somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সূর্যগ্রহণ পূরাণ-নিম্নবর্গের প্রতিবাদ আর লড়াইয়ের ইতিহাস।

২২ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ১২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তারপর মথ্যমান সাগর থেকে চন্দ্র উঠলেন এবং ঘৃত থেকে লক্ষী, সুরা দেবী, শ্বেতবর্ণ উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব ও নারায়ণের বক্ষের ভূষণ কৌস্তুভ মণির উদ্ভব হ'ল। সর্বকামনাপূরক পারিজাত এবং সুরভি ধেনুও উত্থিত হোল। লক্ষী, সুরা দেবী, চন্দ্রও উচ্চৈঃশ্রবা দেবগণের নিকট গেলেন। অনন্তর ধন্বন্তরি দেব অমৃতপূর্ণ কমন্ডলু নিয়ে উঠলেন, তা দেখে দানবগণ '‌আমার আমার' ব'লে কোলাহল করতে লাগল। তারপর শ্বেতবর্ণ চতুর্দন্ত মহাকায় ঐরাবত উত্থিত হ'লে ইন্দ্র তাকে ধরলেন। অতিশয় মন্থনের ফলে কালকূট উঠল, সধূম অগ্নির ন্যায় সেই বিষ জগৎ ব্যাপ্ত হ'ল। ব্রহ্মার অনুরোধে ভগবান মহেশ্বর সেই বিষ কন্ঠে গ্রহণ করলেন, সেই থেকে তাঁর নাম নীলকন্ঠ।
দানবগণ অমৃত ও লক্ষী লাভের জন্য দেবতাদের সঙ্গে কলহ করতে লাগল। নারায়ণ মোহিনী মায়ায় স্ত্রীরুপ ধারণ ক'রে দানবগণের কাছে গেলেন, তারা মোহিত হয়ে তাঁকে অমৃত সমর্পণ করলে। তিনি দানবগনকে শ্রেণীবদ্ধ ক'রে বসিয়ে কমন্ডলু থেকে কেবল দেবগণকে অমৃত পান করালেন। দানবগণ ক্রদ্ধ হয়ে দেবগণের প্রতি ধাবিত হোল তখন বিষ্ণু অমৃত হরণ করলেন। দেবতারা বিষ্ণুর কাছ থেকে অমৃত নিয়ে পান করছিলেন সেই অবসরে রাহু নামক এক দানব দেবতার রূপ ধারণ ক'রে অমৃত পান করলে। অমৃত রাহুর কন্ঠদেশে যাবার আগেই চন্দ্র ও সূর্য বিষ্ণুকে ব'লে দিলেন, বিষ্ণু তখনই তাঁর চক্র দিয়ে সেই দানবের মুন্ডুচ্ছেদ করলেন। রাহুর মুন্ডু আকাশে উঠে গর্জন করতে লাগল, তার কবন্ধ(ধড়) ভূমিতে পড়ল, সমস্ত পৃথিবী কম্পিত হোল। সেই অবধি চন্দ্রসুর্যের সঙ্গে রাহুর চিরস্থায়ী শত্রুতা হোল। (মহাভারত সমুদ্রমন্থন পর্ব -অনুবাদ রাজশেখর বসু)

সেই থেকে আকাশে সূর্যগ্রহণ হয়। কিন্তু কে এই রাহু। ডোমরা পূজা করে তাকে। নিম্নবর্গের ইতিহাস বইটিতে তার উল্লেখ আছে। এই লিখার অনুপ্রেরণাও সেই বইয়ে রনজিৎ গুহের একটি অসুরের কাহিনী প্রবন্ধটি। এই সূর্যগ্রহণ সম্পর্কিত যে সমস্ত লোকজ সংস্কার সেগুলোও গ্রামেই বা নিম্নবর্গের আচারে দেখা যায়। এবং এই গ্রহণ যে ব্রাহ্মনদের সাথে বেয়াদপির কারণে দানবের হাহাকারের নিদর্শন তাই চর্চিত হয়েছে আমাদের পৌরাণিক জীবন যাপনে। সূর্যগ্রহন নিয়ে এমন বিশ্বাস ছিল যে তা জন্মদানকে বাধা গ্রস্ত করে। গর্ভবতী নারীর সূর্যগ্রহণ দেখা নিষেধ। বা এই সময়ে বাইরে যাওয়া নিষেধ-পানাহার নিষেধ। ভ্রূন অবস্থায় রয়েছে যে শিশু তার বাবা অথবা মা যদি সূর্যগ্রহণ দেখে তাহলে সেই শিশুর বিকলাঙ্গ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। এবং খুব প্রচলিত একটি শব্দ আছে রাহুগ্রস্ত হওয়া। অর্থাৎ যা কিছু সুশীলের চোখে গ্লানির এবং কুৎসিত তাই রুহগ্রস্ততা-সেই রাহুই সূর্যকে গ্রাস করে রাখে। কিন্তু ক্ষণিকেই আবার সূর্য আলো ছড়ায়-তার ঝলমলে আলোর অধিকার উচ্চবর্ণের। আর যতোসব অন্ধকার তার জন্যে দায়ি নিম্নবর্গ। মনুর বিধানে আছে- রাহু যখন গ্রহণকালে চন্দ্রের শুদ্ধতা হরণ করেছে, বিদগ্ধ ব্রাহ্মণের তখন উচিত নয় বেদ পাঠ করা। একইভাবে সূর্যগ্রহণকালে যেখানে সুর্যের আলো পড়বে সেই জায়গা অশুদ্ধ হবে। ফলে গ্রহণকালে কোন খfদ্যবস্তু রাখা যাবে না। গ্রহণ শেষে সব কিছু ধুয়ে আবার তৈরি করতে হবে।

রাহু যে নিম্ন বর্গীয় সত্ত্বা তার আরো বড়ো প্রমাণ আছে রামায়নে। ভিন্নভাবে-
রাবণ বিজয়ের পর থেকে লঙ্কা ফিরে রাম তার সেনাবাহিনীর জন্য এক ভেঅজের আয়োজন করেন। মহাদেব পার্বতীর উপরে ছিল পরিবেশনার ভার। এমন সময় নিম্ন জাতির এক মাঙ্গ বালকের উপস্থিতির প্রতি মহাদেব পার্বতীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন,.. এবং পার্বতীকে সতর্ক করে দেন, পরিবেশনের সময় তিনি যেন ছেলেটির থেকে যথোচিত দূরত্ব রাখেন। কিন্তু রাম যখন সেই মাঙ্গকে দেখতে পেলেন, তার দুঃসাহসিক অপরাধের জন্য রাম তাকে বধ করণে; কারণ সেই বালক নিজের অশুদ্ধ উপস্থিতিতে ভোজসভার পবিত্রতা খর্ব করতে চেয়েছিল। মৃত ছেলেটির মাতা তখন সন্তানের মস্তক একটি ডালায় স্থাপনপূর্বক বিশুদ্ধ জলের ছিটায় প্রাণসঞ্চারের বৃথা চেষ্টা করতে রাগল। হারানো পুত্রের মস্তকবাহী সেই ডালা নিয়ে সে গেল দেবদেবীর কাছে, নিজের খাদ্য ভিক্ষা চাইতে। পর্যায়ক্রমে গেল সে সূর্য এবং চন্দ্রের কাছে, ভয় দেখাল তাঁদের, বলল যদি অনুরোধ না রক্ষা হয়, সে চন্দ্র সূর্যকে স্পর্শ করবে, নষ্ট হবে তাদের শুদ্ধ চরিত্র। সেই ডালার ছায়াই গ্রহণের কারণ। সেই মাঙ্গনারী, অর্থাৎ সেই উত্যক্তকারী পাওনাদারের হাত থেকে রেহাই পেতে চন্দ্র সূর্যকে নৈবেদ্য দান এবং মাঙ্গদের ভিক্ষাদানের প্রথা চালু হল।(নিম্নবর্গের ইতিহাস, পৃ:৭৮)

দুটি পুরাণ নিয়ে রণজিৎ গুহের ব্যাখ্যাটাই পড়া যাক- মুন্ডুচ্ছেদের পরবর্তী ঘটনাবলী প্রথম কাহিনী থেকে দ্বিতীয় কাহিনীতে আলাদা। প্রথম আখ্যানে ছিল প্রতিশোধ স্পৃহা, কিন্তু দ্বিতীয় উপাখ্যানে প্রতিশোধ-প্রবণতার থেকে বড় হয়ে ওঠে বিচারের অন্বেষণ; বিচার খুঁজে ফেরে এক মা, যে হারিয়েছে তার সন্তানকে, হারিয়েছে নিজের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। প্রথম পুরাণে ছিল বিষ্ণুর দুই বার্তাবহ চন্দ্র-সূর্যের বিরুদ্ধে ফিরে ফিরে আক্রমণ, দ্বিতীয় কাহিনীতে দেখি দেবতাদের কাছে ভিক্ষাপ্রার্থণা অর্থাৎ ধরনা দেয়ার চিরাচরিত চেহারা। পরিবর্তনের এই পরম্পরায় রাহু মিলে যায় মাঙ্গ-এর সঙ্গে, মাঙ্গ-এর সামাজিক অস্তিত্বই আরোপিত হয় রাহুতে।

নিম্নবর্গের আধ্যাত্মিক চর্চাকে আত্মীকৃত করার শাসক বা উচ্চবর্গীয় প্রচেষ্টা সবসময়েই ছিল। ফলে ডোমের দেবতা তাদের কাছে অসুর বা মাঙ্গদের সন্তান তাদের কাছে অশূচ। মনসাও তাই। তবে মনসার প্রেক্ষাপট ভিন্ন, কারণ এই মতে বিশ্বাসীদের সংখ্যা এবং সংগঠিত অবস্থান মনসাকে কিছুটা হলেও উপরের আসনে রেখেছে। শীবের কন্যা স্বিকৃতি পেয়েছে মনসা-সনাতন হিন্দু ধর্মে। যদিও পার্বতীর গর্ভ লাভ হয়নি মনসার। কিন্তু মনসার ইতিহাস বিচারেও নিম্নবর্গকে নাই করে দেয়ার অপচেষ্টাকে বুঝা যাবে। এবং এই ইতিহাস মনসাকেও রাহুর সমান্তরালে দাঁড় করায়।

শ্রী আশুতোষ ভট্রাচার্য তার মনসামঙ্গল নামক সংকলন গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন-
এখন দেখিতে হয় পশ্চিম-ভারতের 'মনসা' নামটি কখন হইতে জাঙ্গুলী দেবীর পরিবর্তে ব্যবহৃত হইতে আরম্ভ হয়। পূর্বেই বলিয়াছি জাঙ্গুলির সঙ্গে বৌদ্ধ সমাজের সম্পর্ক ছিল, তিনি তান্ত্রিক বৌদ্ধ দেবী ছিলেন। পাল রাজত্বের অবসানে সেন রাজত্বের যখন প্রতিষ্ঠা হইল, তখন এদেশে বৌদ্ধ ধর্মের বিলোপ ও তাহার স্থানে হিন্দুধর্মের পুনরাভ্যুত্থান হইয়াছিল, সেই সময়ে যে সকল বৌদ্ধ দেবদেবীকে নুতন নাম দিয়া হিন্দুসমাজের মধ্যে গ্রহণ করা হইয়াছিল, এই সর্পদেবী তাহাদের অন্যতম। বৌদ্ধ সংস্রবের জন্য তাঁহার জাঙ্গুলী নাম পরিত্যাক্ত হয় এবং তাহার পরিবর্তে মনসা নামকরণ হয়। বাংলার পূর্বোক্ত অর্বাচীন পুরাণগুলি ইহার কিছুকাল মধ্যেই রচিত হয় এবং তাহার ম্যধ দিয়া মনসাকে শিবের কন্যারুপে দাবী করিয়া হিন্দু-সমাজের মধ্যে গ্রহণ করা হয়।

এভাবেই নিম্নবর্গের ইতিহাসকে বিকৃত ও দখল করা এবং নিম্নবর্গকে দমনের উচ্চবর্গীয় চর্চা আজকের এই সূর্যগ্রহণ কালেও স্মরণযোগ্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিস্মায়াভূত মনে হয়তো কখনোই সেই রাহুর হুহুঙ্কার অথবা সন্তান হারা মাঙ্গ নারীর ক্রন্দন বেজে উঠবে না। তবুও সেই মহাকালের আকাশেও একজন রাহু আর অপবিত্র সন্তানের জননী তাদের লড়াই চালিয়ে যাবেন। আজকের এই সূর্যগ্রহণ কালেও নির্মম বাস্তব রণজিৎ গুহের কথাগুলো-

অমৃতের ভোজসভায় সেই মুন্ডুচ্ছেদেই বা কবেকার কথা? আজ আমরা দাঁড়িয়েছি আমাদের সময়ের সঙ্গে, আমাদের পদক্ষেপ হয়তো ততখানি নিশ্চিত নয়, যতখানি নিশ্চিতি আছে আমাদের আকাংক্ষায়, তবু সেই পদক্ষেপ আজ নিজেদের অভিজ্ঞতার ভূমিতে। .............কিন্তু আজকের পূরাণের মূল চরিত্র আর দেবতা দানব নয়, মূখ্য ভূমিকা আজ জনগণের। পৌরানিক কাহিনীর কেন্দ্রে ছিল অমৃতের প্রতিযোগীতা; সে লড়াইয়ের চেহারা বদলে গেছে; আজকের প্রতিযোগীতা মানুষের জীবনধারনের উপযোগী সব পার্থিব সম্পদের মালিকানা নিয়ে।

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ১:১৩
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×