন
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৫:৩৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×