পৃথিবীতে সবচেয়ে ভাল চাকরি বলতে কিছু নেই, যা আজকে আবুলের কাছে স্বপ্নের চাকুরী, মফিজের কাছে সেই চাকুরীর হয়তোবা কোন মূল্য নেই... এটাকে আমার অনেকটা খাবারের মেনুর মত মনে হয়। ধরুন আপনি একটি হোটেলে গেলেন সেখানে অনেক মেনু, পকেটে অনেক টাকাও আছে সবচেয়ে দামি খাবারটা অর্ডার দেওয়া আপনার জন্য কোন ব্যাপারই না, কিন্তু হতে পারে সবচেয়ে দামি খাবারটা আপনার একদমই পছন্দ না, সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আপনি তা অর্ডার করবেন না, যেটা পছন্দ/খেয়ে তৃপ্তি পাবেন সেটা অর্ডার করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ, তেমনি অনেক পড়াশুনা করার অর্থও অনেকটাই তেমন; যা আপনাকে আপনার পছন্দের জব বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দিবে। সবচেয়ে বড় কথা হল খাবারের ব্যাপারে সবার রুচি বোধ যেমন আলাদা, ঠিক চাকুরীর ব্যাপারেও... আমরা(বাঙালী) মাছ/মাংস পেলেই চেটেপুটে শেষ করি, যেখানে আমার অনেক ভারতীয় বন্ধুকে দেখেছি এগুলার গন্ধও শুকতে পারতোনা। আপনি হয়তো বলবেন অভ্যাস? কিন্তু আমি বাঙ্গালী; দুঃখজনক হলেও সত্যি ছোটবেলা থেকে ঘরে প্রতি বেলা মাছ রান্না হতে দেখেও মাছ খাওয়ার অভ্যাস আমার সেভাবে গড়ে উঠেনি, আমি না পারতে মাছ খাই, দিল্লীতে বাঙ্গালীরা যখন একটুকরো মাছের জন্য হাহাকার করত তখনো আমি মাছের(ইলিশ ছাড়া) জন্য তেমন টান অনুভব করিনি। কোন হোটেলে গিয়ে কবে আমি মাছ অর্ডার করে খেয়েছি মনে পড়ে না, মানে হল আমার হাতে অনেক অপশন থাকলে আমি মাছ খাই না, অথচ শতকরা ৮০ ভাগ বাঙ্গালীই প্রথম পছন্দ হিসেবে মাছকেই বেছে নিবে এবং নির্ঘাত আমাকে পাগল ভাববে। চাকুরীটাও এমন, সবার সব কাজ করতে ভাল লাগে না।
আমাদের দেশে যেখানে একটা চাকুরী পাওয়াই মুশকিল সেখানে আবার চয়েস ? কিন্তু এটাও ঠিক যে অনেক অপশন হাতে আছে এমন লোকেরও অভাব নাই, আমার মতে সেক্ষেত্রে অন্যের কথা না শুনে নিজের মনের কথা শুনাটাই সবচেয়ে ভাল, তাহলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। এবার কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক- আমার এক পরিচিত বড় ভাই দেশের বাইরে থেকে মাস্টার্স করে এসে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু এর মাঝে উনার বেশ ভাল একটা সরকারি চাকুরীও হয়ে যায় যেটা অনেকের জন্য স্বপ্নের চাকুরী, অতঃপর উনি পরিবার/ আত্মীয়স্বজনের কথা শুনে সে চাকুরীতে যোগ দিলেন, কিন্তু না, ওখানে প্রতিটাক্ষন উনার কাছে বিষের মত লাগতে লাগত, অতঃপর সরকারি চাকুরে ছেড়ে দিয়ে আবার ইন্টার্ভিউ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকেই বেছে নিলেন। আসলে কোন চাকুরীই ছোট/ খারাপ না, হাতে অপশন বেশি থাকলে সুযোগ সুবিধা কম হলেও নিজের পছন্দের চাকুরী করাটাই সবচেয়ে ভাল, কারণ সেটা আপনি ভালোবেসে করবেন তাই সেখানে দ্রুত উন্নতি করার সম্ভাবনাও অনেক বেশি। আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যাক- আমাদের এক স্যার উনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এবং পরে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়েও সেখানে ভর্তি না হয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং(সিএসই)-এ ভর্তি হয়েছিলেন, আজকে উনি সবার প্রিয় শিক্ষক। শিক্ষকতাতে উনি যতটা সফলতা পেয়েছেন, একজন ডাক্তার হিসেবে সেটা নাও পেতে পারতেন, কারণ সেটা উনার পছন্দের পেশা ছিলও না। একবার আমার এক বন্ধুর ছোট ভাই বুয়েট এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ দুটোতেই চান্স পাওয়াতে বেশ মধুর সমস্যায় পড়েছিলো তাদের পরিবার, আমাকেও জিজ্ঞেস করেছিল, বলেছিলাম ও যেহেতু পড়বে সিদ্ধান্তটা ওকেই নিতে দে, পরে সে বুয়েটে সিএসইতে ভর্তি হয়েছিলো, প্রতিবছর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী দুটোতেই চান্স পেয়ে এমন মধুর সমস্যায় পড়ে; কেউ তখন বুয়েট কে, আবার কেউ ঢাকা মেডিকেলকে বেছে নেয়, আবার বুয়েটে পছন্দের বিষয় না পেয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয় পেয়ে বুয়েট ছেড়ে চলে গেছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। আসলে যে ছাত্রের জীববিজ্ঞান পড়তে ভাল লাগেনা সে যেমন ভাল ডাক্তার হতে পারবে না, তেমনি যে ছাত্রের গণিত ভাল লাগেনা তার পক্ষের ভাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়াটাও কষ্টকর। পারিবারিক ইচ্ছাতে আমিও একসময় মেডিক্যাল কোচিং-এ ভর্তি হয়েছিলাম; কিন্তু যে সাবজেক্ট(জীববিজ্ঞান) পছন্দ করতাম না দেখে চতুর্থ বিষয় হিসেবে নিয়েছিলাম- সেই সাবজেক্ট নির্ভর কোচিংয়েও ভালভাবে মননিবেশ করতে পারিনি; অতঃপর যা হবার তাই হল; পরের বার সেই ভুল আর করিনি; তাই টার্গেট ঠিক করলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ভাল কোন সাবজেক্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং হলে বেটার। প্রথমে ভর্তি হলাম শের-এ বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এবং নতুন বন্ধুদেরকে ভাল লাগলেও কৃষি বিষয়টা একদমই ভাল লাগছিলনা, পরে নোবিপ্রবিতে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং পেয়ে দ্বিতীয়বার না ভেবেই চলে গেলাম, যদিও অনেকে বলেছিলো শেকৃবি থেকে পরবর্তীতে বিসিএস ক্যাডার হওয়া বা সরকারি চাকুরী পাওয়া সহজ; সত্যিই তাই- এবারও আমার অনেক শেকৃবি বন্ধু কৃষি, পুলিশ সহ আরও অনেক ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছে; কিন্তু আমার পছন্দের সাবজেক্ট পড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই ছিলও আমার জন্য সঠিক, এটা আমি এখনো বিশ্বাস করি, না হলে হয়ত আজীবন আফসোস করতাম।
এতো গেল অনেক অপশন থেকে একটা পছন্দ মত অপশন বেছে নেওয়ার কথা এবার আসি যদি অপশন না থাকে তাহলে? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক- আমার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়ভাইকে দেখেছি যিনি পাশকরে যেতে পারেননি, অথচ গণিত সহ সায়েন্স এর অনেক বিষয়ে উনার অসাধারণ দক্ষতা ছিল, কিন্তু সমস্যা একটাই ছিল উনি যে সাবজেক্ট (ফিসারিজ এন্ড মেরিন সায়েন্স)এ পড়তেন তা উনার ভাল লাগতো না!
তাহলে যার হাতে অপশন নেই সে কি তাহলে হাল ছেড়ে দিবে ? অবশ্যই না... বরং বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে, যা আছে তাই নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে... অথবা নিজের চেষ্টায় অপশন বানিয়ে নিতে হবে, আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যাক- আমার এক বন্ধু ফিসারিজ এ পড়ত, কিন্তু তার ধ্যান/ভালোলাগা সব ছিল কম্পিউটার সায়েন্স কেন্দ্রিক, সারাদিন কম্পিউটারে বসে নিজের মত কাজ করত/ কাজ শিখত, এবং ধীরে ধীরে তার শ্রমের দ্বারা সে খুব ভাল মানের গ্রাফিক্স ডিজাইনার হয়ে উঠল, থার্ড ইয়ার থেকেই সে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করে দিল এবং ভাল কাজও পেতে লাগলো... কোনমতে ফিসারিজ এর উপর অনার্স ডিগ্রীটাও কমপ্লিট করলো(যদিও সে এই রিলেটেড জব করবে না, কিন্তু ডিগ্রী-তো একটা দরকার), এর পর সে পুরো-দমে একজন ফ্রিল্যান্সার হয়ে উঠল, আমেরিকান একটা কোম্পানি তার কাজে এতটাই খুশী যে তারা তাকে আমেরিকাতে গিয়ে ফুল-টাইম জব করার অফার দিয়েছে, এখন সেই প্রসেসিং চলছে হয়তো কয়েক মাসের মধ্যেই সে চলে যাবে... । হাল ছেড়ে দেওয়া মানেই হেরে যাওয়া...
আমার কাছে বেস্ট জব ছিলও ক্রিকেটার হওয়া, এখনো আমার কাছে এটাই বেস্ট জব... কিন্তু আমি জানি সেই সুযোগ আর আমার হাতে নেই, তাই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই আমি পরের ধাপের ধন্য লড়ে যাচ্ছি; জানি না জয়ী হতে পেরেছি কি না, কিন্তু এই ভেবে খুশী যে অনেক অপশন তৈরি করতে পেরেছি, হয়তোবা প্রথম অপশনের জন্য হাহাকার করে হাল ছেড়ে দিলে আজ কিছুই পেতাম না ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১:৫৪