somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শেখ মিজান
অন্যায় অপশক্তির বিরুদ্ধ্যে সোচ্চার কন্ঠধ্বনি, মুক্তবাক, স্বাধীন চিন্তা, প্রগ্রেসিভ রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে সামাজিক বৈপ্লবিক পরির্তন চাইযুক্তিহীন কথা মূল্যহীন। কিছু কিছু লোক আছে যারা অযুক্তিক অসত্য কথা বলে বেড়ায়। এদের কথার মূল্য খুবই কম। যুক্তি যু

সুন্দরী নারী সাংবাদিকের ‘ফাঁদ’এবং আইএস কমান্ডার

০২ রা এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০১৪ সালের এপ্রিল'এর শুক্রবার। রাত তখন ১০টা।

সিরিয়ার এক আইএস কমান্ডার ফাঁদ পাতে ওই নারী সাংবাদিককে চতুর্থ স্ত্রী বানানোর। সেই ফাঁদ ও পাল্টা ফাঁদের গল্প বলেছেন স্বয়ং ওই সাংবাদিক অ্যানা এরেল তার ‘স্কিন অব অ্যা জিহাদিস্ট’ বইয়ে। বিদেশী সাময়িকী থেকে তার সংক্ষিপ্তসার করেছেন আফরোজা খানম।



আমি আমার এক রুমের অ্যাপার্টমেন্টে সোফায় বসে ছিলাম। এ সময় আমার ফেসবুকে মেসেজ এলো : ‘সালাম আলাইকুম, সিস্টার। দেখলাম, আমার ভিডিওটা তুমি দেখেছো। এটা ভাইরাল হয়েছে। তুমি কি মুসলিম?’

একজন সাংবাদিক হিসেবে ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগদানকারী ইউরোপিয়ান আইএস সদস্যদের নিয়ে স্টাডি করছিলাম অনেক দিন থেকে। বুঝতে চাচ্ছিলাম, কী এমন আছেন যা একজন মানুষকে সর্বস্ব, এমনকি জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করার মতো সাহসী করে তোলে!
অন্য অনেক সাংবাদিকের মতো আমারও একটি ফিকশনাল (বেনামি) ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। এর সাহায্যে আমি সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর নজর রাখি। ওতে আমার প্রোফাইল পিকচার হিসেবে দেয়া আছে ডিজনি মুভি ‘আলাদিন’-এর প্রিন্সেস জেসমিনের কার্টুন ছবি। আমার বাসস্থান : ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় তুলুস নগরী। আমার নাম মেলোডি। বয়স ২০ বছর।

জিহাদিদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ইউটিউবে আমি বহু প্রপাগান্ডা ফিল্ম দেখেছি। বীভৎস সব দৃশ্য। বন্দীদের ওপর নির্যাতন। টুকরো টুকরো করে কাটা মৃতদেহ খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে। এসব করে ও দেখে উল্লাস করছে কিশোর-তরুণ আইএস সদস্যরা। অসহ্য রকমের ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য।



যা হোক, আগের কথায় ফিরে যাই। সেই শুক্রবার রাতে আমি এক ফরাসি আইএস সদস্যের ভিডিও দেখছিলাম। তার বয়স হবে ৩৫-এর মতো। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছিল, সে তাদের অস্ত্রশস্ত্রের হিসাব মেলাচ্ছে। তার পরনে সামরিক পোশাক। তার নাম আবু বিলেল। সে দাবি করল, সে এখন সিরিয়ায় আছে। তার চার পাশের জনশূন্য প্রান্তর দেখে মনে হলো, স্থানটা হয়তো সিরিয়াতেই। তার গাড়ির পেছনভাগে দেখা যাচ্ছে একটি বুলেটপ্রুফ পোশাক, তার পাশে একটি হালকা মেশিনগান (পরে আমি জানতে পারি, আইএস নেতা আবু বকর আল-বাগদাদির অতি বিশ্বাসভাজন হিসেবে আবু বিলেল বিশ্বের অনেক দেশে ‘জিহাদে’ অংশ নিয়েছে)।

এই ভিডিওটি শেয়ার করার অল্পক্ষণের মধ্যেই আমার কম্পিউটার সংকেত দিলো, মেলোডির প্রাইভেট ইনবক্সে তিনটি মেসেজ এসেছে... সব ক’টারই প্রেরক আবু বিলেল। এর একটিতে সে জানতে চেয়েছে, ‘তুমি কি সিরিয়া আসার কথা ভাবছো?’
‘ওয়ালাইকুম সালাম। আমি ভাবতে পারিনি, কোনো আইএস সদস্য আমার সাথে কথা বলবে।’ আমি জবাব দিলাম, ‘তোমার কি কোনো কাজ নেই? হা-হা-হা!’

আমার মেসেজে আমি তাকে বললাম যে, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। তবে কেন, কিভাবে এসব কিছু জানালাম না। মেসেজে আমি অনেকগুলো ভুল বানান এবং টিনএজারদের ব্যবহৃত শব্দ লিখলাম। এরপর তার জবাবের অপেক্ষায় থাকলাম। আমার পেট মোচড় দিয়ে উঠল : আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, ঘটনা সত্যি সত্যিই ঘটতে চলেছে।
একটু পরেই তার জবাব এলো : ‘অনেক কাজ আছে। তবে এখানে এখন রাত ১১টা। সৈনিকেরা সব ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা স্কাইপেতে কথা বলতে পারি।’

স্কাইপে, প্রশ্নই ওঠে না! আমি ওর প্রস্তাবে কান না দিয়ে বললাম, ‘আরেক দিন’। আবু বিলেল বুঝল। জানাল পরদিন যখন খুশি আমি ওর সাথে কথা বলতে পারব। আরো বলল, ‘তুমি ইসলাম কবুল করেছো, কাজেই এখন হিজরতের জন্য প্রস্তুত হও। আমিই তোমার ভালো-মন্দ দেখব, মেলোডি।’

কী আশ্চর্য, সে এই মেয়েটি (আমি) সম্বন্ধে কিছুই জানে না, অথচ তাকেই বলছে কিনা পৃথিবীর সবচেয়ে গোলযোগপূর্ণ দেশটিতে গিয়ে তার সাথে যোগ দিতে!


পরেরবার যখন আমাদের কথা হলো, বিলেল জানতে চাইল, ‘তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে?’
‘না, নেই।’ আমি মেলোডি হয়ে জবাব দিই, ‘কোনো পুরুষের সাথে এসব নিয়ে কথা বলতেও আমার ভালো লাগে না। এটা হারাম। আমার মা কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিস থেকে ফিরে আসবে। আমাকে এখন কুরআন লুকিয়ে রাখতে হবে। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়তে হবে।’

‘শিগগিরই তোমাকে আর কোনো কিছুই লুকিয়ে রাখতে হবে না ইনশাআল্লাহ। তোমার জন্য এখানে নতুন জীবন অপেক্ষা করছে। সেখানে আসতে আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। হ্যাঁ, ঘুমাতে যাওয়ার আগে তুমি আমার কয়েকটি কথার জবাব দিয়ে যাও। আমি কি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারি?’

আমি ফেসবুক লগ অফ করে দিলাম। পরবর্তী সময়ে দুই ঘণ্টায় আমরা ১২০টি মেসেজ চালাচালি করলাম।
আমি যে ম্যাগাজিনটিতে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করি, ওই সোমবারই আমি সেটির সম্পাদকের সাথে দেখা করলাম। সব শুনে আমার সম্পাদকও একমত হলেন যে,্ এটা একটা অসাধারণ সুযোগ। তবে এতে বিপদের ভয়ও আছে, সে কথাও জানাতে ভুললেন না তিনি। দেখেশুনে, বুঝেসুজে পা ফেলার অনুরোধ জানালেন এবং আন্দ্রে নামে এক ফটোগ্রাফারকে আমার সাথে দিলেন। কথা হলো, আমি বিলেলের সাথে স্কাইপেতে কথা বলতে রাজি হবো আর আন্দ্রে ওই সময় এর ছবি নেবে।

এবার আমার মেলোডি সাজার পালা। আমাকে ১০ বছর বয়স কমাতে হবে। একটি হিজাব জোগাড় করতে হবে। আরেক সম্পাদক আমাকে একটি হিজাব এবং একটি জেল্লাবা (লম্বা কালো পোশাক, বোরকা) ধার দিলেন। ওগুলো পেয়ে স্বস্তি পেলাম। কিন্তু আমার চেহারার সাথে এক সন্ত্রাসী পরিচিত হবে, এটা ভেবে ভালো লাগল না। বিশেষ করে ওই লোকটি তার নিজ দেশ ফ্রান্সে ফিরে এলে কেমন হবে, এটা ভেবেও অস্বস্তি লাগতে থাকল।


সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমার অ্যাপার্টমেন্টে এলো ফটোগ্রাফার আন্দ্রে। বিলেল ‘যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফিরে’ মেলোডির সাথে যোগাযোগ করার আগে প্রস্তুত হওয়ার জন্য আমাদের হাতে এক ঘণ্টা সময়। আমি আমার জিনস ও সোয়েটারের ওপর লম্বা বোরকা চাপিয়ে মেলোডি হয়ে গেলাম। হাতের রিং খুলে ফেললাম। কবজিতে ছোট একটা উল্কি আঁকা ছিল, বিলেল এসব ছেলেমি পছন্দ না-ও করতে পারে ভেবে, প্রসাধন দিয়ে সেটাও ঢেকে দিলাম।

সময় ঘনিয়ে আসছে। সোফার ওপর পদ্মাসন করে বসে আছি আমি। সোফার পেছনে একটা ফাঁকা জায়গায় অবস্থান নিয়েছে আন্দ্রে। কাউন্টার এসপিওনেজ ও হ্যাকারের অভাব নেই আইএস-এ। তবে বিলেল আমার ফোন নাম্বার জানে না, আর মেলোডির তো আলাদা নাম্বার। আমি ওর (মেলোডি) নামে আলাদা একটা স্কাইপে অ্যাকাউন্টও খুলে রেখেছি।

স্কাইপের রিংটোন বেজে উঠল; যেন গির্জায় ঘণ্টা বাজছে। নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য এক মুহূর্ত সময় নিলাম আমি, তারপর বাটনে ক্লিক করলাম, ওপারে সে আছে। বিলেল তার গাড়িতে বসে স্কাইপে করছিল। সারা দিন ‘যুদ্ধ’ করে এলেও তাকে দেখাচ্ছিল পরিপাটি ও তরতাজা। কথা শুরু করল সে, ‘সালাম আলাইকুম, সিস্টার!’

আমি মৃদু হাসলাম, ‘সিরিয়ার একজন মুজাহিদের সাথে কথা বলাটা দারুণ ব্যাপার! মনে হচ্ছে, তুলুসের চেয়ে সিরিয়ার ইন্টারনেটে ঢোকা আরো সহজ।’

‘সিরিয়া দারুণ জায়গা। এখানে সব কিছু মেলে, মাশাআল্লাহ! তুমি আমাকে বিশ্বাস করলে বলি, এটা হলো বেহশত! অনেক মেয়ে আমাদের নিয়ে অনেক উদ্ভট কল্পনা করে। কিন্তু আসলে আমরা হচ্ছি আল্লাহর সৈনিক।’

‘কিন্তু তোমার বেহেশতে তো প্রতিদিন মানুষ মরছে...’
‘তা ঠিক। আর এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে প্রতিদিন আমি লড়াই করছি। এখানে আমাদের শত্রু হচ্ছে শয়তান। তুমি এসব ভালো বুঝবে না। আচ্ছা বলো তো, তুমি কি প্রতিদিন হিজাব পরো?’


মেলোডি এবার বিলেলকে কুরআনের কয়েকটি আয়াত পড়ে শোনাল। গোপনে মুসলিম হয়েছে, এমন কয়েকটি মেয়ের কাছ থেকে শুনে শুনে সে এসব শিখে নিয়েছিল। বিলেলের কথার জবাবে বলল, ‘সকালে আমি সাধারণ পোশাকই পরি। মা অফিসে চলে যান। এরপর আমি যখন বাইরে বেরোই, তখন হিজাব ও জেল্লাবা পরে বের হই।’

হঠাৎ ওপ্রান্তে আমি আরো দু’জনের গলা শুনতে পেলাম। বিলেল ওদের কড়া গলায় বলছে, ‘একটা কথাও বলবে না। যাও এখান থেকে! তোমাদের কোনো কথাই শুনতে চাই না।’

আমি শুনলাম ওই দু’জন বিলেলকে অভিনন্দন জানাল; প্রথমে আরবি এবং পরে ফরাসি ভাষায়। ওরা বেশ হাসাহাসি করল এবং ‘ওদেরকে জবাই করায়’ পরস্পরকে অভিনন্দিত করল। কনক্রিটের মেঝেতে আমি শুকানো রক্তের দাগ দেখতে পেলাম। একটু দূরেই আইএস-এর সাদা প্রতীকখচিত কালো পতাকা। মনে হচ্ছে, নবাগত লোক দু’টি বিলেলকে বেশ সমীহ করে কথা বলছে। তাদের বিনীত কণ্ঠস্বর শুনে বুঝলাম, ওদের চেয়ে বিলেলের অবস্থান ওপরে।

এক মিনিট পর বিলেল লোক দু’টিকে বিদায় করে ফিরে এলো ফোনে, ‘আরে, তুমি এখনো লাইনে আছো?’
‘ওরা কারা?’ জানতে চাই আমি।

‘আমাদের সৈনিক। জাস্ট ‘হ্যালো’ বলতে এসেছিল। বাদ দাও, তুমি তো আবার এসবে ইন্টারেস্টেড না। তোমার নিজের কথা বলো। কিভাবে তুমি আল্লাহর পথে এলে?’

আমি তোতলাতে শুরু করলাম। আসলে মেলোডির ‘সত্যিকার’ জীবনকাহিনী বানানোর জন্য আমি মোটেই সময় দিইনি। কোনোরকমে বললাম, ‘আমার কাজিনদের একজন মুসলিম হয়ে গেছে। ওর ধর্ম ওকে আত্মার যে প্রশান্তি দিয়েছে, তা দেখেই আমি আকৃষ্ট হই। সে-ই আমাকে ইসলামের দিকে টেনে আনে।’

‘তুমি যে আল-শামে আসতে চাচ্ছো, তা কি সে জানে?’
বিলেলের কথা শুনে মনে হলো যেন সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে আছে। যেন মেলোডি কিছু দিনের মধ্যেই সিরিয়া পৌঁছে যাবে। বললাম, ‘যেতে চাই কি না তা এখনো আমি ঠিক করিনি।’


‘শোনো, মেলোডি! এখানে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। এখানে তুমি হবে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আর তুমি যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজি থাকো, তাহলে আমি তোমাকে রানী বানিয়ে রাখব।’

বিয়ে! ওকে! আমি স্কাইপে লগ অফ করে দিলাম। হিজাব ছুড়ে ফেলে দিলাম। তাকিয়ে দেখি, পেছনে গোপনে বসে থাকা আন্দ্রেও আমার মতোই পাথর হয়ে গেছে।

বিলেলের এই প্রস্তাবের কী জবাব দেবো আমি? আন্দ্রে বলল, ‘মেলোডি তো অবিবাহিতা। কাজেই সে যদি সিরিয়া যেতেও চায়, তবুও একা তো যেতে পারবে না।’

এর মধ্যে আবার বিলেল কলব্যাক করল। আমি কথার সুর পাল্টালাম, ‘আমার বান্ধবী ইয়াসমিন একজন মুসলিম। সেও আমার সাথে আসবে। কিন্তু তার বয়স তো এখনো মাত্র ১৫!’

‘এখানে মেয়েদের বয়স ১৪ হলেই বিয়ের যোগ্য বলে ধরা হয়। ইয়াসমিন যদি আসে, তাহলে ওর জন্য আমি একজন ভালো বর খুঁজে দেবো।’
ইয়াসমিন বলে আসলে কেউ নেই। ভেবে অবাক হলাম, বিলেলের মতো লোকেরা এভাবে কত সত্যিকারের ইয়াসমিনকে ফুঁসলিয়ে কাছে টানছে!

‘বিলেল, আমাকে ছাড়তে হবে। আমার মা বাসায় ফিরছে।’
‘আগামীকাল যুদ্ধশেষে আমাকে পাবে। প্রতিদিনের মতো সন্ধ্যা ৭টায়। ইনশাআল্লাহ... গুড নাইট, মাই বেবি।’
মাই বেবি? আমি প্রচণ্ড অবাক হলাম। বিলেল এদিকে মেলোডিকে বিয়ের পরিকল্পনার ঘোষণা দিতেই মেলোডির ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকল। অনেক মেয়ে জানতে চাইতে লাগল, সিরিয়া যাওয়ার সবচেয়ে নিরাপদ রুট কোনটি। কারো কারো প্রশ্ন আবার বেশ অবাক করা, ‘যথেষ্ট স্যানিটারি প্যাড নিয়ে যাচ্ছো কি? না নিলে ওখানে গিয়ে ওসব পাবে তো?’ এ রকম আরো সৃষ্টিছাড়া কথা, যার কোনো আগামাথা খুঁজে পাওয়া ভার। মৃত্যুর মুখে হাজির হতে চাওয়া এ রকম আরো অনেক মেয়ের অনেক রকম কথা শুনতে শুনতে আমার পাগল হওয়ার জোগাড়।

এ দিকে বিলেল আমাকে ক্রমাগত প্ররোচিত করতে থাকল। আমি সব জেনেবুঝেও তার প্ররোচনার খেলায় অংশ নিতে থাকলাম শুধু তার আস্থা অর্জনের জন্য। তার প্রতিটি কথাই আমার বুকে কাঁপন ধরাতে থাকল। এক রাতে সে বলে বসল, ‘আরে, তুমি আছো, বউ আমার! শোনো, সুখবর আছে। আমি রাক্কায় (সিরিয়ায় আইএসের শক্ত ঘাঁটি) কাজির সাথে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দেবেন।’


ওর কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কী জবাব দেবো ভেবে পেলাম না। জানতে চাইলাম, ‘ওখানে বিয়ে পড়ানোর মানে কী?’
‘আসলে হয়েছে কি, আমাদের বিয়ে তো হয়েই গেছে।’ বলল সে।
‘এক্সকিউজ মি?’
‘আরে শোনো। ভেবে দেখলাম, বিয়ে নিয়ে আমি তো তোমার সাথে অনেক কথা বলেছি। একটু আগেও আমাকে বিয়ে করতে বলেছি তোমাকে। কাজিকেও বলেছি। তিনি কাজগপত্র ঠিক করেছেন। কাজেই ধরে নাও, কাগজে-কলমে আমাদের বিয়ে হয়েই গেছে। বুঝলে, আমার বউটি! মাশাআল্লাহ, এখন সত্যিই তুমি আমার।’

এভাবে প্রায় এক মাসের মতো কেটে গেল। আন্দ্রে শঙ্কিত হলো, মেলোডিকে আমরা যত বেশি দিন টিকিয়ে রাখব, আমার ঝুঁকি ততই বাড়বে। আমি ওর সাথে একমত হলাম এবং আমার সম্পাদকদের সাথে বসলাম। ঠিক হলো, খোঁজখবর অনেক নেয়া হয়েছে, আর না! সে অনুযায়ী আমি বিলেলকে বললাম, ইয়াসমিন ও আমি সিরিয়া যাচ্ছি, সেখানেই আমাদের দেখা হবে।
বিলেল তা শুনে আমাকে পথের নির্দেশনা দিলো। প্রথমে যেতে হবে আমস্টারডাম, সেখান থেকে ইস্তাম্বুলের বিমানে চড়তে হবে। ইস্তাম্বুল পৌঁছার পর বিলেল জানিয়ে দেবে এরপর কোথায়, কিভাবে যেতে হবে। তারপর সে আদুরে গলায় বলল, ‘তুমি হলে হীরের টুকরো। তোমার জায়গা হচ্ছে রাক্কা। সেখানে তোমার মর্যাদা হবে রাজকন্যার মতো।’


আমি ইস্তাম্বুল যাচ্ছি, এটা কিন্তু সত্যি। যা সত্যি নয় তা হলো ‘ইয়াসমিন’। এই নামের কেউ আমার সাথে ছিল না। আমার সাথে ছিল ফটোগ্রাফার আন্দ্রে। আমাদের পরিকল্পনাটি ছিল খুব সাধারণ। বিলেল বলেছিল, ‘মাদার’ নামে পরিচিতা এক প্রবীণা ইস্তাম্বুলে আমাদের সাথে দেখা করবে। আমার আর্টিকলের জন্য আন্দ্রে গোপনে ওই নারীর ছবি তুলে নেবে। ওই মহিলা যখন ইয়াসমিন ও মেলোডিকে খুঁজবে, আন্দ্রে ও আমি তখন কিলিসের পথে যাত্রা করব। সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এই শহরটি নিয়ন্ত্রণ করে তুরস্ক এবং এটি অন্যান্য স্থানের চেয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।

ক’দিন পরের কথা। আমি তখন আমস্টারডামের একটি ছোট হোটেল রুমে। এ সময় বিলেল স্কাইপে করল, ‘সালাম আলাইকুম, মাই ডার্লিং। তুমি সত্যিই আমস্টারডামে? বিশ্বাস হচ্ছে না। ক’দিন পরই তুমি এখানে থাকবে। পৃথিবীতে এখন আমি সবচেয়ে সুখী মানুষ। আই লাভ ইউ, মাই ওয়াইফ!’

সত্যি বলছি, তাকে এত খুশি হতে আগে কখনো দেখিনি। বিলেল একটি ইন্টারনেটে ক্যাফেতে ছিল একা। সে তখন সবে ‘কাজ’ সেরে এসেছে। বলল, ‘তোমার ভ্রমণের কথা বলো। টিকিটের টাকা পেলে কোথায়?’
‘মায়ের ডেবিট কার্ড চুরি করেছি।’

‘ওরে আমার বউরে, তুমি তো অনেক তেজি! ডেবিট কার্ড যদি এখনো তোমার হাতে থেকে থাকে, তাহলে আমার জন্যও কিছু কিনতে পারো।’
(পাঠক, বলুন তো, যে লোকটি এক নিঃশ্বাসে কাউকে জবাই করার এবং আবার পরমুহূর্তে প্রেমের কথা বলতে পারে, আপনি তার জন্য কী নিতে পারেন?)

‘তুমি কী চাও?’ জানতে চাই আমি।
সে কয়েকটি সুগন্ধির নাম বলল। আমি বললাম, ‘ওকে বেবি। এবার আমরা কি আগামীকালের কথা একটু বলতে পারি? মাদারের সাথে সাক্ষাতের পর কী হবে?’
‘আসলে কেউ তোমার সাথে দেখা করতে ওখানে যাবে না।’
এবার এক অজানা ভয়ে আমার গলা ভেঙে আসে, ‘কিন্তু এমন তো কথা ছিল না, বিলেল! তুমি বলেছিলে, আমিও বিশ্বাস করেছিলাম যে, এক মহিলা আমাদের সাথে দেখা করবে। তুমি আরো বলেছিলে, আমাদের কোনো ভয় নেই।’
‘আমি কী বলি, শোনো’, এবার তার গলায় কড়া সুর, ‘তুমি এক মিনিট চুপ করে থাকো, আমাকে বলতে দাও। ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে নেমে তোমরা উরফা যাওয়ার দু’টি ওয়ানওয়ে টিকিট কিনে নাও।’

উরফা! ওটি তো আইএস-এর এলাকা। আমি ভাবলাম, ওখানে যাওয়া আর আত্মহত্যা করা তো এক কথা।
‘কিন্তু এমন তো কথা ছিল না! তুমি আমার সাথে কী ওয়াদা করেছিলে?’
‘এভাবে কথা বলবে না। এ জায়গাটা যাদের হুকুমে চলে, আমি তাদের একজন। এখানে তোমার কোনো কথা খাটবে না। এখন থেকে একেবারে চুপ থাকবে, একটি কথাও নয়। তুমি জানো না, আমি কে? আমার হুকুমে এখানে চলে এক শ’ সৈনিক। আমার সম্বন্ধে তোমাকে আমি চার আনা সত্যও বলিনি কিন্তু।’


কথা শেষ হতেই আমি আমার হিজাবটি টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললাম। সব কিছু কেমন খাপছাড়া হয়ে গেল। কী করব, জানার জন্য প্রধান সম্পাদককে ফোন করলাম। সব শুনেটুনে তিনি আমাকে মনে করিয়ে দিলেন, এর আগে ফ্রান্সের দুই সাংবাদিকে উরফা এলাকায় পাঠানো হয়েছিল। আইএস জঙ্গিদের হাতে ১০ মাস বন্দী থাকার পর অল্প ক’দিন আগে তারা ছাড়া পেয়েছে।

পরদিন সকালেই আমরা দেশে ফিরে এলাম। এয়াপোর্ট থেকে বিলেলকে একটি স্কাইপে মেসেজ পাঠাল মেলোডি। জানাল, একটা ‘অদ্ভুত লোক’ তারা দু’জনকে নানা প্রশ্ন করেছে। এতে ইয়াসমিন ও মেলোডি বুঝতে পেরেছে যে, তাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে এবং তাই তারা ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়া পর্যন্ত তারা দেশেই থাকবে।

দেশে ফিরে এলাম। আমার সম্পাদকদের সাথে বসলাম। তারা বুঝে নিলেন আমার কাছে কতটুকু কী তথ্য আছে, যা দিয়ে একটা নিউজ স্টোরি বানানো যায়। ছিল। বিলেলের সাথে দীর্ঘ কথাবার্তায় আমি আইএস-এর কাঠামো সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে গিয়েছিলাম। আরো জেনেছিলাম, নতুন রিক্রুটদের তারা কিভাবে কাজে লাগায়।


আমি লিখতে শুরু করলাম। এক সপ্তাহ পরে আমার লেখাটি ওই ম্যাগাজিনে ছাপা হলো। তবে আমার নামে নয়; ছদ্মনামে। আইএস সন্ত্রাসীরা আমাকে খুঁজে বের করে ফেলবে এই আশঙ্কায় আমি অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলাম আর দু’বার ফোন নাম্বার বদলালাম।

এ দিকে, পুলিশের বিভিন্ন বিভাগ আবার বক্তব্য নিতে থাকল। এক, দুই... করে গুনতে গুনতে ২৫৪তে গিয়ে গোনায় ক্ষান্ত দিলাম। অর্থাৎ আমাকে ২৫৪ বারেরও বেশি বক্তব্য দিতে হয়েছে পুলিশের কাছে।

ফাইলের পর ফাইল জমতে থাকল শুধু আমার বক্তব্য নিয়ে। ওসব ফাইল থেকে পরে জানতে পারি, বিলেলের আরো তিনজন স্ত্রী আছে, তাদের বয়স ২০, ২৮ ও ৩৯ বছর। তারা সবাই বিলেলের সাথে সিরিয়ায় থাকে। তার কমপক্ষে তিনটি ছেলেও আছে, যাদের বয়স ১৩ বছরের কম। এর মধ্যে বড় দু’টি সিরিয়ার রণাঙ্গনে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।

বিলেলের সাথে আর কোনো দিন আমার সরাসরি কথা হয়নি। সম্প্রতি আমার এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে টেলিফোনে জানালেন যে, তিনি শুনেছেন আমার বিরুদ্ধে একটি ফতোয়া জারি হয়েছে।


ফতোয়ার ভিডিওটি আমি ওয়েবে দেখে নিলাম। দেখা গেল, আমার কৌচে বসে আছে হিজাব-পরা মেলোডি। বুঝলাম, কোনো একসময় ছবিটি তুলে নিয়েছে বিলেল। ওতে কোনো অডিও ছিল না, তবে শয়তানের একটি কার্টুন ছিল আর ছিল ফরাসি ও আরবি ভাষায় সাব-টাইটেল। ভিডিওটি আমি একবারই মাত্র দেখেছি, কিন্তু সেই সাব-টাইটেলের একটি শব্দও ভুলিনি :

‘সারা বিশ্বের ভায়েরা আমার, এই নাপাক মানুষটির বিরুদ্ধে আমি একটি ফতোয়া দিচ্ছি। সে সৃষ্টিকর্তাকে অবমাননা করেছে। আপনারা তাকে পৃথিবীর যেখানেই পাবেন, ইসলামি আইন মেনে তাকে হত্যা করুন। তার মৃত্যু যেন দীর্ঘ সময় ধরে ও যন্ত্রণাদায়ক হয়, তা নিশ্চিত করুন। যে-ই ইসলামকে ব্যঙ্গ করবে, তাকেই রক্ত দিয়ে তার দায় শোধ করতে হবে। এই মহিলাটি একটি কুত্তার চেয়েও নাপাক। তাকে ধর্ষণ করে, তার গায়ে পাথর ছুড়ো। এভাবেই তাকে খতম করো। ইনশাআল্লাহ।’


তথ্যসুত্র: অন্যদিগন্ত

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:০৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×