একবার গুলিস্তান ধামরাই বাসে করে সাভার যাচ্ছিলাম।যথারীতি ভীষণ ভীড়! অনেকেই দাঁড়িয়ে। আমি সামনে সিট কভারের উপর বসা।আমার সামনে বছর পয়ত্রিশের এক মাঝারি গড়নের নারী এসে দাঁড়ালেন।উনি ঠিকমত কিছু এক্টা ধরে উঠার আগেই বাস টান দিল।সেই টানে উনি সামনের সিটে বসা শুকনো চিমসে শরীরের লুঙ্গি আর শার্ট পড়া মাঝবয়েসী লোকটির কোলের উপর বসে পড়লেন।আমরা সবাই অবাক,তারপর সকলের মুখেই হাসি দেখা দিল।সাধারণ একটা বোরকার উপর সাধারণ সুতি ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে রাখা মহিলাটি ততক্ষনে সামলে নিয়েছে।এক আপু তার হাত ধরে লোকটির কোল থেকে উঠতে সাহায্য করল।তার মুখে একটু বিব্রত,একটু লাজুক হাসি।চিমসে লোকটি তখন বিশ্বাস করতে পারছে না তার কোলে আস্ত এক মহিলা বসে পড়েছে।তার মুখে বেক্কল হয়ে যাওয়া হাসি।
কেন জানি ঐদিনটির কথা মনে পড়ে গেল।এমন কত ঘটনাই তো ঘটে যায় প্রতিদিনের জীবনে,যাদুর শহরে,যাদুর পরশে।
বড় অদ্ভুত দেশে জন্মেছি।কোনোকিছুই এখানে ঠিক মত চলে না।মজার ব্যাপার হচ্ছে কি সুন্দরভাবে আমরাও মেনে নিয়েছি কিছুই ঠিক মত চলবে না।তাই নিজে নিজেই প্রস্তুতি নেই, ঢাকা শহরে অফিস শুরুর সময়ের দু ঘন্টা আগে বের হই কারন হোকনা তা আধা ঘন্টার পথ দুই ঘন্টার কাছাকাছি তো লেগেই যায়! ট্রেন ধরতে গেলে দেরী করে বের হই,কারন সময় মত তো ট্রেন আসবে না।রোজার বাজারে যদি বেগুনের দাম কম থাকে তাতেই খুশি হয়ে যাই,কারন এসময় তো তা থাকার কথা না।
ঢাকা শহরে অল্প একটু জায়গাতে কত মানুষ মিলে আমরা থাকি।গ্যাসের জোর যখন বেশি থাকে গৃহিণীরা তখন তড়িঘড়ি রান্না সেরে ফেলে।ট্যাপের কেঁচোটা যাতে বালতিতে না পড়ে এর জন্য নেট দিয়ে ট্যাপ বেঁধে রাখি, ভাবি থাক বেটা ভেতরে সামনে না আসলেই হয়।
কে এফসিতে সন্ধ্যা বেলা যেমন ভীড় জমে,তারচেয়েও বেশি জমে পাড়ার চায়ের দোকানে। রাস্তার পাশে সিঙ্গাড়া আর আলুর চপ খেতে ভীড় জমায় সাধারন লোকগুলো। কোনো সরকারি হাসপাতালে যদি ভাগ্যক্রমে বেড পেয়ে যায় বা কোনো ডাক্তার যদি সহৃদয় হয়ে ভিজিটের টাকা না নেয় তাহলে এই মানুষগুলো অলিম্পিকে সোনা জয়ের মত আনন্দিত হয়।
এত সমস্যা কিন্ত কতটা স্বাভাবিকভাবেই না আমরা গ্রহণ করি।বলিনা পনের মিনিটের রাস্তায় কেন দু ঘন্টা লাগবে,কেন ট্রেনের জন্য কয়েক ঘন্টা বসে থাকতে হবে,কেন দ্রব্যমূল্য এত নাগালের বাইরে যাবে,কেন গ্যাস -পানি -বিদ্যুৎ ঠিক মত পাওয়া যাবে না?
দিন শেষে একটা সিঙাড়া, এক কাপ চা পেলেই খুশি হয়ে যায় সাধারন মানুষগুলো।আর কোনো দেশ কি আছে যেখানে মানুষকে এত সহজে খুশি করা যায়?
আর কোথাও কি সাধারণ মৌলিক অধিকার না ভোগ করতে করতে এমন হয় যে একটি অধিকার পেয়ে গেলেই নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়?কি জানি কেন যেন খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে দেশের সাধারণ লোক গুলোর জন্য।এই লোকগুলো খুব অল্প নিয়েই নিজের জীবন দিব্বি উপভোগ করতে শিখেছে।সরকার, প্রশাসন,পুলিশ সাধারণত তাদের কোনো উপকারে আসে না,তাদের আশাও এই মানুষগুলো করে না।তাদের কথা তাই মানুষগুলো তোয়াক্কা করেনা।
অনেক সিদ্ধান্তই নেয়া হলো কিন্ত খুব দেরী করে।মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে গেছে।না জানি এই মিছিল কতটা৷ দীর্ঘ হবে।খুব মায়া লাগে এই মানুষের কথা ভেবে।কোনো সাহায্যই হয়ত সময়মত পৌঁছাবে না।কারন এদেশে যে অনিয়মটাই নিয়ম!
খুব বড়সড় একটা চাঁদ উঠেছে আজ।তাতে গোলাপি আভা!ভালবাসার রং নাকি গোলাপী?কিন্ত শহরটাকে খুব বিষন্ন লাগছে।মানুষই তো এই দেশের প্রাণ। কত মানুষ না জানি না খেয়ে আছে এখন এদেশে! আচ্ছা বাসের সেই মহিলাটি,আর সেই চিমসে লোকটি কেমন আছে?কেন জানি খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১২:৩৮