বিবর্তন মানে হচ্ছে পরিবর্তন বা ক্রমবিকাশ – এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় উত্তোরণ। বিবর্তন শব্দটাকে বিভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করা যায় - নির্ভর করছে উদ্দেশ্য ও ব্যক্তিবিশেষের উপর। যেমন: অতি ক্ষুদ্র শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণীর রূপ ধারণ; ক্ষুদ্র একটি বীজ থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বিশাল একটি গাছের রূপ ধারণ; অতি সাধারণ একটি ক্যালকুলেটিং মেশিন থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে আধুনিক কম্পুটার ও ক্যালকুলেটর এর রূপ ধারণ; ইট-সিমেন্ট-বালি থেকে শুরু করে দৃষ্টিনন্দন একটি টাওয়ার এর রূপ ধারণ; ইত্যাদি। এগুলোর সবগুলোকেই বিবর্তন বলা যায় – যা দিনের আলোর মতই সত্য। এগুলোর পক্ষে কেউ কখনো প্রমাণ দেখতে চায় না।
অন্যদিকে বিবর্তন তত্ত্ব বা বিবর্তনবাদ হচ্ছে ডারউইন-প্রস্তাবিত বিশেষ একটি তত্ত্ব বা মতবাদ – যে তত্ত্ব অনুযায়ী একটি অণুজীব থেকে "এলোমেলো পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন" এর মাধ্যমে ধাপে ধাপে পুরো উদ্ভিদজগত ও প্রাণীজগত বিবর্তিত হয়েছে। আমরা ডারউইন-প্রস্তাবিত তত্ত্বকে ভুল ও কল্পকাহিনী বলি – স্রেফ বিবর্তন-কে নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে বিবর্তনবাদীরা তাদের লেখায় "বিবর্তন তত্ত্ব" বা "বিবর্তনবাদ" না লিখে স্রেফ "বিবর্তন" লিখে অসচেতন পাঠকদেরকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত – যেটি একটি ধোঁকাবাজী।
সংজ্ঞা অনুযায়ী শূন্য থেকে যেমন বিবর্তন শুরু হতে পারে না তেমনি আবার পাথর বা কোনো জড় বস্তু বিবর্তিত হতে হতে জীবে রূপান্তরিত হওয়াও অবাস্তব। একটি পাথর বিবর্তিত হতে থাকলে তার আকার-আকৃতির পরিবর্তন হতে পারে মাত্র কিন্তু সেই পাথর থেকে কেউ একটি জীব আশা করতে পারে না। সে-রকম কিছু হলেও সেটি হবে অলৌকিক ঘটনা। অতএব, জীবের বিবর্তন শুরু হতেও প্রথম জীবকে সৃষ্ট হতেই হবে। তারপরই না কেবল সেই জীব থেকে বিবর্তন এর প্রশ্ন আসতে পারে। অথচ বিবর্তনবাদী নাস্তিকরা সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাস নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেন কেনো তা তো বোঝা যায় না। তারা নিজেরাই কল্পকাহিনীর চেয়েও অযৌক্তিক ও হাস্যকর কিছুতে বিশ্বাস করে উল্টোদিকে সৃষ্টিতত্ত্বে যৌক্তিক বিশ্বাস নিয়ে বোকার মতো হাসি-ঠাট্টা করেন! নিজের বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে এক পাশে রেখেও নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের গোঁয়ারগোবিন্দপনা দেখে সত্যিই বিনোদিত হতে হয়। সত্যকে তিক্ত মনে হলেও মেনে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর এই সত্যকে মেনে নিলে বিবর্তনবাদী নাস্তিকদের থাকেটা কী!
এ-জন্যই জীবের উৎপত্তি তথা প্রথম জীবের প্রসঙ্গকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ভাবসাব দেখে মনে হবে যেনো এটি একটি অতি তুচ্ছ বিষয়! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখানেই আসল রহস্য রয়ে গেছে। এই রহস্যকে উন্মোচন করতে গেলেই তাদের এড়িয়ে যাওয়ার গোমর ধরা পড়বে। কেউ কেউ হয়ত তেড়ে এসে বলবেন, "বিবর্তনবাদ তত্ত্ব 'প্রথম প্রাণ' নিয়ে মাথা ঘামায় না!" হ্য, সেটা সকলেই জানে। কিন্তু প্রথম প্রাণ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাস নিয়ে আবার বোকার মতো হাসি-ঠাট্টা করা হয় কেনো!
যাহোক, এই পর্বে বিবর্তনবাদীদের কিছু আত্মপ্রতারণা নিয়ে আলোচনা করা হবে:
- অনেকেই হয়ত জানেন যে, বিবর্তনবাদীরা বিবর্তনকে গাছ থেকে ভূমিতে অ্যাপেল পড়ার মতই একটি সত্য ঘটনা বলে দাবি করেন। অথচ এই তত্ত্ব নিয়ে যখন অত্যন্ত মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন করা হয় বা প্রমাণ হাজির করতে বলা হয় তখন ইউটার্ন নিয়ে আমতা আমতা করে যা বলা হয় তার অর্থ মোটামুটি এরকম, “হুমম! আপনারা তো বিজ্ঞানের কিছুই জানেন না! বিজ্ঞান ধীরে ধীরে এগোয়! বিজ্ঞানে শেষ কথা বলে কিছু নেই! ইত্যাদি।” এগুলোকে স্রেফ আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যেতে পারে? তাদের বক্তব্য অনুযায়ীই আগামীকাল যদি এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণ হয় তাহলে তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে যারা বিবর্তনকে গাছ থেকে ভূমিতে অ্যাপেল পড়ার মতই সত্য হিসেবে বিশ্বাস করে – সেই সকল অজ্ঞ লোকজনের কী হবে! তাদেরকে কি তাহলে বিজ্ঞানের নামে প্রতারিত করা হচ্ছে না?
- কেউ কেউ প্রসঙ্গক্রমে বাঁদর থেকে মানুষ বিবর্তিত হওয়ার কথা বলে হাসি-ঠাট্টা করে থাকেন। এই কথা শোনার সাথে সাথে বিবর্তনবাদীরা তেড়ে এসে বলা শুরু করেন, “হেঃ! হেঃ! কিছু অজ্ঞ লোকের বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষ নাকি বাঁদর থেকে বিবর্তিত হয়েছে! কিন্তু মানুষ তো বাঁদর থেকে বিবর্তিত হয়নি! বরঞ্চ মানুষ ও বাঁদর একটি ‘সাধারণ পূর্বপুরুষ’ থেকে বিবর্তিত হয়েছে!” কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই ‘সাধারণ পূর্বপুরুষ’ কি মানুষ নাকি বাঁদর নাকি অন্য কিছু – সেটা কখনোই পরিষ্কার করে বলা হয় না। সেই ‘সাধারণ পূর্বপুরুষ’ যদি মানুষ হয় তাহলে তো বিবর্তনবাদীদের আত্মহত্যা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না! ফলে সেটা তারা কখনোই চাইবেন না। তারা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ীই প্রমাণ দেখানোর চেষ্টা করবেন। আর তা-ই যদি হয় তাহলে বাঁদর জাতীয় কোনো প্রজাতি থেকেই মানুষ বিবর্তিত হতে হবে। অথচ একই কথা অন্য কেউ বললে তারা তেড়ে আসেন কেন? নাকি তারা মুখে যা বলেন, অন্তরে হয়ত তা বিশ্বাস করেন না! যাহোক, প্রফেসর ডকিন্স সম্প্রতি এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, “Monkeys and we come from a common ancestor and that common ancestor would probably have been called the monkey.” বিবর্তনবাদীদের আত্মপ্রতারণার নমুনা দেখলেন তো! একই কথা প্রফেসর ডকিন্স বললে ঠিক আছে কিন্তু অন্য কেউ বললে অজ্ঞ ও হাসি-তামাশার পাত্র হয়ে যায়!
- অনেকদিন আগে বিবর্তনবাদ তত্ত্বের উপর আমার একটি লেখাতে বলা হয়েছিল, “বিবর্তনবাদীদের দাবি অনুযায়ী ব্যাকটেরিয়ার মতো অতি ক্ষুদ্র একটি জীব থেকে সকল প্রকার প্রজাতি বিবর্তিত হয়েছে।” সেই লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পর-পরই এক বিবর্তনবাদী তেড়ে এসে অন্ধকে হাইকোর্ট দেখানোর মতো বিজ্ঞানের উপর বিশাল একখান লেকচার দিয়ে যা বলেছেন তার অর্থ হচ্ছে, “ব্যাকটেরিয়া থেকে তো সকল প্রকার প্রজাতি বিবর্তিত হয়নি। অন্য কোন সরল জীব থেকে প্রজাতির উদ্ভব রয়েছে।” ভাবসাব দেখে মনে হবে যেন উনি জেনে-শুনে নিশ্চিত হয়েই তবে একদম নতুন কিছু বলেছেন! কিছুদিন আগেও একজন একই রকম কথা বলেছেন। অথচ আমার লেখাতে বলা হয়েছে ‘ব্যাকটেরিয়ার মতো’ কোন জীব থেকে। ‘ব্যাকটেরিয়ার মতো’ বলতে ব্যাকটেরিয়া বা সে-রকম কোন সরল জীব হতে পারে, যদিও সেটা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না। কিন্তু প্রফেসর ডকিন্স বা অন্য কোনো বিবর্তনবাদী একই দাবি করলে তারা বালির মধ্যে মাথা গুঁজে থাকেন! কেউই তেড়ে যেয়ে তাকে বিজ্ঞানে অজ্ঞ বলেন না কিংবা হাইকোর্ট দেখানোরও চেষ্টা করা হয় না!
- আমার কোনো এক লেখায় বলা হয়েছিল, “প্রফেসর ডকিন্সের বিশ্বাস অনুযায়ী ছাগলের মতো কোনো এক স্থলচর প্রাণী থেকে তিমির মতো জলচর প্রাণীর বিবর্তন এর কথাই ধরা যাক।” এই কথার উপর ভিত্তি করে এক বিবর্তনবাদী বলেছেন, “কুযুক্তিটা ব্যাপক ইন্টারেস্টিং। এতো কিছু থাকতে নিরীহ ছাগুদের টানাটানি করার ব্যাপক প্রতিবাদ জানাচ্ছি।” অথচ এই মন্তব্যের জবাবে প্রফেসর ডকিন্সের ভিডিও লিঙ্ক দেয়া হলে আর কিছু বলেন না! তার মানে তারা নিজেরাই এ-রকম কোনো কল্পকাহিনীতে বিশ্বাস করেন না! কিন্তু প্রফেসর ডকিন্স বললে ঠিক আছে!
- বিবর্তনবাদ তত্ত্বে সংশয়বাদীরা একটি প্রজাতি থেকে নতুন কোনো প্রজাতির বিবর্তনের পক্ষে পরীক্ষা-নিরীক্ষা লব্ধ বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেখাতে বললে বিবর্তনবাদীরা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ক্যান্সার, ও মেডিসিন নিয়ে গবেষণার উপর কিছু পেপার বা প্রবন্ধের লিঙ্ক দিয়ে আমজনতাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেন, যেগুলো আসলে জানতে চাওয়া হয় না! অর্থাৎ প্রমাণ চাওয়া হয় এক জিনিসের কিন্তু দেখানো হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। কিছুটা ‘হাত সাফাই’ বলা যেতে পারে।
বিবর্তনবাদীদের আত্মপ্রতারণার এ-রকম উদাহরণ আরো আছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তারা নিজেরাই বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের নামে প্রতিনিয়ত এমন সব অদ্ভুত দাবি করছেন যেগুলো আসলেই হাস্যকর। কিন্তু তাদের দাবিকে উদ্ধৃত করে অযৌক্তিক ও হাস্যকর বলার সাথে সাথে কেউ কেউ বেনামে এসে না জানার ভান করে সেগুলোকে উল্টোদিকে আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে হাসি-ঠাট্টা কিংবা আক্রমণ করবে। ‘মৌলবাদী’ বলতে যদি খারাপ কিছু বুঝায় তাহলে এরাও এক শ্রেণীর মৌলবাদী।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১১:৩৯