স্বপ্নের মতো একটি গ্রাম । যেনো পটে আঁকা কোনো জীবন্ত ছবি। অপরুপ সৌন্দোর্যের লিলাভূমি। মনের মাধুরী মিশিয়ে তুলির আঁচড়ে আঁকা রঙধনু। চারদিকে নয়নাভিরাম সবুজের হাত ছানি। সাগর নদী আর ঝর্নাধারার সুর-ছন্দে সিতল উর্বরা প্রকৃতি। সহস্র ফল ফুলের সমারহে সাজানো এক মৌসুমী আবহ । চোখ জুড়ানো নান্দোনিক পাখ-পাখালীর সুরেলা গুঞ্জন। পহারে পহারে আজানের সুমধুর ধনিতে চনমনে যে গ্রামটি । তার নাম রসুলপুর । এই গ্রমটি দেখে কবি লিখেছেন "এমন দেশটি কোথাও খুজে পাবে নাকো তুমি...
সকল দেশের রানি সে যে, আমার জন্ম ভূমি"...
"একবার যেতে দে'মা' আমার ছোট্ট সোনার গাঁ"
সেই গ্রামের মাটি ও মানুষের ছিলো হাজার বছরের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। ছিলো মায়ের ভাষা ও সাহিত্য । ছিলো পরস্পরের মাঝে অঢেল মায়া ও মমতার বন্ধন। ছিলো ধর্ম বর্ণের সুদৃঢ় ঐক্য ও সহাবস্থান। সুখে দুঃখে পরিবারের মত থাকতো বিপদে মসিবতে একাট্টা । কিন্ত ছিলনা স্বাধীনতা । আশেপাশের প্রতিবেশী বড় গ্রাম গুলোর নিয়ন্ত্রনে থাকতে হতো । এ গ্রামের মুল্যবান সম্পদ গুলো তারা তদের গ্রামে নিয়ে যেতো । শোষন যুলুম আর নির্যাতন করে দমিয়ে রাখতো এ গ্রামের সরলমনা মানুষের কন্ঠ । বৃটিশ বেনিয়া আর বর্গী নামক শক্তিশালী গোত্রগুলির কাছে হতে হত প্রতি নিয়ত অবহেলিত বঞ্ছিত । ছিলোনা পর্যাপ্ত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সহ বহুমূখী শিক্ষার প্রয়াস। ব্যবসা বানিজ্য অফিস আদালত শিক্ষাদিক্ষা রাজনীতি নেতৃত্ব সহ সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জাতি হিসেবে টিকে থাকা দিনে দিনে অসম্ভব হয়ে উঠতে লাগলো । এ যেনো অক্টোপাসে ঘেরা গোলামীর জিবন ।
পদে পদে লাঞ্ছনা আর প্রবঞ্ছনা সে গ্রামের মানুষকে ভাবিয়ে তুল্লো । সবার মাথায় আকাশ ভাঙ্গা চিন্তা। এ প্রাচীর ভাঙ্গতে হবে । হাজার বছরের বাঙ্গালী জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি এক সময় পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একথা ভাবতেই যেনো বুক হাহাকার করে । কিন্ত হতাশা তো কোনো সমাধান নয় । কিন্ত কে এগিয়ে আসবে এ মহতী কাজে। ভীতু লোকের কাজ তো এটা নয় । রীতিমত এক সাক্ষাত যুদ্ধের দামামা । আমুল পরিবর্তনের এক বিপ্লবী আহবান। এর জন্য দরকার পন্খীরাজের পিঠ চাপড়ানো রাজপুত্রের। মীর কাসেম,তারেক বিন যিয়াদ,এবনে বতুতা, টিপু সুলতান, গাযী সালাহ উদ্দীন, ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলযি, সোহরাব রুস্তম, শহীদ তিতুমীর আর সিরাজুদ্দৌলার মত বীরপূরুষের ।
ঝড় ঝঞ্ঝা ,শত হতাশার কালোমেঘ ভেদ করে এক চিলতে আলোক রশ্মী আছড়ে পড়লো গ্রামবাসির উপর । শুষ্কো মরুতে রাহমাতের বৃষ্টি আঁচ করলো গ্রামবাসী। উত্তর পাড়ার উচ্চশিক্ষিত যুবক এ কে এফ হক । মধ্যপাড়ার সাহসী কন্ঠ এইচ এস সোহরাওয়ারদী । দক্ষীণপাড়ার বলিষ্ঠ সমাজ সেবক এ এইচ খান ভাসানী । এম এ কাসেমের মত বেশ কিছু মানুষ স্ব-স্ব অবস্থান থেকে গ্রামবাসীর আর্থ-সামাজিক দৈন্যতার অবসানে তাদের কন্ঠ সবার কাছে তুলে ধরার কাজ শুরু করলো। পাড়ায় মহল্লায় সভা সমাবেশ সেমিনার আয়োজন আর সচেতনতার সংগ্রাম দানা বাধতে শুরু করলো। ফলে পালটা আঘাত ও বৃদ্ধি পেলো । শত বছর নিরবছিন্ন যাত্রা আর আব্যহত প্রতিবাদ চললো । এ প্রতিরোধের উথ্থান পতনে সংগ্রাম করে বাঁচতে শেখার মন্ত্র পেলো গ্রামবাসী। এক গ্রামের নিয়ন্ত্রন মুক্ত তো অন্য গ্রমের নিয়ন্ত্রন । একভাষার দাসত্বমুক্তি আরেক ভাষার দাপটের মুখোমুখি । নিজের মুখের ভাষার অন্তিম যাত্রা দেখতে বসলো। আবার প্রতিবাদ প্রতিরোধ সভা সেমিনার। অগ্নীঝরা শ্লোগান । উত্তাল দিন । রফিক বরকতের রক্তের বদলায় মুখের ভাষা কেড়ে নিতে পারেনি ।
কিন্তু শোষনের খঞ্জর তখনো ঝুলছিলো । রাতের ঘুম সংগ্রামি মানুষের কিছুতেই আসতে চায় না । পরাধীনতার শেকড় না উপড়ানো পর্যন্ত নিস্তার নেই। ধারাবাহিক এই সংগ্রামে একে একে গ্রামের সাত কোটি মানুষ শরিক হতে থাকলো । কিছু ভিতু আর মিরজাফর সকল যুগেই তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। এখানে ও তার ব্যত্যায় হলো না । সময়ের কাল পরিক্রমায় নেতৃত্বের পরিবর্তন একটি অমোঘ নিয়ম । এস এম রাহমান, এম জেড রাহমান, এ জি ওসমানী সহ অনেক সাহসী সন্তান এ দুর্যোগেও প্রাণপণ এগিয়ে এলো। জাতির শেকড় সংরক্ষন ও পরাধীনতার শেষ শেকল ভাঙ্গার ডাক এলো । সে ডাকের সুর নাজরুলের কন্ঠে প্রতিধনিত হলো-"বাজিছে দামামা বাজরে আমামা শীর উচু করে মুসলমান...
দাওয়াত এসেছে নয়াজামানার ভাঙ্গাকেল্লায় ওড়ে নিশান"
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তখয়ী যুদ্ধ হলো । অসংখ্য প্রাণ আর একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হলো প্রত্যাশিত স্বাধীনতা । গোলামীর কুয়াশা মুক্ত আকাশে গ্রামবাসী মুক্তপায়রা হয়ে উল্লাস করলো। কিন্ত এই শান্তি সুখের উল্লাস তৃপ্তীদায়ক হলো না । যাদের বিরুদ্ধে এতো সংগ্রাম তাদের অনু প্রবেশ ঘটলো । দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্র গ্রমের স্বাধীনতাকে অর্থহীন করার চক্রান্ত শুরু হলো। লেলিয়ে দিলো নিজ জাতিসত্তার মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ । শুরু হলো লোভ লালসা লুটপাট দুর্নীতির মহোৎসব । সিমাহীন পক্ষ-বিপক্ষের রাজনীতি । ঐক্য সংহতিতে সন্দেহের বিজ বপিত হলো । প্রতিবেশী কুচক্রিরা আখের গোছানোর নতুন পথ পেলো এ ভূখন্ডে। সেই কুচক্রীমহলের কুটচালেই দেশ প্রেমিক শীর্ষ নেতাকে একের পর এক হত্যা করা হলো । পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হয়ে গেলো । গ্রামের শিক্ষা সংস্কৃতি, উন্নয়নগত অবকাঠাম স্থবির হয়ে পড়লো । অন্যদিকে গ্রামে কার অবদান কত, কোন নেতা কত বড়, এই বিতর্কই মুখ্য হতে থাকলো । গ্রামবাসীর শান্তি বিনষ্ট হলো ।স্বাধীনতার সুফল বঞ্চিত গ্রামের সকল জনগন কে ভাবিয় তুললো । প্রয়াত নেতাদের নিয়ে আহেতুক বিতর্ক নির্লজ্জতার সীমা ছড়িয়ে গেলো । উন্নতি অগ্রগতির চাকা গড়াতে হলে একটি সমাধান জরুরী। কার অবদান বেশি । আর কে বড় ?
গ্রামে কয়েকজন পীর এর সমাধানে মতামত দিলো । কিন্ত কে শোনে কার কথা । অবশেষে আরেক পীরের আগমন। তিনি আয়োজন করলেন স্থানীয় স্কুল মাঠে এক বিশাল গনজমায়েত । গ্রামের সকল জনগন সেখানে হাজির হলেন মহাসমারহে । প্রশ্ন একটায় কার অবদান বেশি। আর কে সবচেয়ে বড় ? প্রয়োজন সর্বোজন গ্রাহ্য করার মত একটি মাত্র উত্তর । মুহুর্মুহু করতালির অভিনন্দনে সিক্ত হলো সেই রহস্যময় পীর সাহেব । ষ্টেজে তাশরিফ আনলেন। সবার পিনপতন নিরবতা। এইতো সেই মাহেন্দ্রোক্ষণ । এখনি সেই কাঙ্খীত সমাধান শুনিয়ে জাতিকে বিপদ মুক্ত করবেন।
পীরসাহেব দাড়ালেন। সবাই পলকহীন। উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বল্লেন-কে বড় ? এর সমাধান দেওয়ার আগে আমি একটি প্রশ্ন করতে চায়। আপনাদের উত্তরের পরেই কেবল আমার পালা। সমোস্বরে সবাই জানতে চাইলেন তার প্রশ্নটি ।
তিনি ভরাট কন্ঠে বল্লেন । যে স্কুল মাঠে আপনারা হাজির হয়েছেন । বৃটিশ বেনিয়া,বর্গীয় বুর্জোয়া , ইষ্ট ইন্ডিয়া গং ,আর পাক পাঠানদের শত রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । এর প্রতিষ্ঠায় যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাদের মধ্যে এ কে এফ হক, এইচ এস সোহরাওয়ারদী, এ এইচ খান ভাসানী, এম এ কাসেম অন্যতম । স্কুলটি নির্মানে প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করেন বীর বিক্রম,বীর উত্তম ও বীরপ্রতিক বৃন্দ । স্কুলটির স্বধীন সার্বভৌত্ব অর্জনে এক সাগর রক্ত দিয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ ৭ জন অমর সেনানী সহ ৩০ লক্ষ্ শহীদি আত্না । প্রতিষ্ঠানটির নির্মান শ্রমিকের কাজ করেছেন অগনিত মুকতিযোদ্ধাগন। প্রধান শিক্ষক ছিলেন এস এম রাহমান । সহঃপ্রধান শিক্ষক ছিলেন এ জি ওসমানী । সার্বিক তত্বাবধান করেছেন এম জেড রাহমান। শিক্ষক মন্ডলীর ভূমিকায় ছিলেন ১১ গ্রামের ১১ জন কমান্ডার । সার্বিক সহযোগিতা ও অর্থের যোগান দিয়েছেন এ গ্রামের সাত কোটি মানুষ ।
এখন আপনারাই বলুন ? এদের মধ্যে কে বড় ? উপস্থিত সবাই নির্বাক ! একে অন্যের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। আর ভাবতে লাগলো । কেউ ভাবে প্রধান শিক্ষক । পরেই চিন্তা করে প্রতিষ্ঠাতারা আগে না প্রধান শিক্ষক । যারা রক্ত দিলো শহীদ হলো তারা কম কিসে ? পঙ্গু হয়ে আজো যারা কাতরাচ্ছে তারা ? কে বড় ? কে....কে ? কে বড় ? নাহ আর কেউ ভাবতে পারলো না । কারোও অবদান কে ছোট করার মতো দুঃসাহস না পেয়ে আর ভাবতে পারলো না .কেউ..। প্রিয় পাঠক আপনারাই বলুন তো কে বড় ?
রচনাকাল
০৪.০৫.১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




