কেবল দুঃসাহসিকই নয় অভিনবও। এমন অভিনব কায়দায় ব্যাংক থেকে টাকা লুটের ঘটনা দেশের ইতিহাসে এই প্রথম। এমনকি হলিউড কিংবা বলিউড সিনেমাতেও কোনদিন এমন দুঃসাহিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে নি কেউ। কিশোরগঞ্জে সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখা থেকে সুড়ঙ্গপথে বিশাল অংকের টাকা লুটের বাস্তব এই ঘটনায় হতভম্ব পুরো দেশ। শাখাটির নিরাপত্তায় সার্বণিক পুলিশ পাহারার মধ্যে এই ‘অভিনব’ ও ‘দুঃসাহসিক’ লুটের ঘটনাটি ঘটে। অবিশ্বাস্য এ আলামতের রহস্য উদঘাটনে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপরতা চালিয়ে গেলেও খোঁজ কিংবা পরিচয় মিলে নি ‘সোহেল’ নামের সেই রহস্য যুবকের। তবে মাটির নিচ দিয়ে তার তৈরি করা সুড়ঙ্গপথটি নিয়ে চাঞ্চল্যের শেষ নেই কৌতূহলী মানুষজনের। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মাহফুজুল হক নূরুজ্জামানও গতকাল সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে এ রকম তথ্য দিলেন। তিনি এটিকে অভিনব কায়দায় নতুন ধরনের অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে জানালেন, এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে ইতিপূর্বে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। অতীতে হয়ে থাকলেও হতে পারে। তবে নিকট অতীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এটি কারো ধারণাও ছিল না। খুব সুকৌশলে কাজটি করা হয়েছে।
ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা গেছে, জেলা শহরের রথখলা এলাকার প্রধান সড়ক ঈশাখাঁ রোডের উপর দ্বিতল ভবনে অবস্থিত সোনালী ব্যাংকের ওই শাখার পূর্বপাশে প্রায় ৬ ফুটের মতো গলিপথ রয়েছে। গলিপথ সংলগ্ন প্রয়াত ভাষা সৈনিক আমিনুল হকের টিনশেড বাসার প্রথম কক্ষটি থেকেই তৈরি করা হয় আলোচিত এই সুড়ঙ্গপথ। ব্যাংকের ভল্ট থেকে সবচেয়ে কম দূরত্বের ওই কক্ষটির মেঝে খুঁড়ে তৈরি করা প্রায় ১৮ ফুট দীর্ঘ সুড়ঙ্গটি গলির পাকা রাস্তার নিচ দিয়ে শেষ হয়েছে ভল্টের মেঝেতে। বিল্ডিংয়ে সেন্টারিং দেয়ার মতো করে সুড়ঙ্গের দু’পাশের পাড়ে বাঁশের খুঁটি এবং উপরে বাঁশ-কাঠ দেয়া হয়েছে। সুড়ঙ্গপথে আলো সরবরাহের জন্য বিদ্যুতের তারও টানা রয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩ ফুট উঁচু ও ৩ ফুট প্রস্থ সুড়ঙ্গপথ ধরে একজন মানুষ মোটামুটি অনায়াসেই যাতায়াত করতে পারবেন। এ কাজ করতে অন্তত ৬ মাস সময় লেগেছে বলে ধারণা দেন সদর থানার ওসি মো. আবদুল মালেক। এই সুড়ঙ্গ পথ দিয়েই ব্যাংক বন্ধ থাকার দিন শুক্রবার কিংবা শনিবারের কোন এক সময় ভল্ট থেকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে। পুলিশ বলছে, বাসার ওই কক্ষের ভাড়াটিয়া সোহেল নামে এক যুবক এ দুর্ধর্ষ লুটের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। আর এমন পূর্ব পরিকল্পনা থেকেই বছর দু’য়েক আগে সে ওই বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে ওঠে। যে কারণে তদন্তের অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ওই যুবকের পরিচয় ও খোঁজ পাওয়ার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। তার পরিচয় সনাক্তের জন্য পুলিশ সোহেলের পরিচিত হতে পারেন এ ধরনের ২ নারী ও ২ পুরুষকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এছাড়া ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া, প্রিন্সিপাল অফিসার হাসান আহমেদ মঈন ও সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) মোহসিনুল হকসহ ১২ কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অন্যদিকে ঘটনা তদন্তে সোনালী ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রধান এবং জিএম হাসান ইকবাল, ডিজিএম আবু জাফর, শেখ মোহাম্মদ আমানুল্লাহ ও রফিকুল ইসলামকে সদস্য করে গঠিত ৫ সদস্যের একটি তদন্ত দল গঠিত গতকাল সোমবার সকাল থেকে কাজ করছে। এছাড়া ব্যাংকের এজিএম নাসিরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে¡ চার সদস্যের এবং ডিজিএম শেখ মোহাম্মদ আমানুল্লাহর নেতৃত্বে চার সদস্যের পৃথক দু’টি তদন্ত দল কাজ করছে। এদিকে এ ঘটনায় রোববার রাতে ডিজিএম শেখ মোহাম্মদ আমানুল্লাহ বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় একটি মামলা (নং-৩২) দায়ের করেছেন। এতে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের আসামি করা হয়েছে। সদর মডেল থানার ওসি মো. আবদুল মালেককে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিনিয়র এএসপি মো. শাহজাহানের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ দল তদন্ত কাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে দলটি সুড়ঙ্গ পথসহ ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া আলামত সংগ্রহ করেছে। উদ্ধার হওয়া আলামতের মধ্যে ৪টি টুপি, ২টি মাস্ক ও বৈদ্যুতিক কেবলসহ অন্যান্য মালামাল রয়েছে। অন্যদিকে সিলেট থেকে সিআইডির ক্রাইস সিন ইনচার্জ শামীমুল ইসলামের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি দল রোববার রাতে ঘটনাস্থল ঘুরে গেছে। অন্যদিকে ব্যাংকের নিরাপত্তা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকারী ২ এএসআই ও ৬ কনস্টেবলকে প্রত্যাহারের পর কর্তব্যে অবহেলার দায়ে তাদেরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। সে স্থানে নতুন করে অন্য ৮ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া গতকাল সোমবার ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ ছিল।
এদিকে গতকাল সোমবার দুপুরে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত ও ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মাহফুজুল হক নূরুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন শেষে ডিআইজি নূরুজ্জামান আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই অপরাধ হয়, হতে পারে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রটেক্ট করা, অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা। যারাই এ ঘটনায় জড়িত থাকুক, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের সকল জেলা এবং সীমান্তে ম্যাসেজ পাঠানো হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই অপরাধীদের চিহ্নিত করে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা সম্ভব হবে বলেও তিনি জানান।
সাধারণত এ ধরনের শাখায় সর্বোচ্চ ২০ কোটি টাকা সঞ্চিত রাখার নিয়ম রয়েছে। অথচ অত্র শাখায় ২৪০ কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে। এছাড়া টেবিলের ওপর কেন এত বিপুল অঙ্কের টাকা রাখা হলো? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, তদন্ত চলছে। তদন্তে এসব প্রশ্নের উত্তর বেরিয়ে আসবে। অন্যদিকে ডিআইজি নূরুজ্জামান বলেন, বড় কোন ঘটনা ঘটতেই পারে। তবে আমরা আশাবাদী, যে ধারায় তদন্তকাজ এগিয়ে চলেছে, শীঘ্রই সব বেরিয়ে আসবে।
উল্লেখ্য, প্রায় ৮ বছর আগেও একবার ব্যাংকের দোতলায় ভেন্টিলেটর দিয়ে চোর ঢুকেছিল। তবে দোতলায় কোন টাকা পয়সা থাকে না বলে তখন তেমন ক্ষতি হয়নি। আবার ২০০১ সনের ১৪ই জুন বিকালে ন্যাশনাল ব্যাংকের কিশোরগঞ্জ বড়বাজার শাখার ১২ লাখ টাকা সোনালী ব্যাংকে জমা দিতে যাওয়ার সময় সোনালী ব্যাংকের অদূরে একদল দুর্বৃত্ত বোমা ফাটিয়ে পুরো টাকা লুট করে মাইক্রোযোগে পালিয়ে যায়। তবে এদিনই সন্ধ্যায় ঘোড়াশাল এলাকায় ২০ হাজার টাকাসহ একটি মাইক্রো ধরা পড়ে। পরবর্তীতে মামলায় ১০ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- হলেও আর কোন টাকা উদ্ধার হয়নি। অবশ্য বিভিন্ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে বীমাবাবদ ন্যাশনাল ব্যাংককে অবশিষ্ট ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি শেষে রোববার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে বেলা আড়াইটার দিকে সোনালী ব্যাংকের ওই শাখার ভল্ট থেকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা লুটের বিষয়টি ধরা পড়ে। ওই শাখার দায়িত্বশীল দুই কর্মকর্তা ভল্টের দু’টি কক্ষের ভেতরেরটিতে টেবিলের উপর রক্ষিত টাকা দেখতে না পেয়ে এবং কক্ষের মেঝেতে গর্ত দেখতে পেয়ে টাকা লুট হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন। ভল্টরুমের গর্তের সূত্র ধরে সুড়ঙ্গপথটি আবিস্কৃত হয়।