ছোটবেলায় আমার প্রতিভায় আমার বাবা-মা প্রায় মুগ্ধ ছিলেন। সব বাবা মারাই তাই থাকেন। তাই ছেলেমেয়ে হাক ছেড়ে কাঁদলেও তাদের মনে হয় তাদের সন্তান বুঝি ভবিষ্যতে লতা মঙ্গেশকর কিংবা আর ডি বর্মন হবে। আমার বাবা মাও তাই ছোটবেলায় আমার আঁকাআকির প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ধরে নিয়েছিলেন যে পিকাসো তাদের ঘরে আবার জন্ম নিয়েছেন। আমার আঁকাআঁকির প্রতিভা সীমাবদ্ধ ছিলো তখন কেবল ক্যালেন্ডারের পেছনের পাতার সাদা অংশটুকুতে। এবং আমি কেবলই জাহাজ আঁকতে পারতাম। ঠিক জাহাজও না, আসলে ছোটখাটো লঞ্চ টাইপ কিছু একটা। তখন আমরা বরিশাল থাকতাম, আর মাঝে মাঝে বাবা মা’র সাথে লঞ্চে করে ঢাকা আসতাম। তখন আমার মনে হতো আহারে, আমি যদি দিনরাত সবসময় লঞ্চে থাকতে পারতাম। ডাক্তার ইঞ্জিয়ার কিছু না, আমার একমাত্র এইম ইন লাইফ ছিলো লঞ্চের সারেং হওয়া। তো, আমার বাবা মা আমার ক্রমাগত লঞ্চ একে যাওয়া দেখে মুগ্ধ। আমি বসে বসে লঞ্চ আঁকি, আর তারা সেই লঞ্চ আঁকা ক্যালেন্ডার আঠা দিয়ে দেয়ালে লাগিয়ে রাখেন। আমার আঁকা লঞ্চে আমাদের ছোট্ট ঘরের সব দেয়াল ভর্তি হয়ে যায়।
আমার এক মামা ছিলেন , তার নাম বাদল মামা। তিনি মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় চলে আসতেন ঢাকা থেকে। এসে বেশ কিছুদিন থাকতেন। তার একটা অসাধারন গুণ ছিলো, একটানে তিনি পাখি আঁকতে পারতেন। তাই আমি তার ভয়ানক ভক্ত ছিলাম। তার কাছে থেকে একটানে পাখি আঁকা শেখার জন্য কতকিছুই না আমি করেছি। দুপুরবেলা খেয়ে দেয়ে তিনি উপুর হয়ে ভাতঘুম দিতেন। এবং আমার কাজ ছিলে তার পিঠের উপর হাঁটাহাটি করা। এতে নাকি তার আরাম লাগতো। আমি ক্রমাগত হাঁটাহাটি এবং দৌড়াদৌড়ি করে যেতাম। যদি মামা আমাকে একটানে পাখি আঁকাটা শিখিয়ে দেন । তিনি আরও একটা জিনিস করতেন, তা হলো কোথা থেকে বড় বড় বোতল নিয়ে আসতেন। সেসব বোতলের গায়ে একরঙা লেবেলে লেখা থাকতো "সাধনা ঔষধালায়"। তিনি খুব রোগা পটকা ছিলেন বলে দিনরাত সেই সব ঔষধ গিলতেন একটু স্বাস্থ্যবান হবার জন্য। বড় বড় গ্লাসে নাক মুখ কুঁচকে ঢকঢক করে সাধনা ঔষধালয়ের ঔষধ গিলতেন আর আমাকে স্বাস্থ্য সম্পর্কে জ্ঞান দিতেন। আমাকেও মাঝে মাঝে তার সাথে সেসব খেতে হতো। আমি মুখ বুজে এসব যন্ত্রনা সহ্য করে যেতাম কেবল যদি একবার তিনি আমাকে একটানে পাখি আঁকাটা শিখিয়ে দেন।
একবার মনে আছে হঠাৎ করে মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দেখি সবাই খুব দৌড়াদৌড়ি করছে। একটু ধাতস্থ হয়ে বুঝলাম, ঘরে সাপ ঢুকেছে। আমি তো ভয়ে অস্থির। একটু পরে দেখি আমার রোগাপটকা মামা সাধনা ঔষধলয়ের ঔষধের গুনেই হোক বা অন্য কিছু, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সাপের বারোটি বাজিয়ে দিয়েছেন। একটা লম্বা লাঠিতে সেই মরা সাপ টাঙ্গিয়ে রাখা হলো আমাদের বারান্দায়। সাপ-টাপ মেরে মামার মেজাজ বেশ খুশ মনে হলো, তিনি গুন গুন করে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গাইতে হাক দিলেন, "ভাগ্নে কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে আয়"। আমি তাড়াতাড়ি করে দেয়ালে টানানো বর্তমান মাসের ক্যালেন্ডারটা খুলে নিয়ে দৌড় দিলাম। মনে আছে সেই রাতে মামা আমাকে একটানে পাখি আঁকা শিখিয়েছিলেন। সেই থেকেই আমি ঢাকা-বরিশালের লঞ্চের বাইরে অন্য কিছু আঁকা শুরু করি।
এর কিছুদিন পর আমরা ঢাকা চলে আসি। আমার আঁকাআঁকিতে মুগ্ধ হয়েই মনে হয় আমাকে শিশু একাডেমিতে ভর্তি করে দেয়া হয়। আমার বাবা মা’র আয় খুব বেশী ছিলো না। তারপরও তারা আমার শিল্পী প্রতিভার বিকাশে খুব চেষ্টা করে গেছেন। তখন আমাকে প্রতি শুক্রবার আমার নিজের চেয়ে দেড়গুন বড় একটা ড্রইং বোর্ড নিয়ে শিশু একাডেমীতে যেতে হতো। সেখানে সবাই অনেক ভালো ভালো রং এর সেট আর নানা মাপের তুলি নিয়ে যেতো। আমাকে কিনে দেয়া হতো বারো টাকা দামের ছোট একটা রংতুলির বক্স। সেখানের রংগুলো একটু ব্যাবহারেই শেষ হয়ে যেতো। তুলিটাও খুব খসখসে ছিলো। তারপরও আমি শিশু একাডেমীর মেঝেতে হাটু গেড়ে ছবি একে যেতাম। কখনো পাশের জনের কাছ থেকে একটু রং ধার চেয়ে নিতাম আমার রং শেষ হয়ে গেলে। চাইতে লজ্জ্বা হতো, কিন্তু কিছু করার নেই। হয়তো পুরো ছবিটা এঁকে ফেলেছি, কিন্তু শুধু মাত্র নীল রং শেষ হয়ে গেছে বলে আমার আমার ছবির আকাশটা সাদা রয়ে গেছে। শিশু একাডেমিতে আমাদের যে টিচার ছিলেন, তিনি কোন একটা কারনে একহাতে একটা ক্রাচ নিয়ে খুঁড়িয়ে হাটতেন। তিনি এসে প্রতিদিন নানা রকম কথা বলতেন, বলতেন এই রং এর সেট যেন আর পরের দিন নিয়ে না আসি। সবার সামনে আমার খুব কান্না পেতো। খুব কষ্ট করে নিজেকে আটকে রাখতাম। মনে আছে তখন নিউমার্কেটে রংবিতান বলে একটা দোকান ছিলো যেখানে পোষ্টার কালার পাওয়া যেতো। এক একটা রং এর কৌটার দাম ছিলো দশটাকা। বেসিক রংগুলো সব কিনতে গেলে আর সেই সাথে কমপক্ষে দুই মাপের তুলি কিনতে গেলে তখন একশ টাকা লেগে যেতো। যেটা হয়তো আমাদের পক্ষে কেনা খুব কষ্টকর হতো।
একবার রং শেষ হয়ে যাওয়ায় আমাকে শিশু একাডেমীতে আঁকতে দেয়া হলো না। সেদিন ফিরে এলাম। পরের দিন আমার বাবা কোথা থেকে জানি কয়েক কৌটো রং কিনে আনলেন। তিনি তো আর জানেন না যে তিনি ভুল করে অয়েল পেইন্টিং এর রং কিনে এনেছেন। আমিও বুঝি নি। সেই রং নিয়ে পরের দিন গেলাম শিশু একাডেমীত। রং দিয়ে আঁকতে গিয়েই বুঝে গেলাম কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। যতই পানি দিচ্ছি , রং কিছুতেই পানিতে মিশছে না। ভেসে থাকছে। এদিকে আমারদের খোড়া টিচার এগিয়ে আসছে। তার ক্রাচের শব্দ এগিয়ে আসছে। ঠক ঠক ঠক। হয়তো তিনি আজকে আমাকে সবার সামনে এমন কিছু বলবেন যে আমি সবার সামনে কেঁদেই ফেলবো। আমি প্রাণপণ রং-এ পানি মিশিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু রং কিছুতেই পানিতে মিশছে না। আমার চোখ ভিজে উঠছে , আর আমাদের খোড়া টিচারের ক্রাচের শব্দ এগিয়ে আসছে। ঠক ঠক ঠক।
পরিশেষ: সেদিন আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। আমার বাবা খুব অপরাধী মুখ করে আমাকে নিয়ে নিউমার্কেটে গিয়ে একসেট রংতুলি কিনে দিয়েছিলেন। আজ নেট ঘাটতে ঘাটতে এই ছবিটা দেখে সেই সবদিনের কথা মনে পরে গেলো। তাই অনেকদিন পর আবার ব্লগ লিখে ফেললাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০৮