somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপেক্ষার অবসান ( ছোট গল্প )

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চাকুরীর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অনেকটা বাধ্য হয়েই অবসর নিয়ে নেয় কমলগঞ্জ কে বি পাইলট হাই স্কুলের ইংরেজির সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মাহাতাব উদ্দিন । স্কুলের কাজে শিক্ষাবোর্ডে আসতে গিয়ে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে অনেকদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল মাহাতাব । জমানো টাকা যা ছিল তার সবটা চিকিৎসা ব্যয়েই চলে যায় উপুর্যপুরি স্ত্রীর গহনা বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করতে হয়েছিল । সেই সময় স্কুলের নিজস্ব তহবিল থেকে নামমাত্র অর্থ সহযোগিতা মিললেও তা ছিল করুণারই নামান্তর । তাঁর এমন খারাপ সময়ে পাশে খুব কাছের আত্মীয় স্বজনরা ছাড়া আর কেউ ছিল না ।
মন ব্যথায় ভরে উঠেছিল মাহাতাবের । সুস্থ হয়ে ফিরে সরাসরি চাকুরী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ।
ফিরে আসবার সময় কেউ একটিবারও জিজ্ঞেস করেনি কেন চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন, এক তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছাড়া । স্কুল কমিটির কেউ এসে সমবেদনা জানায়নি । এমন কি হাসপাতালে গিয়ে একটি মুহূর্তের জন্যে দেখে আসবার প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ !
কথা গুলো ভাবলেই চোখের কোণে অনাহূত জল ঝাপসা করে দিয়ে যায় চারপাশ । তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে মাহাতাবের । ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে নিজেকে এই পেশাটি কেন বেছে নিয়েছিল এই মনে করে । যেদিন চলে আসে শেষবারের মতো স্কুল থেকে, সেদিন প্রিয় ছাত্র ছাত্রীরা ঘিরে ধরে ছিল তাঁকে । কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েছিল । সে এক আবেগঘন মুহূর্ত । নিজেকে সেদিন সামলাতে পারেনি মাহাতাব । নয়ন জলে বুক ভাসিয়েছিল । অনেক সহকর্মীর চোখও ভিজে উঠেছিল সেদিন ।

মাহাতাব এখন বাড়িতে টিউশানি করে চলে । আয় বলতে এখন এটিই । ইংরেজির শিক্ষক হলেও ছাত্র ,ছাত্রী বেশি নেই । এখন চারপাশে অনেক শিক্ষক, গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টার; তাই আগের দিনের মতো ছাত্র ছাত্রীরা কোন নির্বাচিত শিক্ষকের উপর নির্ভরশীল নয় । তাদের ইচ্ছায়ও কিছু হয়না । মা-বাবা তাঁদেরকে বেছে দিচ্ছেন শিক্ষক, কোচিং সেন্টার গুলো । এখন যে শিক্ষক বাঙলা পড়ায় সে-ও সমাজ বিজ্ঞান, ইতিহাস পড়িয়ে কামাই দ্বিগুণ করে নিচ্ছে । যে গণিতের শিক্ষক সে সাথে ইংরেজিটাও পড়িয়ে দিচ্ছে । মানের প্রশ্ন আগে নয় পরে । টু ইন ওয়ান অথবা থ্রি ইন ওয়ান ! অভিবাবকেরা চায় চাকচিক্য । ভেতরে কি আছে আর সন্তানেরই বা কতটুকু উপকারে আসবে তা যাচাই বাছাই না করে ছুটে যাচ্ছে এই পথে ।

ছাত্র ছাত্রী কম তবুও নিষ্ঠার সাথে পড়িয়ে যায় মাহাতাব । টিউশানির টাকায় সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যায় সে । অবসরসুবিধার টাকার জন্য আবেদন করেছে আজ প্রায় দুই বছরের উপরে কিন্তু হাতে টাকা আসেনি । কিছুদিন পরপর খোঁজ নিতে রাজধানীতে যায় কিন্তু ফিরে আসে আশাহত হয়ে। নিজের টাকা চায়তে গিয়ে রীতিমতো হয়রানির শিকার ।
মাহাতাব উদ্দিনের সংসার চলে কোনমতে । খেয়ে পড়ে সমান । তবুও আশা অবসরসুবিধার টাকা তুলে কিছু একটা করে খাবে । স্বপ্ন দেখতে থাকে মাহাতাব । এর মাঝেই বড় মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ আসে । নীলাকে দেখতে এসে ছেলে পক্ষের খুব পছন্দ হয়ে যায়। বিয়ের তারিখ পাকা করতে পারেনা মাহাতাব । কেমন করে পাকা করবে ? হাতে যে কোন টাকা নেই । সময় চায় ছেলে পক্ষের কাছ থেকে । সময় দ্রুত ফুরায়, বিয়ের তারিখও আর পাকা করতে পারেনা । একসময় পাত্র পক্ষ আর অপেক্ষা করেনা । অর্থাভাবে বিয়ের তারিখ পাকা করতে না পেরে কষ্টে বুক ভারি হয়ে যায় মাহাতাবের । জীবনে এমন সংকট দেখা দেবে তা কোনদিন ভাবেনি । জীবনের প্রতি কেমন যেন মায়া হারিয়ে ফেলে ।

যখন একা থাকে তখন তাঁর ভাবনায় আসে শুধু হতাশা আর হতাশা । মনে পড়ে দাদা’র কথা। মাহাতাব যখন ক্লাস নাইনে প’ড়ে তখন দাদা বলেছিলেন বড় হয়ে যেন মাহাতাব শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেয় । অনেক সম্মান শিক্ষকতায় । অনেক মহৎ একটি পেশা এটি । এমনটিই বলত দাদা । মানুষ গড়ার কারিগর মানুষের মনে আলো জ্বালে । সমাজকে আলো দেয় এমন কথা বলে মাহাতাবের ভেতরে তোলপাড় করে দিত দাদা । মাহাতাবও স্বপ্ন দেখত বড় হয়ে একদিন সে শিক্ষক হবে । হয়েছেও তাই । যদিও দাদা শুনে যেতে পারেনি, দেখে যেতে পারেনি নাতির স্বপ্ন, সফলতার কথা । মাহাতাবের মেধা অনুযায়ী সে অনায়াসে অন্য কিছু হতে পারত শিক্ষক না হয়ে ।

নীলার বিয়ের বয়স যদিও পেরিয়ে যায়নি তবুও মাহাতাব উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী চেয়েছিল ভাল সচ্ছল পাত্রের হাতে মেয়েটিকে তুলে দিতে । আরও কিছুদিন পর আরেকটি সম্বন্ধ আসে এবং যথারীতি নীলাকে পাত্র পক্ষের পছন্দ হয়ে যায় । এবার মাহাতাব কোন কিছু চিন্তা, ভাবনা না করেই বিয়ের তারিখ পাকা করে ফেলে । পড়ে তাঁর স্ত্রী বলে- ‘’কি হল তোমার কেমন করে জোগাড় হবে এত টাকা ?’’
মাহাতাব উত্তর দেয় না বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে । ছুটে যায় বাধ্য হয়েই এলাকার সিরাজ মিয়া কাছে, যে সুদে টাকা ধার দেয় । সিরাজ মিয়ার কাছ থেকে টাকা পেতে হলে কিছু না কিছু গচ্ছিত রাখতে হয় । শুধু মুখ দেখে, সম্পর্কের খাতিরে টাকা দেবার মতো লোক নন সিরাজ । কিন্তু মাহাতাবের ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয়তা প্রদর্শন করে । শিক্ষক তাছাড়া একজন ভাল মানুষ বলে সিরাজ মিয়া ছাড় দেয় । মাহাতাব সোনা গহনা নয় সিরাজ মিয়ার কাছে গচ্ছিত রেখে আসে সারা জীবনের সম্মান ।

নীলার বিয়ের দিনই ঢাকা যেতে হয় মাহাতাবকে অবসরসুবিধার টাকা তোলবার জন্য । মাহাতাব আর তাঁর স্ত্রী’র মুখে হাসি ধরা দেয় অনেকদিন পর । আজ বেশ লম্বা সময়ের পর বাড়িটি আনন্দে,হইচইয়ে মুখতির হয়ে উঠে । মাহাতাবের মনটা খারাপ হয়ে যায় মেয়ের বিয়ের দিন উপস্থিত থাকতে পারবেনা বলে । কিন্তু কিছুই করার নেই । যেতেই হবে-যায়ও । মাহাতাব উদ্দিনের ঢাকা যাবার আগে এর ওর কাছে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যায় যাতে করে কোন অসুবিধা না হয় । বিয়ে সুষ্ঠু ভাবেই সম্পন্ন হয় । কথা ছিল বিকেল নাগাদ বাড়ি পৌঁছে যাবে মাহাতাব কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয় ভাব কিন্তু পৌঁছে না ।
দুপুর থেকে মাহাতাবের মোবাইলে কল করে বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে । বাড়িতে বিয়ের আনন্দে অনেকেই ভুলে যায় মাহাতাব উদ্দিনের কথা । কিন্তু, মেয়ে নীলা আর তার মা অধীর অপেক্ষায় থাকে মাহাতাবের ফিরে আসবার । বিয়ে শেষে কনের বিদায়ের মুহূর্তে দূর থেকে একটি এম্বুল্যান্সের শব্দ ভেসে আসে । ঘড়ির কাঁটা যত এগিয়ে যায় শব্দটি তত কাছে আসতে থাকে । মুহূর্তের মধ্যে এম্বুল্যান্সটি মাহাতাবের বাড়ির গেটের বাইরে এসে থামে যেন সকল সমাপ্তির প্রতীক হয়ে ।

এম্বুল্যান্সের গায়ে ‘লাশবাহি’ লেখাটি দেখে সবাই কেঁপে ওঠে । মাহাতাবের স্ত্রীর পায়ের নীচে যেন মাটি সরে যায় । মুহূর্তেই অনাবিল আনন্দের শব্দ গুলো বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে নামিয়ে আনে বিউগলের করুণ সুর । অপেক্ষার অবসান ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ভেতর দিয়েই ।
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×