এ আয়োজনটির কথা আমি প্রথম জানতে পারি সম্ভবত ২০০৩ বা ২০০৪ সালের দিকে। সে সময় ভোরের কাগজে কাজ করি। তখন শুনলাম একদল তরুণ থার্টিফার্স্ট বা নিউ ইয়ার সেলিব্রেট করেছে সেন্ট মার্টিনসে। সে বিষয়ে ফিচার ছাপা হল পত্রিকায়। এ ঘটনার কিছুদিন আগেই পড়েছি হুমায়ূন আহমেদের দারুচিনি দ্বীপ। কেমন জানি সে বইটির ঘটনার সঙ্গে বেশ মিল দেখেছিলাম। কিছু সংখ্যক তরুণ-তরুণী নববর্ষ পালন করতে যাচ্ছে যেন প্রাণের তাগিদে। ওই সময়টি ঢাকার গুলশান এলাকা ছিল থার্টি ফার্স্ট নামের এক আতঙ্ক। সে তুলনায় সূর্য উৎসব বিষয়টি মনে হচ্ছিল তারুণ্যের আসল চেহারা। মনের কোথায় যেন একটু আফসেসও লাগল। মনে হল আহ্ আগে জানলে যাওয়া যেত।
এর পর আবারো একই ঘটনা। সূর্য উৎসব হলো, পত্রিকায় ফিচার ছাপা হলো। তারপর আফসোস, আহারে আগে যদি জানতাম...
একবার দেখলাম এরা উৎসব পালন করবে বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্তর প্রান্তে, মানে তেতুলিয়া। ওইবার নিজ থেকেই বাদ দিয়েছিলাম। উত্তরবঙ্গের শীত খুবই খতরনাক জিনিস। আমি ঢাকা থেকে ময়মনসিং শীতকালে গেলে রাতে দাঁত ঠকঠক করে। থাক, আমার তেতুলিয়ার থার্টিফার্স্ট, তারচেয়ে আমার পাড়ায় মনিরদের ছাদে স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে বারবিকিউ অনেক ভালো।
এইবারো এরা যাচ্ছে। এবার ঠিক হয়েছে থার্টিফার্স্ট আর নতুন বছরের প্রথম সূর্য দেখা হবে সুন্দরবনে গিয়ে। অফিসের একটি পিসিতে দেখলাম সূর্য উৎসবের পোস্টার ইমেজ আকারে। আমার ধারণা ছিল এবারো উৎসব ওয়ালারা নিউজ পাঠিয়েছে প্রেস রিলিজ যাতে আমরা প্রকাশ করি।
আমাদের ফিচারে তৃষা নামে একজন আছে, ফিচার ফটোগ্রাফার। সে বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টের ছবি তুলে অফিসে ফেরার পর আমাকে দেখায়। ছবি নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়। এবার সে পোস্টারটি আমাকে দেখিয়ে বলছে, বিপুল ভাই, দেখেন তো সব্যদা (পরে জেনেছিলাম ইনি সব্যসাচী হাজরা) কী দারুণ একটা পোস্টার করে দিলো।
আমিও দেখলাম পোস্টারটি যথেষ্ট স্মার্ট। তৃষাকেই জিজ্ঞেস করলাম এ উৎসবের আয়োজক কারা। সে গোল গোল চোখে আমার দিকে বিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, আপনি জানেন না? আমরাই তো আয়োজন করি! অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে।
আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। কারণ দুটি। এক হলো, এই তৃষা মেয়েটি অফিস করে, ছবির অ্যাসাইনমেন্টে বাইরে যায়, সংসার সামলায়, পাঠশালায় ফটোগ্রাফির গ্র্যাজুয়েশন করছে, সেই ক্লাস করে, সেখানকারও অ্যাসাইনমেন্ট থাকে। এতোকিছু করার পর সে আবার সূর্য উৎসব আর্গানাইজ করছে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো যে সূর্য উৎসবের জন্য এতোদিন অপেক্ষা করেছি, সেই উৎসবে আমার পরিচিত লোকজনই এখন অর্গানাইজার। তাও আবার কোথায়? সুন্দরবন।
এর আগেও কয়েকবারই সুন্দরবনে যাবার দিনক্ষণ ঠিক হয়েছিল। চাঁদার টাকাও দিয়েছিলাম, পরে ক্যানসেল করি একবার বাবার চোখের অপরেশনের দিনটি একই সময়ে পড়ে যাওয়াতে। আরেকবার ম্যাপ ফটো এজেন্সির ফটোগ্রাফার মাহমুদ বললেন, 'আমি আগামী মাসে সুন্দরবনে যাবো। আপনি যাবেন? থাকতে হবে কিন্তু নদীতে। আর নিজেদের কাজগুলো কিন্তু নিজেদেরই করতে হবে। এসবে যদি অভ্যস্ত হন তবে যেতে পারেন।' আনন্দে লাফ দিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু শেষে উনার সুন্দরবন যাওয়ার দিনক্ষণ বদলে যায়। আর যাওয়া হয়নি।
এবার আর কোনো ঝামেলা এখন পর্যন্ত নেই। ছুটি ম্যানেজ করা যাবে। ৪ দিনের টুর। ফটো তোলা যাবে ইচ্ছে মতো। ঢাকা থেকেই লঞ্চে রওনা হবে দলটি, ফিরবেও লঞ্চে। তার মানে পুরো ভ্রমন হবে বিকট হর্ন বা ধুলাবালি মুক্ত পরিবেশে। লঞ্চের ছাদে নাচগানেরও ব্যবস্থা থাকবে বলে শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে পরিষ্কার আকাশ টেলিস্কোপ দিয়ে বিভিন্ন তারা আর গ্রহ দেখার আয়োজন, আর বিশেষ আকর্ষণ দুই বা সুন্দরবনের ভেতর ট্রেকিং, মানে গাইডেড টুর।
কখনো যেখানে যাইনি, সে সুন্দরবন আমার জন্য কোন কোন ছবি সাজিয়ে বসে আছে জানি না। গিয়ে কী দেখতে পাবো তাও জানি না। নদীর বুকে রাত কাটানো হয়নি কখনো। সে বিষয়টি কেমন রোমাঞ্চকর কে জানে। প্রায় একশ জনের মতো যাচ্ছে। হয়তো নতুন বন্ধু হবে, হয়তো হবে না। লঞ্চে মোবাইল লাইন দিয়ে ইন্টারনেট কানেকশন কেমন হবে কে জানে। ফেসবুক, সামহয়্যারইন পাওয়া যাবে তো। এমপিথ্রি প্লেয়ার, ব্যটারি কিনে রাখতে হবে। রাতে পড়ার জন্য কোন কোন বই নেব? এমন বই নিতে হবে যেটি আমার মনমতো হবে, কিন্তু বইয়ের ওজন হবে কম। যতো ভাবি, ততো মনে হচ্ছে সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে।
দিন বাকী আছে আর মাত্র ৪টি। এবার কোনো ঝামেলা না হলেই বাঁচি।