somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ রাত বারোটা দশ

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নীলিমা শাওয়ারের ঠান্ডা পানিতে স্নান করে যখন বের হলো তখন দেয়ালে টাঙানো ঘড়ি সময় জানাচ্ছে এগারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট।শীত চলে গেছে কিন্ত তার রেশ এখনও কিছুটা অনুভব করা যায়।স্নান সেরে বের হতেই জানালা দিয়ে আসা বাতাসে তার সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।এই অনুভুতিটার সাথে সাথেই একটা আনন্দের রেশ ছড়িয়ে পরে তার মনে।আজ তার জন্য অনেক আনন্দের একটা দিন।তাই তার মনের শিহরন আজ অন্য সব অনুভুতিকে হার মানাচ্ছে।নীলিমা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা নীল টাঙ্গাইল শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নেয় পরিপাটি করে।সাদা মুক্তা দিয়ে তৈরী মালাটি গলায় পড়ে নেয়।অনেক খুঁজে সে তার টিপের পাতাটি বের করে আর সেখান থেকে ছোট্ট একটা কালো টিপ বসিয়ে দেয় কপালের মাঝ বরাবর।নিজের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে আর একটু কিছুর অভাব যেন রয়ে গেল।তারপর আলমারির ড্রয়ার থেকে গোলাপি লিপস্টিকটা বের করে নিজের ঠোঁটে ছুঁইয়ে দেয় হালকা করে।এবার আয়নার দিকে তাকিয়ে সে সন্তষ্টির হাসি হাসে।দেয়াল ঘড়ি সময় জানাচ্ছে এগারটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট।নীলিমা শোয়ার ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে টেবিলের উপর রাখা মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয় প্রথমে।তারপর একে একে বসার ঘর,ডাইনিং রুম সবখানে রাখা মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয় একে একে।মোমের নরম আলো সারা ঘরে একটা মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করে।বাইরে আজ পূর্নিমা,তার কিছু কিছু আলো জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়ছে।মোমের আলোর আভার সাথে মিশে সে আলো এক নতুন আলো সৃষ্টি করছে।সে আলোর ছোঁয়া পেলে মন যেন হঠাত করেই অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়।নীলিমা একবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নেয় সব ঠিক আছে কিনা তারপর জানালার ধারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সেই প্রতিক্ষিত শব্দের।জানালার বাইরে মায়াবীনি রাত,বসন্তের মৃদু হাওয়া,ঘরের ভেতরে ফুলদানিতে রাখা রজনীগন্ধার সুবাস এই সবকিছুর সাথেই নীলিমার হৃদস্পন্দন একে একে প্রহর ঘোষনা করতে থাকে সেই প্রতিক্ষিত জনের আগমনের।বারোটা বেজে সাত… বারোটা বেজে আট …বারোটা বেজে নয়…তারপর ঠিক বারটা বেজে দশ মিনিটে দরজায় মৃদু শব্দ হয়।নীলিমা ছুটে যায় দরজার কাছে।দরজা খুলতেই তার চোখ পড়ে সেই চিরচেনা প্রিয় মুখটিতে।সে মুখটি একবার দেখার জন্য নীলিমা নিজের জগতের অর্ধেক দান করে দিতে পারে।



দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই ইমরান নীলিমাকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দেয়।নীলিমার হৃদপিন্ড খুশিতে লাফিয়ে ওঠে।ইমরান এবার নীলিমার চোখের দিকে তাকিয়ে পুরুষালী মৃদুকন্ঠে বলে,তুমি ভাল আছ?নীলিমা ইমরানের মুখ থেকে এক মূহুর্তের জন্যেও চোখ না সরিয়ে জবাব দেয়,হুম ভাল আছি।আর তুমি?ইমরান এবার শব্দ করে হেসে ওঠে আর বলে তুমিতো জানই আমি ভাল থাকি,শুধু তোমার অভাববোধটাই আমাকে কষ্ট দেয়।নীলিমা ইমরানের হাতদুটো নিজের হাতে তুলে নেয় তারপর তাকে নিয়ে শোবার ঘরে বিছানাতে এসে বসে।ফুলদানিতে রাখা রজনীগন্ধা অপূর্ব সুবাস ছড়াচ্ছে।চারিদিকে তাকিয়ে ইমরান হেসে বলে আজ তো চাঁদের আলোতেই পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে,আজ কি মোমের আলোর দরকার আছে?নীলিমা আকুল কন্ঠে বলে, নইলে যে তোমাকে ভাল করে দেখতে পাব না!জবাবে ইমরান কিছু বলে না শুধু তাকিয়ে থাকে নীলিমার চোখের দিকে।ইমরানের সে দৃষ্টিতে যেন সমগ্র জগতের ভালবাসা আর মায়া একবারে উঁকি দেয়।ইমরান মৃদু কন্ঠে বলে,তোমার চুলে সাদাটে রঙ ধরছে।নীলিমা লজ্জাজড়িত কন্ঠে জবাব দেয়,ছেচল্লিশ বছর বয়স হলো।চুল পাকবে না?ইমরান বলে,হুম তা অবশ্য ঠিক কিন্ত তোমার চোখদুটো সেই একইরকম আছে।চেহারা একটু বদলেছে কিন্ত মুখের সে সরলতা আজও অটুট আছে যে সরলতা দেখে আমি প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম আমাদের বাসর রাতে।তোমার মনে আছে কি কান্নাটাই না কেঁদেছিলে তুমি সেই রাতে?নীলিমা জবার দেয়,সতেরো বছর বয়েসি একটা মেয়েকে যদি কোনো কথাবার্তা ছাড়া হুট করে একটা বুড়োর সাথে বিয়ে দেয়া হয় তাহলে সে কাঁদবে না?ইমরান চোখ কপালে তুলে বলে, চব্বিশ বছর বয়েসি ছেলেকে তোমার বুড়ো মনে হয়?নীলিমা জবাব দেয়,এখন মনে হয়না কিন্ত তখন মনে হতো।কতই বা বয়স ছিল আমার তখন?বিয়ে নিয়ে কোনো ভাবনাই তখন আসেনি আমার মনে।সেদিন দুপুরবেলা বাবা যখন মাকে বললেন আজ রাতে নীলিমার বিয়ে তখন আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।রাতে যখন তোমার বাড়ি থেকে সবাই চলে আসল আর আমাকে বিয়ের শাড়ি পড়ানো হলো তখন আমি বিশ্বাস করলাম যে সত্যিই আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে।তখন মনে হচ্ছিল যে বিয়ে হওয়ার আগেই যেন আমি মরে যাই।ইমরান এবার শব্দ করে হেসে উঠে বলে আমাকে তোমার এত অপছন্দ হয়েছিল?নীলিমা জবাব দেয়,তোমার ছবিও তো আমি দেখিনি তখন। পছন্দ বা অপছন্দ করার সুযোগ পেলাম কই?বিয়ের বিষয়টাই আমার ভীষন অপছন্দ হচ্ছিল।তাছাড়া মা চাচিরা বলছিল ছেলের বয়স চব্বিশ।আমার মনে হচ্ছিল ছেলে আমার চেয়ে অনেক বড়।আসলে হঠাত করে বিয়েটা হওয়ায় কোনোকিছুই মেনে নিতে পারছিলাম না।ইমরান মিটি মিটি হেসে বলে সেই জন্যেই বুঝি বাসর রাতে কেঁদে আকুল হচ্ছিলে?আমি যখন তোমায় আলতো করে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিতে চেষ্টা করলাম তখন তুমি আমার বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে কেঁদে কেঁদে আমারই বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিলে?নীলিমার সে রাতের কথা মনে পরে যাওয়াতে সে লজ্জা পেয়ে যায় আর অভিমানের সুরে বলে,কাঁদবো না?তুমি কেন একটা কচি মেয়েকে একদিনের মাঝে বিয়ে করতে রাজি হলে?কিছুটা সময় কি দেয়া যেতনা?ইমরান জবাব দেয়,আসলে বিয়ের ব্যাপারে আমার কোনো হাত ছিলনা।আমি জানতামও না যে কনে বয়েসে এত ছোট।আমার বড় চাচার ধারনাই ছিল পড়ালেখা করে আমি বখে যাচ্ছি তাই চাকরিটা হতেই সে আমার বিয়ে দেবার জন্য অস্থির হয়ে উঠল।চাকরির পোস্টিং বান্দরবানে শোনা মাত্রই সে দুই দিনের মাঝে কনে দেখে রাতারাতি বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল যাতে আমি নতুন স্ত্রীকে সংগে নিয়ে সেখানে গিয়ে সংসার শুরু করতে পারি।আর কচি মেয়ের ধারনাটাও তার মাথা থেকে বেরিয়েছে।আমার চাচার ধারনা যে সুন্দরী আর কচি বয়েসের মেয়ে ছাড়া কেউ আমাকে লাইনে আনতে পারবে না।বিয়ের দিন বিকালে যখন আমি বিষয়টা জেনেছিলাম তখন কি পরিমান রাগ করেছিলাম তুমি জাননা।আমিতো ব্যাগ গুছিয়ে চলেই যেতে চাইছিলাম বাড়ি থেকে কিন্ত তখন মা আমাকে বোঝালো এভাবে চলে গেলে কনে পক্ষের অপমান হবে।হয়ত মেয়েটির আর বিয়েই হবে না।অগত্যা আমাকে রাজি হতে হলো।


নীলিমা একটু ভেবে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,আচ্ছা তোমার সাথে তো অনেক শিক্ষিত আর গুনি মেয়েরা পড়ালেখা করত,তোমার কি আমার মত অর্ধ শিক্ষিত একটা মেয়েকে বিয়ে করার ব্যাপারে আপত্তি ছিলনা?ইমরান মৃদু হেসে নীলিমার হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে বলল,সত্যি বলতে প্রথমে তোমার সম্পর্কে জেনে আমি বেশ অখুশিই হয়েছিলাম কারন আমার ধ্যান ধারনা তো আমাদের বাবা দাদাদের মত প্রাচীন ছিলনা যে মেয়ে কম বয়সি হতে হবে এবং পড়ালেখা জানাটা তাদের জন্য জরুরি নয়।কিন্ত সেই রাতে তোমার কান্না ভেজা মুখ আমাকে যে মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ফেলেছিল তারপর জীবনে কখনো মনে হয়নি যে আমার এর বেশি কিছু চাওয়ার আছে।নীলিমা ইমরানের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে ভাবে,আমি জানি।আমি জানি তুমি আমায় কতটা চেয়েছ।তারপরও মাঝে মাঝে তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছা হয়।যখন তোমার মুখ থেকে শুনি আমি কতটা দামী তোমার জন্য তখন বুকটা আবারও ভরে যায় গভীর আনন্দে।বেঁচে থাকার জন্য এটা আমাকে প্রেরনা যোগায়,নিজের জীবনকে ভালবাসার প্রেরনা যোগায়।


ইমরান এবার যেন একটু উদাস হয়ে যায়।সে বলে,নীলু তোমার মনে আছে বিয়ের পরে সেই দিনগুলি আমাদের কি গভীর আনন্দে কেটেছে?মনে আছে আমরা এমন পূর্নিমা রাতে একে অন্যেরর হাত ধরে চন্দ্রালোকিত বনের পথে হেঁটে বেড়াতাম?মনে আছে সেই বনে গাছের ফাঁক দিয়ে জোছনা এসে পথের উপর তোমার ছাপা শাড়ির মত অজস্র নকশা তৈরী করতো?সেই আধো আলোছায়ায় তোমার মুখটা দেখতে আমার ভীষন ভাললাগত।আর কি ভাল লাগত জান?যখন তুমি বাড়ির ছাদে বসে খোলা গলায় রবীন্দ্রসংগীত গাইতে আর একসময় দুজনেই একে অপরের আলিঙ্গনে মুক্ত আকাশের নীচে ঘুমিয়ে পড়তাম।নীলু সত্যিই তোমার গানের গলা অপূর্ব ছিল।আমি যদি তোমাকে গান শেখাতাম তাহলে তুমি অনেক নামী শিল্পী হতে পারতে।নীলিমা হেসে বলে,এখনো তুমি এটা নিয়ে আফসোস করছ?আমি রেডিও আর ক্যাসেট থেকে শুনে শুনে গান শিখেছি নিজের খুশিতে।গান গাইতামও নিজের আনন্দের জন্য।তবে আমার আনন্দ বেড়ে দ্বিগুন হয়েছিল তখন যখন তোমার মত একটা আগ্রহী আর দরদী শ্রোতা পেয়েছিলাম।তুমি যে আমার গান পছন্দ কর এর চেয়ে বেশি পাওয়ার আশা কিন্ত আমি করিনি।তাই আমাকে শিল্পী বানাতে না পেরে তোমার কিন্ত আফসোস করার কিছু নেই।ইমরান এবার দুষ্টুমি করে বলে,ভেবেছিলাম একজন নামী শিল্পীর সঙ্গী হিসাবে কোথায় আমি একটু পরিচিতি পাব কিন্ত তুমি সব ভেস্তে দিলে?কত চেষ্টা করলাম তবুও ওস্তাদের গাছে গান শিখতে চাইলে না।নীলিমা এবার হাল ছেড়ে দিয়ে বলে,উফ ইমরান!তুমি আবার শুরু করলে?আচ্ছা আগামী জন্মে আমি নামী শিল্পী হয়ে তোমাকেও ফেমাস বানিয়ে দেব।যদি চাও তাহলে সিনেমার নায়িকাও হয়ে যাব কিন্ত তোমাকে কথা দিতে হবে সে জন্মেও তুমি আমারই হবে।ইমরান বলে,তাই?নীলিমা বলে,জ্বী সাহেব।

দুজনে কিছুক্ষন চুপ থাকার পর নীলিমা ইমরানের মিটিমিটি হাসি দেখে জিজ্ঞাসা করে,কি ব্যাপার তুমি হাসছ যে?ইমরান মুখ তুলে জবাব দেয়,মনে পড়ে গেল তুমি আর একবার বিয়ের রাতের মত কেঁদেছিলে।নীলিমা জিজ্ঞাসা করে,কবে?ইমরান জবাব দেয়,বিয়ের চার মাস পর যখন তুমি বুঝতে পারলে যে আমাদের সন্তান আসছে তখন।উফ কি যে কান্না তোমার!সেদিনও তুমি কেঁদে কেঁদে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিলে।সেদিন অবশ্য আমার বুকে কিছু কিল ঘুষিও পড়েছিল কিন্ত আমি এত খুশি ছিলাম যে সেগুলো আমার কাছে আশির্বাদ বলে মনে হচ্ছিল।নীলিমা বলে, বাহরে!আমি কাঁদবো না?কোন মেয়ে বিয়ের একবছর পূর্ন হওয়ার আগেই সন্তানসম্ভবা হয়েছে?ছিঃ কি লজ্জা!তারউপর একমাস পরেই ছিল আমার এইচ,এস,সি পরীক্ষা।অসুস্থতার কারনে তো পরীক্ষাই দিতে পারলাম না সেবার।ইমরান বলে,পরের বার তো দিয়েছিলে।নীলিমা বলে হুম,দিয়েছিলাম কিন্ত সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করতে হয়েছিল।আমি কি অমন ছাত্রী ছিলাম?আগেরবার চারটা লেটার নিয়ে পাশ করেছি।এমন না হলে সেবারও করতাম নিশ্চয়।ইমরান এবার একটু লাজুক হেসে বলে,আসলে তখন তো অভিজ্ঞতা ছিলনা অতটা তাই বুঝতে পারিনি।কিন্ত যাই বলো মীমের জন্ম কিন্ত আমাদের জীবনটিকে আরো পরিপূর্ন করে তুলেছিল।নীলিমা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।বাইরে কোনো অচেনা রাতজাগা পাখি ডেকে ওঠে।ইমরান বলে,নীলু তোমার মনে আছে মীমের জন্মের আগে একবার আমাদের শোবার ঘরের জানালার পাশের গাছটিতে একটা পেঁচা বসে ডেকে উঠেছিল আর সেটা দেখে তুমি ভয় পেয়েছিলে?তুমি এত বেশি ভয় পেয়েছিলে যে তোমার জ্বর এসে গেল।নীলিমা জবাব দেয়,মনে আছে।তুমি তখন রাত জেগে আমার মাথায় পানি দিয়েছিলে।আমি অসুস্থ হলে তুমি আমার খুবই যত্ন করতে সবসময়।তোমার যত্ন পাওয়ার লোভেই মাঝে মাঝে অসুস্থ হতে ইচ্ছা করত।ইমরান বলে,সেবার তোমার অসুস্থতার কথা শুনেই তোমার বাসা থেকে লোক এসে তোমাকে নিয়ে গেল।আমার ঘরটা খালি হয়ে গেল।কি যে কষ্ট হচ্ছিল সেদিন তোমাকে বিদায় দিতে!!তবে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম যখন তার সাত দিন পর সকালে তোমাকে ব্যাগ হাতে দরজায় দাঁড়ানো দেখলাম।নীলিমা মৃদু কন্ঠে বলে,কি করবো বল?তোমাকে ছাড়া থাকতে যে আমার একেবারেই ভাল লাগেনা।বাড়ির সবাই অনেক বাঁকা বাঁকা কথা শুনিয়েছিল কিন্ত আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল তাই তোমার কাছে ফিরে এসেছিলাম।


নীলিমা কিছু মনে হতেই সে উঠে একটা এলবাম এনে ইমরানের সামনে মেলে ধরে বলে,মীমের মেয়ের বয়স ছয়মাস হলো।দেখ কি মিষ্টি মেয়ে হয়েছে!সারাক্ষন হাসে।ইমরান এলবামটা উলটে পালটে দেখে।এলবামের পাতাগুলো ভর্তি তার প্রিয় মুখগুলোর আনন্দমাখা মুহূর্তে।ইমরান জিজ্ঞাসা করে,অন্যরা সব কোথায়?নীলিমা উত্তর দেয়,তৃষা আর তূর্যের কলেজ দুদিনের ছুটি।ওরা গেছে বড় আপার বাসায়।আমাকেও যাওয়ার জন্য সাধছিল কিন্ত আমি কিভাবে যাই?আমি তো জানি তুমি আসবে।এবার ইমরান নীলিমার হাত নিজের হাতে তুলে নেয় আর একহাতে তার মুখ তুলে ধরে তাকিয়ে থাকে।দুজন দুজনের চোখে এত গভীর ভাবে কি দেখে তা কে জানে?কিন্ত তাদের একে অন্যের দিকে তৃষ্ণার্তের মত চেয়ে থাকা যেন শেষ হতে চায় না।
একসময় দুজনেই বাইরে তাকায়।ইমরান বলে ওঠে সে রাতেও এমন সুন্দর জোছনা ছিল তাইনা?নীলিমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।তার মনে পড়ে সেই রাতের কথা যে রাতে পূর্নিমা চাঁদের আলোয় মাখা সাগর দেখবে বলে দুজনে, দশ বছরের মীম আর দেড় বছরের জমজ শিশু তৃষা আর তূর্যকে একদিনের জন্য বড় বোনের দায়ীত্বে রেখে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে ছিল।সেদিন ছিল তেরই ফেব্রুয়ারীর রাত।বাসের জানালা দিয়ে একের পর এক জোছনা মাখা ঘুমন্ত গ্রাম দেখতে দেখতে তারা গল্প করছিল।ইমরান তাকে বলেছিল,দেখ বেশ সুন্দর একটা সময়ে আমরা প্রথম সাগর দেখতে যাচ্ছি।এমন সুন্দর আবহাওয়া,এমন সুন্দর চাঁদ সেই সাথে ভালোবাসা দিবসের রাত।ইমরানই তাকে প্রথম জানিয়েছিল যে পরের দিনটি পৃথিবীর অনেক দেশেই ভালবাসা দিবস হিসাবে পালিত হয়।গল্প করতে করতেই ইমরানের কাঁধে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল।তখনি বাসটা এক্সিডেন্ট করল আর তারা দুজন ছিটকে পড়ল।সেদিন চন্দ্রালোকিত প্রান্তরে পাশাপাশি শুয়ে দেহের অসহ্য যন্ত্রনা চেপে সে মিনতি করে গুরুতর আহত ইমরানকে বার বার বলছিল,প্লিজ প্লিজ ইমরান আমাকে ছেড়ে যেওনা।জ্ঞান হারানোর আগে নীলিমার শুধু এটুকু মনে আছে যে তার সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা হেসে ইমরান বলেছিল কথা দিচ্ছি তোমায় কখোনো একা হতে দেব না।যেখানে থাকি তোমার কাছে ফিরে আসব।


সেই থেকে ইমরান তার কথা রেখে চলছে।নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে দীর্ঘ নয় মাস অসুস্থ থাকার পর যখন নীলিমা একটু একটু করে সেরে উঠছে তখন একরাতে দরজায় আওয়াজ শুনে দরজা খুলে ইমরানকে দেখে সে খুব অবাক হয়েছিল।ঘরে ঢুকে যখন সে পরিচিত ভঙ্গিতে কথা শুরু করলো তখন নীলিমার প্রাথমিক ভয়টুকু কেটে যেতে একটুও সময় লাগেনি।তারপর থেকে প্রতি ১৪ ফেব্রুয়ারী রাত বারোটা দশ মিনিটে মাত্র দেড় ঘন্টার জন্য ইমরান আসে তার প্রেয়সীর কাছে।প্রথম প্রথম নীলিমার নিজের মাথার সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ হতো কিন্ত ধীরে ধীরে সে বুঝতে পেরেছে যে এটা তার অসুস্থতাও না কিংবা কোনো স্বপ্নও না।হয়ত অস্বাভাবিক কিন্ত তবুও ইমরানের এভাবে ফিরে আসাটা ততটাই বাস্তব যতটা বাস্তব সে নিজে।নীলিমা এ বিষয়টি যেমন সবার কাছ থেকে গোপন রেখেছে তেমনি এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজতে যায়নি।ইমরানের ফিরে আসা তাকে শোকের অতল গহব্বর থেকে টেনে তুলেছে। সেই সাথে তাকে জীবনকে অযথা বয়ে নিয়ে না বেড়িয়ে বরং জীবদ্দশাটা উপভোগ করে কাটানোর প্রেরনা দিয়েছে।ইমরান বারবার ফিরে এসেছে বলেই সে তার তিনটি সন্তানকে ভালভাবে মানুষ করতে পেরেছে,বেকার যুবক-যুবতীদের নিয়ে একটি নামী কারুশিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পেরেছে আর…………আর হয়ত বেঁচে থাকতে পেরেছে।প্রথম প্রথম এই দিনে ইমরানের প্রতিক্ষায় থেকে নীলিমার বুকের মাঝে আশংকার ঝড় উঠত কিন্ত এখন নীলিমা জানে যত যাই হোক ইমরান আসবেই।


ইমরানের হাতের ছোঁয়ায় নীলিমার চিন্তা ভাঙ্গে।ইমরান মৃদু স্বরে বলে,নীলু সময় হয়েছে।নীলিমা ইমরানের হাত ধরে ধীর পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।ইমরান বলে,তুমি তাহলে আর সাগর দেখতে গেলে না?নীলিমা মিষ্টি হেসে জবাব দেয়,সাগর আমি তোমার সাথেই দেখবো, হয়ত অন্য কোনো জগতে। তখন আকাশে অপূর্ব সুন্দর একটা চাঁদ,তার ছড়িয়ে দেয়া আলোয় ডুবে রয়েছে চরাচর।হঠাত আসা এক মাতাল হাওয়ায় নীলিমার চুল এলোমেলো হয়ে যায় আর সে অনুভব করে তার পাশে কেউ নেই………
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×