এখন ভর্তি পরীক্ষার মৌসুম চলছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে হাজার হাজার পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছে। মাত্র ১ টা আসনের জন্য যুদ্ধ করছে একসাথে প্রায় অর্ধশতাধিক পরীক্ষার্থী। যেখানে বাকি ৪৯ জনকে পরাস্ত করে ১ জন সৌভাগ্যবান সেই আসন দখল করে। কিন্তু তার পরের ইতিহাস অত্যন্ত করুণ! যে একটা আসনের জন্য এত যুদ্ধ(!), এত হৃদয়ে রক্তপাত(!!) সেই আসনটাকে অনেক ক্ষেত্রেই পদদলিত করতেও আমাদের বিবেকে বাঁধে না! বিভিন্ন নামীদামী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেই দেখা যায় "খুব একটা ভাল সাবজেক্ট পাই নাই" অথবা "যে সাবজেক্ট পাইছি সেটা পড়ার কোন ইচ্ছা নাই" ইত্যাদি ইত্যাদি এরকম আরও অনেক ফালতু যুক্তি দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ ক্লাস করে না এবং পরের বছর অন্য কোথাও পড়ার জন্য পরীক্ষা দেয় । ভাবার কারণ নাই এখানে পরীক্ষার্থী নিজের ইচ্ছায় এমনটা করছে। যদি নিজের ইচ্ছার গুরুত্ব দিয়ে বিবেকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে এমনটা করত নিঃসন্দেহে সেটা যৌক্তিক হত।
আমাদের দেশে নিজে বিষয় নির্বাচন করার ক্ষেত্রে ‘শিক্ষার্থী কোনটা পড়তে চায়’, 'কোন বিষয়টার প্রতি তার আগ্রহ রয়েছে' এসব চিন্তা করা হয় খুব কমক্ষেত্রেই । বরং আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীরা এক্ষেত্রে পিতামাতার অত্যন্ত বাধ্যগতই বটে! পিতামাতার ইচ্ছা সন্তান ইঞ্জিনিয়ার হবে , ব্যাস... সন্তানও কোন প্রকার আপত্তি ব্যতিরেকেই তাদের উপরে অপরের চাপিয়ে দেওয়া ইচ্ছা পূরণে ব্যতিব্যাস্ত হয়ে যায়। তা সে গনিতে যতই কাঁচা হোক না কেন, অঙ্ক কষতে গিয়ে যতই কলম কামড়ে ভাঙ্গুক না কেন! আর নইলে পৃথিবীতে আর একটা পেশাই বাকি আছে, ডাক্তার! ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার অপশন এই দুইটাই। হ্যাঁ, "তোমাকে ডাক্তার হতেই হবে"। তা সে বায়োলজির 'ব'ও যদি না বুঝে তবুও। আর একটা আশীর্বাদ তো আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থায় ঐতিহাসিকভাবেই স্থান দখল করে নিয়েছে, ‘মুখস্থ’। এখানে প্রশ্নকরাকে নিরুৎসাহিত করা হয়, আর যে জানতে চায়, বুঝতে চায় এবং প্রশ্ন করে, সে হয় হাসির পাত্র। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসে একটা কথা...... "এত বুঝে কি করবা? বারবার টিয়া পাখির মত আওড়াও আর খালি মুখস্থ না ঠোটস্থ কর। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তুমি হবেই।" থাক সে কথা অনেক জ্ঞানী ব্যাক্তিরা এগুলা অনেক আগেই বলে গেছেন এবং খুব একটা লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না। "আমার বাপ দাদা করে আসছে, এত সহজেই সেই ঐতিহ্য..... ।" আরও অনেক কারণ আছে..... এই বিষয় না হোক আজ বাদই থাক।
যাই হোক , এবার আসি বাপ মা ঠিক কেন চান তাদের পুত্র কন্যা ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ার ই হবে। অর্থ, যশ, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি... এইতো! আর আছে এক ধরনের প্রতিযোগিতার অসুস্থ মানসিকতা। অমুকের ছেলে/মেয়ে ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার, আমার সন্তান যদি না হয় তাইলে মুখ দেখাব ক্যামনে? আরেকটা বিষয়...... বাবা, মা হয়ত খুব বড় কিছু হতে পারেন নাই। তাদের স্বপ্ন থাকে তাদের ছেলেমেয়ে তাদের ব্যর্থতাকে দূর করবে, তাদের নিজেদের স্বপ্ন সন্তানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে চান তারা। তা তারা করতেই পারেন, কিন্তু এতে যে একজনের স্বপ্নদেখার ক্ষমতাই তারা নষ্ট করছেন, তা কি তারা কখনও একটিবারের জন্যও ভেবে দেখেছেন?
এবার আসি 'ভাল সাবজেক্ট পাই নাই' ব্যাপারটাতে। আমরা জাতি হিসেবে অত্যন্ত অলস কিন্তু লোভী এবং স্বার্থপর জাতি। আমরা বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে অতি সহজেই শ্রেণীবিভাগ করে ফেলি। যেহেতু আমরা নিজেদের ইচ্ছার বিষয়ে কোন প্রকার মাথা ঘামাই না তখন সেক্ষেত্রে প্রথমেই আসে কোন সাবজেক্টের জব ফিউচার কেমন...... জব মার্কেটে ডিমান্ড কেমন। আমরা দেখি ডিপার্টমেন্ট কতটা সুপ্রতিষ্ঠিত এবং অতীতে কোন সিনিয়র কত ভাল পজিশনে আছেন, যাদের কারণে ডিপার্টমেন্ট এত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমরা এটা ভাবি না আমরাই একটা ডিপার্টমেন্টকে উপরে তুলতে পারি। আমরা চাই সবকিছু আমাদের জন্য করা থাকবে, আমরা শুধু সুবিধাভোগ করব। আমরা উদাহরণ তৈরি করার কথা ভাবতে শিখি নাই শুধু উদাহরণ দিতে শিখেছি। কারণ ঐ যে আমাদের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা তো আগেই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। শুধু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এ দুটো পেশা ছাড়াও পৃথিবীতে অনেক পেশা আছে। যার কোনটার গুরুত্বই একফোঁটা কম না। বিষয়টাকে মন থেকে ভালবাসাটাই বড় ব্যাপার। তাহলেই ঐ বিষয়ের প্রতি ভালবাসা-টানই শত হতাশা, বাঁধার পথ ডিঙিয়ে সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দিবে। তোমার যদি পড়ার ইচ্ছাই না থাকে তবে কেন ভর্তি হলে, একটা মূল্যবান আসন দখল করলে?
এবার আসি আসল কথায়। প্রতি বছর বিভিন্ন নামিদামী বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে দেখা যায় তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হয় এবং ক্লাস শুরুর প্রথম থেকেই ভাল না লাগায় পরের বছর ভাল যায়গায় ভর্তি হব এই চিন্তা করে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে।ডিপার্টমেন্ট ভিত্তিক ঐ দলে । ০.৫-১০০% ছাত্রছাত্রী থাকে। আমি নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ডিপার্টমেন্টে ৫০% এরও অধিক ছাত্রছাত্রী ঐ দলে যোগ দিয়েছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ, ৩৩ আসনের বিপরীতে ৭ জন শিক্ষার্থী বর্তমানে ক্লাস করে (GEE'11 ব্যাচ, শাবিপ্রবি)।
শুনেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন এক ডিপার্টমেন্টে এভাবে চলতে চলতে একেবারেই শূন্য হয়ে গিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয় এবার(২০১৩-১৪ সেশন) প্রত্যেকটা বিষয়ের জন্য আলাদা পরীক্ষার আয়োজন করে। এই দৃশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নামীদামী প্রকৌশল , প্রযুক্তি বা কৃষি সব বিশ্ববিদ্যালয়েই। সময় যত যায় ঐ দল তত ভারী হতে থাকে। যাদের পিছনে রাষ্ট্র বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দেয়। কেউ কেউ সফল হয়। কেউ কেউ ব্যর্থ। যারা সফল হয় তারা ভর্তি বাতিল করে সুড়সুড় করে সটকে পরে। আর ব্যর্থরা ব্যর্থতার চাপে হতাশার সাগরে হাবুডুবু খায় নয়ত নতুন করে শুরু করার প্রচেষ্টা চালায়। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে খেটে খাওয়া প্রত্যেকটা মানুষের টাকায়। কুলি, মজুর, কৃষক প্রত্যেকটা সাধারণ মানুষের টাকায়। সেই টাকায় পড়ালেখা করে ঐসব স্বার্থপর মানুষগুলা যারা একটা বারও চিন্তা করে না আমি আরেকজনকে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করলাম, যে হয়ত তার মত ধনীর দুলাল না। ঐসব খেটে খাওয়া মানুষের সন্তান। যে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশকে কিছু দিতে পারত। আর সেখানে স্বার্থপর মানুষগুলা দিবে কি, তাদের চিন্তায় যে শুধুই নিজের চিন্তা, ঐসব কুলি মজুরদের কথা চিন্তা করার মত সময় তার নাই। যদিও তাদের টাকায় পড়লেখা করে সে নিজের আখের গুছানোর চিন্তা করে।
কথায় কথায় দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সুযোগ গ্রহণকারী এক বন্ধুকে কিছু কথা শুনিয়ে দিতেই তার ঝটপট উত্তর, "চোরকে চুরি করতে দিলে তো সে করবেই"। কথা ঠিক । কারণ আমাদের বিবেক বলে যে জিনিসটা ছিল সেটা অনেক আগেই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আর তাই কোন প্রকার অপরাধ বোধও আজকাল তৈরি হয় না। অনেকটা চোরের মতই।
ব্যাপারটা অনেকটা ভালোর জন্য সুযোগ দেওয়া এবং সেটার সর্বোচ্চ অপব্যাবহার করা। এই বিষয়টার দিকে নজর দেওয়াটা জরুরি। যেখানে ভর্তির সুযোগের জন্য হাহাকার সেখানে অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে বঞ্চিত করে রাষ্ট্রের জন ও অর্থসম্পদ এভাবে নষ্ট করার কোন মানে হয় না। এজন্য কিছু পরিবর্তন অতি সত্তর খুবই দরকার।
ব্যাপারগুলো এমন হতে পারে......
১। একজন শিক্ষার্থী কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত যত খুশি ততবার পরীক্ষা দিতে পারবে। তবে কোন এক যায়গায় ভর্তি হলে পাস করে বের হবার আগে আর পরীক্ষা দিতে পারবে না।আপনি কি ইচ্ছা করলেই বুয়েটে ২ য় বার পরীক্ষা দিতে চাইবেন? চাইবেন না। কারণ সুযোগই নেই। আপনি চাইলেও পারবেন না। তেমনি ভর্তি বাতিলের অপশন না থাকলেই ভর্তি বাতিলের চিন্তাও আপনি করবেন না। আর পছন্দ মত সাবজেক্ট না পেলে প্রথমবার ভর্তি হবেন না। পরেরবার পরীক্ষা দিবেন।নইলে বাবা মায়ের টাকা থাকলে প্রাইভেটে পড়বেন। আরেকজনকে সুযোগ বঞ্চিত করার অধিকার আপনার নাই।
২। মাইগ্রেশনের নিয়মটাকেও আরও বেশি যুগোপযোগী করা উচিৎ। যেন পরীক্ষার্থীর পছন্দের সাবজেক্ট নেওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়।
৩। শিক্ষার্থী যে বিষয়ে পড়তে ইচ্ছুক সেই বিষয়ের উপর বাস্তবমুখী পরীক্ষার ব্যাবস্থা করা। সেখানে শুধু লিখিত এবং জ্ঞানমূলক পরীক্ষার বদলে পরীক্ষার্থীর সত্যিকার মেধার মূল্যায়ন করার মত প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা যাচাইয়ের ব্যাবস্থা অবশ্যই থাকা উচিৎ।
৪। সকল বিশ্ববিদ্যালয় , প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় , প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে একই (একটা নির্দিষ্ট) সময়ের মধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু এবং সম্পন্ন করা উচিৎ। ঐ সময়ের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী একাধিকবার ভর্তি বাতিল করতে পারবে কিন্তু একই সময়ে প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় পরে আর নতুন করে ভর্তি বা ভর্তি বাতিল করতে পারবে না। প্রশ্নের মান আরও উন্নত ও গতানুগতিক ধারার বাইরে বাস্তবমুখী ও সৃজনশীল করা সম্ভব হলে মেডিকেল কলেজগুলোর মত সকল বিশ্ববিদ্যালয়/ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় / প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় / কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আলাদা আলাদাভাবে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যার এবং আরও অনেকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা গ্রহণের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছিলো, যা কতিপয় সচেতন নামধারী অদূরদর্শী মানুষের বাঁধার মুখে বাতিল হয়ে যায়। সমস্যা হল আমরা পরিবর্তন ভয় পাই এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলি, নেতিবাচক পরিবর্তনগুলো অবশ্য সহজেই গ্রহনীয় এবং দ্রবনীয়। ভুল স্থানে ভুল মানুষ তো আছেই।
হ্যাঁ পরিবর্তন একদিন হবেই। তবে সেটা কেন আজকেই নয়। শুধু দরকার প্রত্যেকের জায়গা থেকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি আর মানসিকতার পরিবর্তন আর একফোঁটা করে চেষ্টা......