somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিউলি ফুটুক আর নাই ফুটুক- আজ অক্টোবর

০১ লা অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ৭:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সুজিত সরকার পরিচালিত অক্টোবর বলিউডে বসেও খুব ভিন্ন একটা গল্প বলার চেষ্টা করেছে। ভিকি ডোনার, পিকু তারপর অক্টোবর, সুজিত আর জুহি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন তাদের কমফোর্ট জোন ভেঙে নতুন কিছু করার। হঠাৎ করে কোমায় চলে যাওয়া এক মেয়ে আর নিরন্তর তার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকা এক ছেলেকে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে অক্টোবর।


অক্টোবর একটা দীর্ঘ সময় পালাক্রমে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো পরিবেশে আমাদের যেতে বাধ্য করে- (ফাইভ স্টার) হোটেল আর হাসপাতালে। হোটেলের পরিবেশটা আরামদায়ক হলেও, আমরা সেখানে থাকতে চাই না। কারণ আমাদের মন ও মনোযোগ পড়ে আছে, শিউলির কাছে। কিন্তু সেখানকার অবস্থাও কি খুব ভালো? সারাক্ষণ মেশিনের শব্দ, মৃত্যুর পায়চারি আমাদের মাঝে অসোয়াস্তির জন্ম দেয়। তাও ভালো, জন্ম-মৃত্যু-আত্মা নিয়ে এত কথা হলেও, কোন চরিত্র হঠাৎ করে সজোরে মনোলগ দিতে শুরু করে না।

জুহি চতুর্বেদী মেয়েটাকে আমার চমৎকার লাগে। যাপিত জীবনের সাধারণ সব ঘটনার মাঝে লুকিয়ে থাকা হিউমার তার নির্ঘুম চোখে ধরা পড়ে। বাঙালীদের স্বভাবজাত বাঙালীপনা কোনও বাঙালীও তার মতো এতো স্নেহার্দ্রতা নিয়ে ধরতে পারেননি। অক্টোবর সিনেমার একটা দৃশ্যের কথা আলাদা করে বলি। যেখানে ড্যান ও শিউলির মায়ের প্রথম (ও শেষ) বারের মতো দেখা হয়। দুই মায়ের সংলাপ, নীরবতা, অব্যক্ত বেদনাগুলো খেয়াল করুন। যে কথাগুলো আমাদের মা-বাবারা সারা জীবনেও আমাদের সামনে উচ্চারণ করেন না, আরেক মা কিংবা বাবার সাথে কিন্তু তারা অকপটে সেটা ভাগাভাগি করে নিতে পারেন। আমার মনে হয় না, এখনকার অন্য কোন লেখকের পক্ষে এত মাস্টারফুলি এই দৃশ্যটা লেখা সম্ভব হতো। ভালো কথা, জুহি-ও কিন্তু একটা ফুলের নাম। অনেকটা শিউলির মতো দেখতে সেই ফুলকে বাংলায় আমরা জুঁই নামে ডাকি।

আমি জানি না, জুহির মূল স্ক্রীপ্টে দানিশ ওয়ালিয়া (ওরফে ড্যান) চরিত্রটি এমনই ছিলো কিনা। কারণ বেশ কিছু সিকোয়েন্স দেখে মনে হয়েছে, কিছুটা স্ক্রীপ্ট ডক্টরিং করা হয়েছে। যাতে করে সেগুলো ভারুণ ধাওয়ানের সীমিত অ্যাক্টিং স্কিলের জন্য অভাবনীয়রকম চ্যালেঞ্জিং না হয়ে দাঁড়ায়। ড্যান কিন্তু আমাদের নিত্যদিনকার কোন বাস্তববাদী যুবক নয়। হি ইজ লাইক আ ম্যান-চাইল্ড। তার ইনটালারেন্ট বিহেভিয়ার (অল্পতেই রেগে ওঠা বা বিরক্ত হওয়া), স্পিচ প্যাটার্ন (অনুনাসিকভাবে একটু সুর দিয়ে কথা বলা) আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ (একটু কুঁজো হয়ে, দুলে দুলে হাঁটা) বুঝিয়ে দেয় শরীরটা বেড়ে উঠলেও, ড্যানের ভেতরকার শিশুটা এখনো তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

ড্যানের চরিত্রের এই শিশুতোষ একগুঁয়েমির জন্যই, মুভিতে তার কর্মকাণ্ডগুলো আমরা মেনে নেই। অন্য কোন স্বাভাবিক চরিত্র যদি নিজের গোছানো জীবন ছুঁড়ে ফেলে ড্যানের মতো আচরণ করতো, সেটা আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ঠেকতো না। শিউলির অন্য সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া (বা প্রতিক্রিয়াহীনতা) এখানে মনোযোগের দাবীদার। এরা যেন আমাদের এখনকার পুরো প্রজন্মটাকে প্রতিনিধিত্ব করছে। ড্যানের বন্ধুরা তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাবার চেষ্টা করলেও, সাহায্য করা কিন্তু বন্ধ করেনি। মানুষ হিসেবে তারা খারাপ নয়। কিন্তু জীবন নামের ট্রেনে তারা এমনভাবে চেপে বসেছে যে, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ফেলে আসা কোন স্টেশনের দিকে ফিরে তাকাতে পারছে না। নির্লিপ্ততা তাদের চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিউলি আসলেই ড্যানকে ভালোবাসতো কিনা, সেটা কখনো স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়নি। শিউলির সাথে আমরা আসলে খুব বেশি পরিচিত হবারও সুযোগ পাইনি। ইন ফ্যাক্ট ওর নামটা আমরা প্রথম জানতে পারি, সে বিল্ডিং থেকে পড়ে যাবার পর। যত ছবি এগোতে থাকে শিউলি আর শিউলি ফুল যেন মিলে মিশে একাকার হতে থাকে। একসময় ওর মুখের কাটা দাগটাও শিউলি ফুলের প্রতিরূপ হয়ে পড়ে। এক সাক্ষাতকারে পড়েছিলাম, পরিচালক জন পিয়েরে জনেত এমিলি মুভির জন্য অদ্রে টটুকে বেছে নিয়েছিলেন তার চোখের জন্য। এমিলি মুভিতে যেহেতু সংলাপ অনেক কম ছিলো, টটুর এক্সপ্রেসিভ চোখই দর্শকের সাথে চরিত্রের সেতু বন্ধনে সহায়তা করেছে। আমার ধারণা, বানিতা সান্ধুকে কাস্ট করার পেছনেও পরিচালক সুজিতেরও একই উদ্দেশ্য ছিলো। এই মেয়েটার চোখ অদ্ভুত রকম বিষাদে পরিপূর্ণ।

আর মায়ের চরিত্রে গীতাঞ্জলি রাও আমাকে স্রেফ মুগ্ধ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে অ্যানিমেশন ফিল্ম ডিরেক্টর এই ভদ্রমহিলার কাজ দেখে কে বলবে তিনি প্রফেশনাল অভিনেত্রী নন! অ্যাক্সিডেন্টের পর হতবিহবল মা, বেদনার্ত মা, প্রথমবার "আম্মা" ডাক শুনে হেসে ওঠা মা- প্রতিবারই তিনি ছিলেন অসাধারণ।

ক্যামেরায় ছিলেন অভীক মুখোপাধ্যায়। শুনেছি, চোখের বালি সিনেমায় তাকে ঐশ্বরিয়া-প্রসেনজিতের চেয়েও বেশি পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছিলো। কারণ ঋতুপর্ণের মতে ঐ সিনেমায় সবচে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ছিলেন অভীক। অক্টোবরে প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো, বিশেষ করে শিউলি'র ফুল কুড়ানোর দৃশ্যটা সফট ফোকাস আর ন্যাচারাল লাইট মিলিয়ে একটা স্বর্গীয় বিভ্রম তৈরী করে। শান্তনু মৈত্রের মায়াবী আবহ সঙ্গীতও পুরোটা সময় ক্যামেরার সাথে সঙ্গত হিসেবে কাজ করেছে।

হাসপাতালে যাবার আগে শিউলির শেষ বাক্য ছিল, "ড্যান কোথায়?"। ড্যানের জীবনে মনে হয় এর চেয়ে সত্য কোন বাক্য আসেনি। সে তো সবার সামনে থেকেও অদৃশ্য ছিলো। ছবির প্রাথমিক অংশে আমরা দেখি, ড্যান যেখানেই যায়, অযথা বাগাড়ম্বর করে নিজের উপস্থিতি জানান দেবার চেষ্টা করে। নিজেকে খুঁজতে থাকা, নাবিকবিহীন নৌকার মতো দিশেহারা ভাবে ভাসতে থাকা ড্যানকে এই প্রশ্নটা ডুবিয়ে মারেনি, বরং নোঙর ফেলতে সাহায্য করেছে। সম্ভবত সে জীবনে প্রথমবারের মতো কোন স্বপ্নও খুঁজে পায়, শিউলিকে বাঁচিয়ে তোলার স্বপ্ন। শিউলির সংজ্ঞা ফিরে পাবার মূল কৃতিত্বটাও কিন্তু ড্যানেরই প্রাপ্য (আসগার ফারহাদির ফরাসী ছবি দ্য পাস্টেও এমন একটা বিষয়ে উঠে এসেছিল)। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, মৃত্যুর পূর্বে শিউলির বলা শেষ শব্দটিও ছিল "ড্যান"।

হাসপাতালের দৃশ্যগুলো কিংবা শিউলির স্বাভাবিকতা ফিরে পাবার দৃশ্যগুলো খেয়াল করুন। খুব ডিটেইলসে সব দেখানো হয়েছে, কোন কিছু শুগারকোট করা হয়নি। সুজিত আমাদের একটা মেসেজ খুব স্পষ্টভাবে দিতে চেয়েছেন। এটা এমন কোন রোম্যান্টিক পরিস্থিতি নয় যে একরাত বিছানার পাশে বসে পানিপট্টি দিলে, সকালে প্রেম হয়ে যাবে। এই সম্পর্কে ঢুকলে কমিটমেন্টের সর্বোচ্চ মাত্রার পরীক্ষা হবে আর সেই পরীক্ষা থেকে কোন প্রতিদান পাবার সম্ভাবনাও প্রায় শূন্য। শুধু নিঃস্বার্থভাবে দিয়ে যেতে হবে।

ড্যান, শিউলি, মানজিৎ, ঈশানী এরা চারজনেই একসাথে চাকরি করতো। একই বয়স ও পেশার প্যারালাল গ্রাউন্ডে দাঁড়া করাবার পর, দুটো সম্পর্কের বৈপরীত্য তুলে ধরা হয়। ছবির মাঝ পথে আমরা জানতে পারি মানজিৎ আর ঈশানী একটা নন কমিটেড, ক্যাজুয়াল লিভ-ইন রিলেশনশিপে আছে। আর মুদ্রার অপর পীঠ হিসেবে আমরা দেখি ড্যান আর শিউলিকে। যাদের সম্পর্কটা এতটাই প্লেটোনিক, এতটাই আনকন্ডিশনাল যে একসময় সেটা ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে আরও নিবিড় এক বৃত্তে প্রবেশ করে; পরিণত হয় মমত্ববোধে। একটা ছোট্ট শিশুকে যেভাবে যত্ন নেওয়া হয়, শিউলিকেও ড্যান সেভাবে কথা বলতে আর লিখতে শেখায়, কোলে করে বিছানায় নেয় ঘুম পাড়াবার জন্য। তাই হয়তোবা পৃথিবী ছাড়ার আগে শিউলি শেষবারের মতো ড্যানকে এক ঝলক দেখতে আসে।

অক্টোবর শেষ হয় দানিশ আর "শিউলি"-এর নতুন ঠিকানার পথে যাত্রার মাধ্যমে। আমাদের পেছনে ফেলে রেখে তারা এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ওদের গল্পে এর চেয়ে বেশি প্রবেশাধিকার আমাদের নেই। সেটার হয়তো খুব একটা প্রয়োজনও নেই। কারণ আমাদের দর্শক মন প্রশান্তি পায় এই ভেবে- "যাক, ওরা একসাথে আছে!"
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ৩:৪৯
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×