(ভ্রমণগল্প এবং দার্জিলিং ঘুরার পূর্ণ গাইডলাইন )
দার্জিলিং ,হ্যাঁ এবারের গল্পটা দার্জিলিং এর ।
দার্জিলিং, পশ্চিবঙ্গের বিখ্যাত টুরিস্ট প্লেস । সীমান্তবর্তী বলুন আর ভাষাগত কারণেই বলুন বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারতের যতগুলো টুরিস্ট স্পট আকর্ষণীয় তার মাঝে দার্জিলিং এর নামটা একদম উপরেই থাকবে ।। দার্জিলিং হলো মেঘ আর পাহাড়ের শহর ।। ভূপৃষ্ট থেকে প্রায় ৭ হাজার ফুট উচুতে অবস্হিত দার্জিলিং শহর আর মেঘ ? সেতো সারাদিনই দার্জিলিং শহরে খেলা করে ,মুহুর্তেই চারপাশ ঢেকে যায় মেঘে আবার মুহুর্তে গায়েব ।।
দার্জিলিং শহর
হুম আমরা গিয়েছিলাম দার্জিলিং এর রুপ দেখতে ,অবশ্য আমাদের প্লান আর রুট ভিন্ন ছিলো । আমরা প্রবেশ করেছিলাম সিলেটের তামাবিল বর্ডার দিয়ে তারপর শিলং থেকে গোহাটি হয়ে আট ঘন্টার ট্রেন জার্নি করে পৌছেছি শিলিগুড়ি সেখান থেকে চলে গিয়েছি পশ্চিম বঙ্গের সর্বোচ্চ পবর্ত সান্দাকফু জয় করতে ..চারদিন ট্রেক করে সান্দাকফু জয় করে তারপর চলে এসেছি দার্জিলিং এ ।।
যাবো কিভাবে দার্জিলিং :
আমাদের ভিসার ঝামেলার কারণে আমরা সিলেট দিয়ে অনেক ঘুরে দার্জিলিং আসতে হয়েছে যদিও গোহাটি শহর দেখা আর গোহাটি থেকে শিলিগুড়ির ট্রেন জার্নিটা চমৎকার ছিলো ।।
দার্জিলিং যাবার তিনটি রাস্তা আছে একটি বুড়িমারী বর্ডার আরেকটি বেনোপাল যশোর দিয়ে আর তৃতীয়টি হলো পঞ্চগড়ের বাংলাবান্দা বর্ডার দিয়ে ।
বুড়িমারী বর্ডার : লালমনিরহাট জেলার এই বর্ডার দিয়ে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী দার্জিলিং এ আসা যাওয়া করে ,এই বর্ডারের ভারতের দিকের নাম হলো চেংরাবান্ধা । বর্ডার থেকে শিলিগুড়ি প্রায় ৮০ কিমি দুরে । গাড়ীতে প্রায় দুই আড়াই ঘন্টার মত লাগে শিলিগুড়ি পৌছাতে ।
বেনাপোল : এটি যশোরের দিক দিয়ে বর্ডার ,এদিক দিয়ে প্রবেশ করে দার্জিলিং যাওয়াটা ঝামেলার কারণ কলকাতা থেকে পায় ৫৫০ কিমি দুরে শিলিগুড়ি সেক্ষেত্রে বাস বা ট্রেনে প্রায় ৮-১০ ঘন্টার মত সময় লেগে যায় । যাদের কলকাতা এবং দার্জিলিং দুটোই দেখার ইচ্ছা তারা সাধারণত এ বর্ডার ব্যবহার করে থাকে ।
বাংলাবান্ধা : এই বর্ডার থেকে মাত্র ১০ কিমি দুরেই শিলিগুড়ি অবস্হিত কিন্তু রাস্তাঘাটের অবস্ হা খুব একটা সুবিধার না বলে এই বর্ডার খুব একটা ব্যবহার করা হয়না ।
এয়ারে সরাসরি যাওয়া যায়না এয়ারে যেতে হলে ঢাকা থেকে কলকাতা সেখান থেকে শিলিগুড়ি এয়ারে এভাবে যেতে হবে ।
এমন চা বাগানের মাঝ দিয়ে রাস্তা আপনাকে মুগ্ধ করবে ,গাড়ী দাঁড় করিয়ে ছবি নিতে ভুলবেন না
শিলিগুড়ি শহর থেকে ৭৫ কিমি দুরে দার্জিলিং আপনি রিজার্ভ গাড়ী ১৫০০ রুপিতে পাবেন অথবা শেয়ার করেও যেতে পারেন প্রতিজন ১৫০ রুপি করে নিবে ।। যেটাতে ইচ্ছা সেটাতেই যেতে পারেন ।।
একেবেকে পাহাড়ী রাস্তার অপরুপ সব দৃশ্য উপভোগ করতে করতে কখন যে দার্জিলিং শহরে পৌছে যাবেন বুঝতেই পারবেন না
থাকার ব্যবস্হা কোথায় ?
দার্জিলিং আসার পর আপনার প্রথম কাজ কি ? অবশ্যই আগে একটা ভদ্র সুশিল আরামদায়ক মজাদার থাকার হোটেল তাইনা ?
দার্জিলিং এ আপনি সস্তা থেকে শুরু করে লাক্সরিয়াস হোটেলও পাবেন ।। তবে আমার মতো অধিকাংশদেরই প্রথম পছন্দ মাঝারি মানের তাইনা ? বেশি দামিওনা আবার একেবারে কমদামি সস্তা হোটেলও না ।।
সবাই যেখানে ছিলাম সে হোটেলের বারান্দা থেকে ভিউ ,কিছু কিছু হোটেল থেকে এই ভিউটা পাওয়া যায় তাই হোটেলে উঠার সময় এমন ভিউ আছে কিনা দেখে নিবেন ,আমরা ছিলাম নাসিকুরাং হোটেলে
দার্জিলিং এ একটা ট্রাফিক মোড় আছে যাকে বলে ক্লাব স্ট্যান্ড এটাই শহরের মধ্য পয়েন্ট এর চার দিকে চারটা রাস্তা চলে গেছে আপনি চারটা রাস্তাতেই হোটেল পেয়ে যাবেন ।। দেখে শুনে বাজেট অনুযায়ী হোটেল নিয়ে নিন ট্রাফিক পয়েন্ট থেকে রাস্তাগুলো ধরে যত ভিতরে যাবেন ততই কমদামে হোটেল পাবেন ।। যদি ঠান্ডা বেশি থাকে তাহলে হোটেলে গরম পানির ব্যবস্হা আছে কিনা জেনে নিবেন ।
দার্জিলিং এর ভালো মানের হোটেলগুলোর মধ্যে হোটেল সোনার বাংলা ,হোটেল ব্রডওয়ে অন্যতম যেখানে বাংলাদেশীদের খুব সম্মান করে রাখে এছাড়া কিছুটা কমের মধ্যে হোটেল নিসিকুরাংও ভালো
ঘুরবো কোথায় দার্জিলিং
ঘুরোঘুরির জন্য অসম্ভব সুন্দর জায়গা হলো দার্জিলিং ,সবগুলো প্লেস আরাম করে দেখার জন্য দেড় / দুইদিন যথেষ্ট ।। চাইলে একদিনেও প্রধান প্রধান টুরিস্ট প্লেসগুলো কভার করা সম্ভব ।। আমরা কিন্তু একদম ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যার মাঝে একদিনেই শেষ করেছিলাম কারণ আমাদের সময় কম ছিলো ।।
আমাদের দল দার্জিলিং শহর থেকে রকগার্ডেনে যাবার সময় তোলা
টুরিস্ট প্লেসগুলোর অধিকাংশই শহরের আশে পাশে তাই জার্নি কমই লাগবে
টাইগার হিল -১০ হাজার ফুট উচু এখানে সবাই খুব ভোরে গাড়ীতে যায়,কান্জনজজ্ঞাতে সূর্যোদয় দেখার জন্য
অসাধারণ হিমালিয়ান মাউন্টরিং ইন্সটিটিউট এবং চিড়িয়াখানা
চা বাগান আর পাহাড়ের উপর দিয়ে ক্যাবল কারে ৪৫ মিনিটের ভ্রমণ /রুপওয়ে
চায়ের জন্য বিখ্যাত হ্যাপি ভ্যালি টি গার্ডেন
ছবির মতো সাজানো জাপানিজ ট্যাম্পল
টয় ট্রেন যেখানে মোড় ঘুরে সেই বাতাশিয়া লুপ
প্রার্থনা কেন্দ্র ঘুম মনেস্ট্রি
দিরদাহাম টেম্পল
গঙ্গামায়া পার্ক
রক গার্ডেন
দার্জিলিং এর গোরখা স্ট্রেডিয়াম
দড়ি ধরে পাহাড় বেয়ে উঠার জন্য টেনজিং রক ও গুম রক ,এটা ট্রাই করতে পারেন মজার একটা অভিজ্ঞতা হবে
রাজভবন
এছাড়া আরও আছে টয় ট্রেনে জয় রাইড পুরো শহর টয় ট্রেনে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ তবে দামটা একটু বেশিই এক হাজার রুপি প্রতিজন ।। আমরা দাম শুনে না ঘুরেই চলে আসছি ।।
এটাকে বলে বাতাশিয়া লুপ ,এখানে টয় ট্রেন এসে ঘুরে যায়
জাপানিজ ট্যাম্পেল
এগুলোই মোটামুটি দার্জিলিং এ ঘুরে বেড়ানোর জায়গা ।। আপনি লিস্টটা ড্রাইভারকে দেখাবেন যে আপনারা প্রতিটা জায়গাতে যেতে চান ।। সে অনুযায়ী ভাড়া কত হয় । ।
যাদের হাতে বেশি সময় বা আরওএ ঘুরতে চান তারা একদিনের জন্য মিরিক লেক চলে যেতে পারেন গাড়ী রিজার্ভ করে অথবা কালিম্পংও ঘুরে আসতে পারেন ।।
প্রতিদিনের জন্য গাড়ী রিজার্ভ চারজন বসার মতো ১ থেকে দেড় হাজার আর আট/নয়জন বসার মতো দুই হাজার থেকে তিন হাজার রুপি সর্বোচ্চ ।।
ও আরেকটা কথা বলতেই ভুলে গেছি দার্জিলিং শহরের ভিতরে একটা চত্বর আছে নাম মল চত্বর /মল রোড এখানে বিশাল বসার স্হান ।। সবাই এখানে এসে আড্ডা দেয় । জায়গাটা পাহাড়ের উপরে ।। এখানে অবশ্যই ঘুরতে যাবেন রাতের বেলা ।। চমৎকার একটা জায়গা নানা ধরনের মানুষ আড্ডা দিচ্ছে গান গাচ্ছে ভালোই লাগবে ।। আমরা প্রতিদিন রাতে হোটেলে খেয়ে দেয়ে এখানে আড্ডা দিতাম ।
দার্জিলিং যাবার ভালো সময় কোনটা ?
দার্জিলিং এ একেক সময় একেক রুপ থাকে তবে দার্জিলিং ঘুরে আসার বেস্ট সময় হলো এপ্রিল টু জুন । এ সময় আবহাওয়া অনেক পরিষ্কার থাকে আর হালকা হালকা শীত অনুভুত হয় ।। বেস্ট সিজন এটাকেই বলা যায় এছাড়া বর্ষার শেষে সেপ্টেম্বর অক্টোবরেও যেতে পারেন । তারপর গেলে শীতের প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন ।। তবে কম দামে চমৎকার সব শীতের কাপড় পাবেন দার্জিলিং এ
খাবার দাবার
এ অংশটা লিখতে আমি মোটামুটি এক্সাইটেড কারণটা হলো দার্জিলিং এ খাবার দাবারের একটা টিপস আপনাকে আমি জানাবো ,দার্জিলিং এ সব ধরনের খাবার পাবেন তবে আমরা বাঙ্গালী মুসলিম যারা গরু ছাড়া খাবার দাবার জমেনা তাদের জন্য একটা স্প্রেশাল খাবারের দোকান আছে ।। দার্জিলিং এ মসজিদের পাশে মুসলিম হোটেল আছে নাম ইসলামিয়া হোটেল ,এখানে আপনি সস্তায় গরুর মাংশ খেতে পারবেন গরুর প্লেট মাত্র ৩০ টাকা কলিজি ২০ টাকা !!!!!! কম দামে ধুমাইয়া সুস্বাধু খেতে এর কোন বিকল্প নেই ।। আমরা সকাল সন্ধ্যা রাত সব বেলা এই হোটেলেই খেয়েছি ।। দার্জিলিং এ যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই হবে ভাই মুসলিম হোটেল কোথায় অথবা মসজিদটা কোথায় ।।
কেনাকাটা
কেনাকাটার জন্য দার্জিলিং খুব ভালো জায়গা বিশেষ করে শীতের কাপড় চোপড় জ্যাকেট ইত্যাদি কেনার জন্য ।। কম দামে খুব ভালো ভালো শীতের জ্যাকেট চাদর ইত্যাদি পাবেন । তবে দাম দর করে নিবেন এখানে প্রচুর দাম চায় । আমাকে একটা শীতের শাল দাম চেয়েছে ১২০০ রুপি আমি এনেছি ৩০০ রুপি দিয়ে এবার বুঝুন অবস্হা ।।
ভাই সবতো বললেন এবার খরচটা বলেন ?
হুম এত ক্ষনে আসল কথা মনে পড়ছে সবতো বুঝলেন তাহলে ঘুরে আসতে কেমন খরচ হতে পারে তার একটা ছোট্র আইডিয়া দেই ।।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার ভিতরে আপনি আমার করেই ঘুরে আসতে পারবেন দার্জিলিং ।
দার্জিলিং এর অনেক কিছুই জানলেন এবার দার্জিলিং গিয়ে যারা আরও বেশি কিছু দেখতে চান বা আরও ঘুরতে চান তাদের জন্য দার্জিলিং এর আশেপাশে আরও দুইটি নতুন শহরের এর কথা বলি যেখানে আপনারা ঘুরে আসতে পারেন
ক্যালিম্পংঃ
দার্জিলিং থেকে প্রায় ৫০ কিমি দুরের একটি শহর । দার্জিলিং থেকে গাড়ী রিজার্ভ করে ক্যালিম্পং যেতে হবে এবং ভাড়া পড়বে ৩০০০- ৩৫০০ রুপি প্রতি গাড়ী। ভাড়া করার সময় বলে নিবেন কোথায় কোথায় যেতে চান। আর একটু সকাল সকাল বের হলে সবকিছু দেখে ঐদিনই ফেরত আসতে পারবেন। কালিম্পং যা যা দেখতে পারবেন
১। তিস্তা ও রঙ্গিত নদীর মিলনস্থল। ২। ক্যাকটাস নার্সারি। ৩। Durpin মনেস্ট্রি। ৪। ক্যালিম্পংয়ের highest point Durpin পাহাড়। এখান থেকে ভিউটা অনেক সুন্দর। ৫। ডিওলো হিল (এখানে প্যারাগ্লাইডিং করতে পারবেন এবং অঞ্জন দত্তের বিখ্যাত কাঞ্চনজংঘা গানের ট্যুরিস্ট লজও দেখতে পারবেন) ৬। ডাঃ গ্রাহামের বাড়ী। ৭। হুনুমান মন্দির।
ও হ্যাঁ কালিম্পং এ স্পেশাল একটা ব্যাপার হলো এখানে আপনি প্যারাগ্লাইডিং করতে পারবেন ,পুরো শহর থাকবে আপনার পায়ের নীচে আর আকাশে পাখা মেলে উড়বেন আপনি
এছাড়া তিস্তা নদীতে করতে পারেন রাফটিং করতে পারবেন যা আপনাকে লাইফ টাইম অভিজ্ঞতা দিবে
. তিস্তা নদীতে রাফটিং, কালিম্পং এ প্যারাগ্লাইডিং
মিরিখ :
মিরিক লেক দার্জিলিং থেকে দূরত্ব ৬০ কিঃমিঃ এবং সময় লাগবে ২ঘন্টা ৩০ মিনিট রিজার্ভ গাড়ী ৩ হাজার রুপির মতো নিবে ।
মিরিখে যা যা দেখতে পারবেন ১। সুমেন্দু লেক ( এখানে গাড়ি লাগবেনা। পায়ে হেটে অথবা ঘোড়ায় করে)। ২। সুইচ কটেজ। ৩। ডন বোসকো চার্চ। ৪। Bakar chockhor মনেস্ট্রি ( এখান থেকে সুমেন্দু লেকের ভিউটা অসাধারন)। ৫। কমলা বাগান। ৬। সানরাইজ ভিউ পয়েন্ট।
এখানে লেকে নৌকা নিয়ে ঘুরবেন এবং লেকের পাশের ৩.৫ কিঃমিঃ রাস্তায় Horse riding করবেন। এই রাস্তাটাও অসাধারন। একপাশে লেক আর অন্যপাশে পাহাড় ও তাতে পাইনের ঘন বন। লেকের উপরে রংধনু সেতুটাও সুন্দর। এখানেও আপনি সকাল সকাল রওনা দিলে সন্ধ্যার মধ্যে দার্জিলিং ফেরত আসতে পারবেন।
যদি ৬-৮ জনের দল হয় তাহলে দার্জিলিং ভ্রমনের সাথে ২ দিন ও ২৫০০/- রুপি (থাকা, খাওয়া ও ঘোরা) যোগ করলে আপনি ক্যালিম্পং ও মিরিখের সৌন্দর্য্য সুধা পান করতে পারবেন অনায়াসে।
ভালো থাকবেন।
সাবধানে থাকবেন।
ভ্রমন হউক সুন্দর।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




