ছোট্টবেলায় আমার সবচাইতে কাছের বন্ধুটির কোলে বসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুমি আমার কয় বছরের বড়?” তিনি আমার এরকম বেয়াড়া প্রশ্নে একটু হকচকিয়ে গেলেও হেসে ফেলে বললেন, “২৭ বছর।” সেই থেকে জানলাম, আমার সবচাইতে নির্ভরতার আশ্রয়টির সাথে আমার বয়সের ব্যবধান মাত্র ২৭ বছর। আমার পরম সৌভাগ্য তার সাথে আমার বন্ধুত্ব জন্মসূত্রে। আমার এই বন্ধুর একটি বিশেষত্ব হল-তিনি আ্মার কাছে হারতে ভালবাসেন। মনে আছে, যখনই বাসায় কোন নতুন বই কেনা হত, বাবা বইটা এনেই আমার হাতে দিয়ে বলতেন, "এই বইটা তুমি যদি আগে পড়ে ফেলতে পার, তাহলে এটাতে তোমার নাম লিখে দেব।" চ্যালেঞ্জের সেই শুরু। বলা বাহুল্য, আমিই জিততাম। একের পর এক বইয়ে আমার নাম লেখা হত। আমা্র কালেকশন বেড়েই চলত। আমি ভাবতাম, বাবা আমার সাথে প্রতিযোগিতায় পারলেন না। কী আনন্দ! সেদিনের ছোট্ট শ্যামা জানত না যে তার প্রতিযোগীটি জিততে মোটেও আগ্রহী নয়। পরাজয়েই তার আনন্দ।
আমার জন্য কোন বই নিষিদ্ধ ছিল না। লাইব্রেরির প্রতিটা বই আমি নির্বিচারে পড়তে পারতাম। একবার বাবা বাসায় আনলেন সুনীলের “ছবির দেশে কবিতার দেশে” বইটা। বাবা আমাকে দেখানোর আগেই আমি উল্টেপাল্টে দেখে নিয়েছিলাম। ফরাসী শিল্পীদের আঁকা অনেক ন্যুড ছিল তাতে। স্বীকার করি, ক্লাসে ফোরে পড়া শ্যামা সেদিন বইটা দেখে যত না অস্বস্তিতে পড়েছিল, তার চেয়ে বেশি তার মধ্যে আগ্রহ জেগেছিল। বইটা আরো ভাল করে দেখার আগ্রহ। বাবা যথারীতি সেদিনের কেনা সবকটা বই আমার হাতে দিলেন। বিশেষ করে ওই বইটা দিয়ে বললেন, “এই বইটা পড়লে তুমি ফরাসী আর্ট সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে। আমি তো পড়ার সময় পাই না বেশি। তুমি পড়, আর কী পড়লে সেটা আমাকে গল্প করে শুনিয়ো। আমি তোমার কাছ থেকে শিখতে পারব। বাবা আমার কাছ থেকে শিখবে! ব্যস, আমাকে আর পায় কে? সোৎসাহে পড়তে শুরু করলাম। প্রতিদিন চোখ বড় বড় করে তাকে শিল্পী পল সেজান, রেনোয়া, কামিল পিসারোদের স্ট্রাগলের গল্প শোনাতাম। ঘুনাক্ষরেও সেই মুহুর্তে বুঝি নি, ভদ্রলোক কী সুকৌশলে আমার ফোকাসটা শিফ্ট করে দিয়েছেন।
নিন্দুকেরা বলে, আমি নাকি এই মানুষটার প্রশ্রয়েই বাঁদর থেকে বাঁদরতর হয়েছি। সেই নিন্দুকদলের প্রধান হলেন আমার মা। অবশ্য নিন্দা করার কারণও আছে। পৃথিবীতে কোন বাবা তার সন্তানকে স্কুল ফাঁকি দিতে উৎসাহ দেয় না। ব্যতিক্রম আমার বাবা। আমি পুরো ইউনিফর্ম পরে রেডি। জুতোর ফিতে বাঁধছি। বাবা বলে উঠতেন, “আজ আর স্কুলে যাস না, মা। আজ আমার ছুটি। তুইও বাসায় থাক।” ওই কথাটা শুনে আমার আহ্লাদ এবং মায়ের রাগ- দুটোই বাঁধনছাড়া হয়ে যেত।
হাইস্কুলে ওঠার পর থেকে আমি আর জন্মে কোনদিন ফার্স্ট হই নি। আমার মায়ের দু:খের শেষ ছিল না। তার ধারণা, বাবার প্রশ্রয়েই আমার এই অবস্থা। মায়ের অভিযোগের চোটে বাবা আসলেন আমার পড়ার খোঁজ নিতে। এসে দেখলন, আমি তখন “জগৎ জীবন দর্শন” নামে একটা বই পড়ছি। অথচ ঠিক দশদিন পরে আমার ক্লাস সিক্সের বার্ষিক পরীক্ষা। বাবা খুব বকলেন। বললেন, “দেখ, এটা খুব বাড়াবাড়ি। এই বই পড়ে তুমি তো এখন কিছুই বুঝবে না। অযথাই সময় নষ্ট না করে ক্লাসের পড়া পড়। আমার চোখ ফেটে জল আসল। বাবা কোনদিন আমাকে কোন বই পড়তে মানা করেননি। অথচ সেদিন কীনা আমার বোধশক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন! আমার নীরব কান্না দেখে বললেন, “তুই যদি আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারিস, কী পড়েছিস, তাহলে তোকে আর কিছু বলব না।” ভাগ্য ভাল, আমি তখন লাইবনিজের মোনাডতত্ত্বটা মাত্রই শেষ করেছিলাম। যতটুকু পারি, বুঝিয়ে বললাম। Credit goes to Aminul Sir। অসম্ভব সহজ করে লিখেছিলেন। বাবা চুপ হয়ে গেলেন। বললেন, আমি সরি। তুই পড়। আমি আর কখনো কিছু বলব না।” বলা বাহুল্য, সেদিন বিজয় গর্বে আমি যত না খুশি হয়েছিলাম, তার চাইতে বেশি খুশি হয়েছিলেন পরাজিত মানুষটি।
আজকালকার ছেলেমেয়ে জন্মেই স্মার্টফোন দেখে। আমার জেনারেশনে ও জিনিস ছিল না। টিভিতে টেলিফোন নামে একটা বস্তু দেখতাম। ওটা দিয়ে নাকি কথা বলা যায়। চুয়াডাঙ্গার এক অজপাড়াগাঁয়ের তিন বছর বয়সী ছোট্ট মেয়েটি মাসের পর মাস তার ঢাকায় থাকা বাবার সাথে কথা বলার এক বিকল্প পথ বের করেছিল। একটা গাছের লতা ছিল একদম টেলিফোনের তারের মত। ওই লতা আর দুটো কাঠি দিয়ে সে বানিয়েছিল নিজের টেলিফোন। মা বাবাকে চিঠি লিখে এই কথা জানিয়েছিলন। সেবার বাবা একটা লাল রঙয়ের খেলনা টেলিফোন এনেছিলেন আমার জন্য। এর পর থেকে ওই খেলনা ফোনটা হাতে নিয়ে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে যেতাম। যখন জানতে চাইতাম- বাবার কথা শুনতে পাচ্ছি না কেন? মা বলতেন, “তুমি না পেলেও বাবা তোমার কথা শুনতে পাচ্ছেন।
বাবাকে স্মার্টফোন কিনে দেওয়ার দিন ঘটনাটা মনে পড়ল। আজ আমি নিজে নেক্সাস ৫ ব্যবহার করেও সেই লাল ফোনটার মত নিষ্পাপ আনন্দ পাই না।
মেয়ে হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, বাবাকে একসময় সন্তান হিসেবে পাওয়া যায়। আমার সন্তানসম বাবাকে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা।