তাই যখন শুনলাম মেঘদলের দ্বিতীয় এ্যলবাম বের হইছে তখন কিনতে দ্বিধা করি নাই। একটু ভয় ছিলো, যে ভালোবাসা জন্মাইছে তা না আবার নষ্ট হইয়া যায়। শুনার পরে বুঝলাম এই জিনিস না শুনলে কি মিস করতাম। একটা এ্যলবামের সব গান বা ২/১ টা বাদে বাকি সব গান ভাল্লাগছে এইরকম অনুভূতি খুব বেশিবার হয়নাই। অনেকদিন পরে সেই অনুভূতি পাইলাম। এক একটা লাইন, এক একটা গান যেন একেবারে মনের অতলে গিয়া নাড়া দেয়। চোখ বন্ধ করে শুনলে চারপাশে অন্য রকম একটা জগতের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মাথার ভিতর সবকিছু কেমন জানি ওলটপালট হয়ে যায়।
এ্যলবামের শুরু "মুঠোফোন" দিয়ে।
"করতলে ছিন্ন মেঘের স্বর/লোকাল বাসে বাড়ি ফেরা প্রিয় মুখ/হৃদয়ের কাছে ব্যর্থ মুঠোফোন/দিন রাত্রি গুন গুন গুন/হ্যালোজেন রোদ চিলতে বারান্দায়/টিকটিকি তাই বলছে ভবিষ্যৎ..."
অনেকের কাছে শুনছি এইটা খুব বেশি পছন্দ হয় নাই। আমার কাছে ভাল্লাগছে। অসাধারণ কম্পোজিশন প্লাস শিবু ভাই (শিবু কুমার শীল)-এর অদ্ভুত গলার কাজ।
এরপরে আসে "সব ঠিকঠাক যখন বলো/ওলোটপালট হয়ে যায়/এলোমেলো সব হয়ে যায়..."। মেজবাউর রহমান সুমনের গাওয়া। এইটাও আমার অনেক পছন্দ। শুনতে শুনতে মনে হয় আসলেই কোনো কোনো সময় সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়, সব ঠিকঠাক আছে শোনার পরেও।
"শুন্যতায় ঢেকে গেছে/শহরের সব পথঘাট/ফিরবে না গতকাল জানি/ফিরবে না আগামীকাল/তবু চাইছি তোমাকেই/তুলে নিতে অঞ্জলিতে/রোদের ফোঁটা"--- একটা নিরন্তর শুন্যতার অনুভূতি নিয়া তিন নাম্বার গানটার শুরু এইভাবে। আমার কাছে এইগানের দুইটা জিনিস অদ্ভুত ভাল্লাগে। একটা হইলো মাঝামাঝি সময়ে বাঁশির কাজ আর দ্বিতীয়টা শেষের কথাগুলা - "শুন্যতার শোকসভা/শুন্যতার যত গান/ দিলাম তোমার মুকুটে/ আমার যত অভিমান"। এইভাবে সব অভিমান কাউরে দিয়া ফেলতে পারলে ভালোই হইতো, বাঁইচা যাইতাম।
টাইটেল "শহরবন্দি" আসে পাঁচে। "শহরবন্দি মেঘ/ ঘুরে ঘুরে একা/ আমাদের এই সূবর্ণনগরে/ আমিও পেতেছি কান/ শুনি বৃক্ষের ক্রন্দন/ ধূসর রাজপথের প্রান্তরে/ চন্দ্রগ্রস্ত ভোর বল বিদায়, বিদায়/ তুমি এখনো দেখো সূর্যলোকের ঘোর/ তুমি গাইতেই পার গান এই সূবর্ণনগরে/ ভুলে যেতে পারো ইতিহাস অর্থহীন অদরকারে..."। এইটা যথারীতি ওদের প্রথম এ্যলবামের প্রথম গানটার মতই পাগল করা একটা গান। টাইটেল সং হিসাবে পার্ফেক্ট।
এই এ্যলবামের কোন গানটা আমার সবথেকে প্রিয় জিজ্ঞেস করলে ঝামেলায় পড়ে যাব। তবে "পাথুরে দেবী" গানটার আবেদন অন্য সবগুলা থেকে কেনো জানি একটু বেশিই মনে হয়।
"পাথুরে দেবীর পাতার পাখনা গায়ে
স্নানের জলে নিহত অগ্নিমাছ,
নৌকোমানুষ
সূর্যের দিকে যাই।
ট্রাফিক ভীড়ে সহস্র পঙ্খিরাজ।
আনমনা লোকটা
এখনো দাঁড়িয়ে একা
রোজকার রেলগাড়ি
রেলগাড়ি বিকেল,
ময়দানে লড়াই
মহিষে মহিষে আজ
খুন হবে কোজাগরি চাঁদ।
সিলিংয়ে ঝুলছে রূপবতী লাশ
মহাশূন্যের মত একা,
শহরে আজও বৃষ্টি হবে না তাই
কাঁচপোকাদের নেই দেখা।
জলজ ঘ্রাণের নুন
অনেকটা প্রাচীন
খোলসের মত আছে পড়ে,
করোটির ভেতরে জমাট অন্ধকার
অক্ষরগুলো শুধু ওড়ে।"
এই গানের কথাগুলাই অসাধারণ লাগে। সুর আর গায়কি তো বাদই দিলাম। আর শেষের লাইনগুলা একদম অন্যরকম।
"দূর পৃথিবী" গানটার কথা একটু বলি। গানটার শুরুটা অলসভাবে, মাঝামাঝি জায়গায় এসে হঠাৎই একটা ওলোটপালট বাঁশির সুরের সাথে "ঘোর লাগা কিছু সন্ধ্যা আর ব্যর্থ যত স্বপ্ন বেরঙ্গিন/ শুনতে কি চাও আমাদের পরাজয় রাত্রিদিন" কথাগুলা একদম ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর শেষদিকের সুর আরও অন্যরকম।
আর একটা গানের কথা না বললে এই এ্যলবামের অসম্মান করা হয়। "নির্বাণ" শিরোনামে এইটা আসে একদম শেষে। শেষের কয়েকটা লাইন এইরকম --- "কিছু বিষাদ্গ্রস্ত দিন/ ছিলো প্রেমিকার চোখে জমা/ আলো নেই, রোদ নেই/ কিছু বিপন্ন বিস্ময়/ ক্ষমাহীন প্রান্তর জুড়ে/ আমাদের বেঁচে থাকা"। কেন জানি খুব সত্যি মনে হয় কথাগুলা।
একটা সীমাহীন খাঁ-খাঁ শূন্যতা আর অব্যক্ত দুঃখ জমা রেখে এ্যলবাম শেষ হয়। শেষ হয়না ভালোলাগা।
------------------------------------------------------------------
গানগুলি শোনা হয়ে গেছিলো বহুদিন আগেই। শোনার পরেই ভাবছিলাম এইরকম কিছু একটা লিখবো। কিন্তু যে কারণে একটা খুব ভালো লাগা মুভ্যি অথবা কোন ঘটনা নিয়া লিখব লিখব করেও শেষপর্যন্ত আর লেখা হয়না কখনো, সেই কারণে এইটাও লেখা হয় নাই। আজকে হঠাৎই গানগুলা শুনতে শুনতে ঘোরের মধ্যে লিখে ফেললাম।
বিমা ভাইয়ের গানের পোস্টগুলি খুব মিস করি। এই লেখাটা উনারে উৎসর্গ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




