রুমীর চলে যাওয়া
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইমাম (রুমী)। এই রুমী এবং একাত্তরের স্মৃতি নিয়েই তাঁর জননী জাহানারা ইমামের বিখ্যাত গ্রন্থ একাত্তরের দিনগুলি। রুমীর পিতা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার শরীফ ইমাম। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পিতার পথ অনুসরণ করেই রুমী আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, ঢাকা কলেজ হয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিল। সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরু। ঘরে মন টিকছিল না। মে মাসের প্রথমদিকেই একবার চেষ্টা করেছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য চলে যেতে। কিন্তু পথ বিপৎসংকুল হওয়ায়, আর্মি ক্যাম্প হওয়ায়, অন্য পথের খবর না পাওয়ায় ফিরে আসতে হয়েছিল। পরে জুনের মাঝামাঝি সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ২ নম্বর সেক্টরের মেলাঘর ক্যাম্পে পৌঁছায়। এরপর শুরু হয় ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে গেরিলা অপারেশনে সরাসরি অংশগ্রহণ।
রুমীর সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে। সুন্দর চেহারার উচ্ছল ও প্রাণবন্ত তরুণ রুমী ছিল বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। যত দূর মনে পড়ে—আলম, হ্যারিস, কাজী, বদি, স্বপন—এদের সঙ্গেই বেশির ভাগ সময় দেখতাম। ঢাকায় বিভিন্ন অপারেশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করত। দেখা হলে এসব দুঃসাহসী অপারেশনের কথা শুনতাম। খুব ভালো লাগত। আগস্ট মাসের দিকে ঢাকায় অপারেশনগুলো আরও জোরদার হলো। মেলাঘর ২ নম্বর সেক্টর থেকে বিভিন্ন গ্রুপে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক অস্ত্রশস্ত্রসহ বড় ধরনের অপারেশনের লক্ষ্যে ঢাকায় ঢুকেছিল। আমাদের গ্রুপে চারজন—আমি, ফাতেহ আলী, বাকের ও কমল একই সময় অনেক অস্ত্র-গোলা নিয়ে ঢুকি। প্রতিদিনই ঢাকায় কোথাও না কোথাও অপারেশন চলছিল। খবরও পাচ্ছি। এভাবে আগস্টের দিনগুলো যাচ্ছিল বেশ উত্তেজনার মধ্য দিয়ে।
৩০ আগস্ট ভোরবেলা দেশবরেণ্য সুরকার আলতাফ মাহমুদের বাসা পাকিস্তানি সেনারা ঘিরে ফেলে। আমি রাতে ওই বাসায় ছিলাম। আলতাফ মাহমুদ ও অন্যদের সঙ্গে আমাকেও ধরে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়া হয় মার্শাল কোর্টে। সেই সময়ের সংসদ ভবনসংলগ্ন এমপি হোস্টেলে। ওখানে দেখলাম, আমাদের অনেকেই ধরা পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধা, তাদের আত্মীয়স্বজন, পরিচিত অনেকেই রয়েছে এর মধ্যে। সেই পরিচিত মুখগুলোর মধ্যে ছিল রুমী, জুয়েল, বদি, হাফিজ, চুলু ভাই, বেলায়েত ভাই (ফাতেহ আলীর দুলাভাই), উলফাতের বাবা, আলমের ফুফাসহ আরও অনেকে। রুমীকে শুধু এক দিনই দেখেছি। রুমীর পিতা শরীফ ইমাম ও তাঁর কনিষ্ঠ ছেলে জামীকেও দেখেছি। রুমীকে বেশ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, প্রচণ্ড টর্চার করা হয়েছে। দুপুরের পরে ওকে নিয়ে গেল। তারপর আর দেখা হয়নি। আমাকে ও আমার সহযোদ্ধা অন্য গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন কথা বের করার জন্য অনেক টর্চার করা হয়েছে। রক্তাক্ত হয়েছে দেহ, আঙুলগুলো ভেঙে গেছে; হাত, পিঠ ফেটে রক্ত বেরিয়েছে। থেঁতলে দিয়েছে সারা শরীর। অতএব আমিও জানি, রুমীর কাছ থেকেও কথা বের করতে এই নির্দয় পাকিস্তানি সেনারা কী কী করতে পারেন। রুমীর সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। এখনো তার চেহারাটা চোখের সামনে ভাসে।
রুমীর মা জাহানারা ইমাম ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখিকা, সমাজকর্মী। স্বামী, সন্তান রুমী ও জামী আর আত্মীয়স্বজন নিয়ে ছিল তাঁর একটি সাজানো সুন্দর, আনন্দময়, সচ্ছল সংসার। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি হারিয়েছেন সবকিছু। শুধু জামীকে বুকে নিয়ে স্বাধীন দেশটা পেলেন। কিন্তু উনি যেমন দেশটার কথা ভেবেছিলেন, তেমনটা হলো না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা আবার নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করল, দিন দিন শক্তি সঞ্চয় করল, যার জন্য তিনি নামলেন দেশের শত্রু, স্বাধীনতা-যুদ্ধের ঘাতক-দালালদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রুমীর স্মৃতি বুকে নিয়ে এই আন্দোলন করে গেছেন তিনি।
আবুল বারক আলভী
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?
সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুক্তির কোরাস দল
ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!
নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী
আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিশ্ব কবি
বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।
কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।
সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।
যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন