শুনেছি এবার সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার একটা সম্ভবনা দেখা দিয়েছে, যা গত বছর অনেক জল ঘোলা করে বাদ দেওয়া হয়েছিল। আমি যেহেতু নিজেও এই পদ্ধতির পক্ষেই ছিলাম তাই শুনে আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর নিজ মুখে এধরনের আভাস পাওয়ায় উল্টা কেমন যেন ভয় লাগা শুরু করল।
প্রথমত, অতীত অভিজ্ঞতা বলে এদেশে শিক্ষার উন্নয়নের নামে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর বেশিরভাগই পরবর্তীতে ভয়াবহ রূপে প্রতীয়মান হয়েছে, তা সেটা যতই যৌক্তিক এবং যুগোপযোগী হোক না কেন।
আমাদের দেশে যখন ঘুণে ধরা ব্যাবস্থা বা নিয়মকে পরিবর্তন করে যুগোপযোগী এবং বাস্তবমুখী করার চেষ্টা করা হয় তখন অনেক নীতিনির্ধারক সহ একটা বড় অংশ সেটার সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান নেন। এটা যে তারা নতুন নিয়মটাকে খুব একটা বুঝে তারপর করেন, এমনটাও না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেটা হয়, সেটা হল তাদের ভেতর পরিবর্তনের প্রতি একধরণের ফোবিয়া(ভীতি) কাজ করে।
যাই হোক পরবর্তীতে কি ভেবে যেন তারা বিষয়গুলো মেনে নেন। এবং দেখা যায় তারা সেগুলোকে নিজেদের মত করে এমনভাবে বদলে দেন যাতে নিজেদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইত্যাদি বিভিন্ন দিক ঠিক থাকে কিন্তু ওই পরিবর্তনের আসল উদ্দেশ্য থেকে তো দূরে সরেই যায়, উপরন্তু ব্যাপারটা আগের চেয়েও খারাপ অবস্থায় চলে যায়।
একটা উদাহরণ দেই। সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে সত্যি অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম ঘুণে ধরা মুখস্থ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা দূর হবে, সত্যিকার অর্থেই সত্যিকার শিক্ষা নেবে, চিন্তাশীল হতে শিখবে, শেখার প্রতি সত্যিকার আগ্রহ তৈরি হবে, সবচেয়ে বড় কথা বইয়ের পড়াগুলোকে বাস্তবমুখী উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে শিখবে।
কিন্তু বাস্তব আসলে তেমনটা হল না। এই পদ্ধতিটাকেও অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের হাতিয়ার বানানো হল।
সরকার এই পদ্ধতিটাকে প্রতিষ্ঠা করল এই ভেবে যে, এতে করে কোচিং বানিজ্য বন্ধ হবে, গাইড বইয়ের ব্যবসা বন্ধ হবে। সেটা সরাসরিও করা যেত, কিন্তু সরাসরি বন্ধ করার কোন শক্ত পদক্ষেপ এখনও পর্যন্ত নিতে দেখিনি।
যাই হোক, সরকার এই পদ্ধতি চালু করল, কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালল, ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করল। তবে আদতে খুব বেশি কিছু হল না। জানি এই পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হতে শিক্ষক-ছাত্র সকলেরই কিছুটা সময় লাগবে। কারণ এই পদ্ধতিতে একজন শিক্ষককে অনেক বেশি চিন্তাশীল হতে হয়, আরও বেশি দক্ষ ও পরিশ্রমী হতে হয়। কথাটা দৃষ্টিকটু লাগতে পারে, তবে কথাটা ভুল না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওইধরনের মেধার মানুষগুলো শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হতে চান না। এর প্রধান কারণ, এই পেশায় বাড়তি কিছু না করলে পেট চলার ব্যবস্থা নাই। এক সময় অনেক বেশি সম্মান ছিল এই মহান পেশায়। কিন্তু নানা কারণে সেই সম্মানও আজ নাই।
আর বর্তমান শিক্ষকগনও আগের সেই পদ্ধতি থেকে একেবারে বের হয়ে আসতে পারলেন না। তাই পাঠদান পদ্ধতিতে খুব একটা পরিবর্তন আসলো না ওই প্রশ্ন পদ্ধতি ছাড়া। আর প্রশ্নকরাটাও সহজ করে দিল গাইড বই গুলি। আর অনেক শিক্ষক ধরে নিলেন যেহেতু সৃজনশীল তাই যেখান থেকে ইচ্ছা, যত কঠিন ইচ্ছা প্রশ্ন করা যাবে। শিক্ষকগণ সেখান থেকে প্রশ্ন করেন, উত্তরগুলোও হয়ত সেখান থেকেই নেওয়া নয়ত নিজে একটা তৈরি করে নিলেন আর বাকি সব ভুল। আগেই বলেছি সৃজনশীল পদ্ধতিটার একটা অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের মুক্ত চিন্তার বিকাশ, শেখার সত্যিকার আগ্রহ তৈরি করা। এমন কোন বিষয় যেটা পরবর্তী কোন উচু ক্লাসে আলোচনা করা হবে সেটাকে টেনে নিচের ক্লাসে নিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসকে নামিয়ে দেওয়া না। এতে করা যেটা তৈরি হল, সেটা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উল্টো ভয় ঢুকে গেল। ফলাফল, ভালো করার আশায় আবার সেই কোচিং নইলে স্যার এর বাসা আর গাইড বই তো আছেই।
ছবিঃ সৃজনশীল গাইডের খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ!
ছবিঃ সৃজনশীল শারীরিক শিক্ষা বইও বাদ যায় নাই!
আর আমাদের অভিভাবকরা আজকাল আগের চেয়ে বেশি সচেতন! অন্তত সন্তান কিছু শিখুক বা নাই শিখুক, তারা ভালো ফলাফল করুক এটা সবাই চায়।
কিন্তু বোর্ড পরীক্ষা গুলোতে কী হবে? এটাও কোন সমস্যা না। প্রশ্ন ফাঁসের হার তো আর শুধু শুধু এতটা বাড়েনি। আর তাছাড়াও না বুঝেও যা ইচ্ছা তাই পরীক্ষার খাতায় লিখে দিয়ে আসে। “তারা তো ফেইল করতে পরীক্ষা দেয় না”। তাই লিখলেই নম্বর পাওয়া যায়।
তারা প্রতিবছর রেকর্ড সংখ্যক পাস করে। A+ এর বন্যা হয়। আর উনারা বুক ফুলিয়ে বলেন তাদের সরকার শিক্ষার মান বাড়িয়ে আকাশে উঠিয়ে ফেলেছেন। সরকার বদল হলেও এই ধারার বদল সম্ভব না। এতে যে তাদের ইমেজ নষ্ট হবে, ভোটের বাজারেও ঘাটতি পড়বে। তারা মনে করেন, সবকিছু এভাবে ম্যানেজ করে চলতে পারলে ক্ষতি কি? আমজনতা খুশি, অভিভাবক খুশি, আগামীর ভবিষ্যৎ ছাত্র ছাত্রীরা খুশি, ক্ষতি কি?
ঝামেলা বাধায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাগুলো। তারা ফাঁস করা প্রশ্নে চাইলেও ভর্তি করাতে পারে না। কারণ আসন সংকট। প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ A+ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী পাস করে এদের চাইলেও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করে নেওয়া যাবে না। তাই তারা এমন প্রশ্নই করেন, যাতে কোন এক বিভাগে মাত্র ২ জন ভর্তি হবার যোগ্যতা অর্জন করে। শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যার সরাসরি বলেই ফেলেছেন যে, ঢাবির প্রশ্নও গাইড এবং সে হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় অনেকটা মুখস্থ নির্ভরও।
ঠিক একারনেই সমন্বিত ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে আমার কিছুটা আপত্তি আছে। ২০১৩-১৪ সেশনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবারের মত সমন্বিত পদ্ধতিতে অভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তথাকথিত কতিপয় সচেতন নামধারী অদূরদর্শী মানুষের বাঁধার মুখে বাতিল হয়ে যায়।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে এটা শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি অনেক অংশে কমিয়ে দেবে, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় প্রতিদিনই ছুটাছুটির ক্লান্তি, খরচ এবং ভোগান্তি থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিবে, সময় বাচাবে। তাই এ পদ্ধতির বিরোধীতা করার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু আমার এক বন্ধুর একটা যৌক্তিক প্রশ্নে আটকে গেলাম। জোড়ালো উত্তর পেলাম না।
তার কথার বিষয়বস্তু ছিল এমন যে, এক এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ধরন এক এক রকম। এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী শিক্ষার্থী বাছাই করে তাই প্রশ্নও নিজেদের মত করেই সাজায়। এজন্য দেখা যায় প্রশ্নের ধরনেও ব্যপক তারতম্য দেখা যায়। কোথাও শুধু বহু নির্বাচনী, কোথাও লিখিত ও বহু নির্বাচনী দুইটাই হয়ে থাকে। যদি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একই প্রশ্ন করা হয় তখন ব্যপারটা কেমন হবে?
সত্যি বলতে কি, প্রশ্নের মানের বিষয়টাও তখন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। একটা ছোট্ট উদাহরণ, সাস্টের প্রশ্নের ধরণ অন্যান্য যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে আলাদা। এবং এটা শিক্ষার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অনেক শিক্ষার্থী, যারা গতানুগতিক ওই মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার কল্যাণে ভালো GPA না থাকায় অনেক বিশবিদ্যালয়ে পরীক্ষাই দিতে পারেনি, আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি তারা এখানে ওই গতানুগতিক ধারার বাইরের প্রশ্নের কল্যনে সমাদৃত হয়।
আর ভয়টা সেখানেই। সমন্বিত পদ্ধতিতে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে এই মান কি অক্ষুণ্ণ থাকবে?
আমি সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতির বিরোধিতা করছিনা। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে নেওয়ার ক্ষেত্রে এধরণের সমস্যাগুলো সমাধানের কথা মাথায় রেখেই সিদ্ধান্তে আসা উচিৎ। প্রশ্নের মান আরও উন্নত ও গতানুগতিক ধারার বাইরে বাস্তবমুখী ও সৃজনশীল করা সম্ভব হলে সকল (সাধারণ) বিশ্ববিদ্যালয়/ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় / প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় / কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে মেডিকেল কলেজগুলোর মত আলাদা আলাদাভাবে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। এতে ভিন্নধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য প্রশ্নের ধরনও হয়ত ঠিক থাকবে। আর দীর্ঘমেয়াদি সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া ওই সৃজনশীল পদ্ধতির মত হুট করে চালু করার ফলে আসল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করে কোন মহল যেন এই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাকেও অর্থ আয়ের বা রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে করতে না পারে সেটাও লক্ষ্য রাখা উচিৎ। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস অনেক শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার সত্যিকার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে এবং নিজেদের সেই অনুযায়ী তৈরি করছে। তারা যখন এই শিক্ষাব্যবস্থার হাল ধরবে তখন সামগ্রিক চিত্র অবশ্যই বদলে যাবে।
পরিশেষে আরেকটা কথা, আমরা বাঙ্গালীরা স্বভাবতই দলকানা ধরনের হয়ে থাকি। মানে, যে পক্ষকে সমর্থন দেই তার বিপক্ষে কেউ কথা বললেই তার বিরোধীতা করি। তাই একটা সমস্যা ধরিয়ে দিলে নিজেকেই অনেক সময় উল্টা তাদের কাছেই সমস্যায় পরিণত হতে হয়। এজন্য আগেই বলে রাখি। আমি এখানে শুধু নিজস্ব চিন্তা প্রসূত ধারনায় সবটুকু লিখেছি। আমার বুঝা বা জানায় ভুল থাকতে পারে। থাকলে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য সাদরে আমন্ত্রণ রইল। এজন্য অগ্রীম ধন্যবাদ।
লেখা-
সৈয়দ মুক্তাদির আল সিয়াম
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়