কোন ভ্যাকসিনটি বেশি কার্যকর? কোন ভ্যাকসিনটি বেশি ভালো?
বিশ্বের ধনী এবং উন্নত দেশগুলোতে দেওয়া হচ্ছে ফাইজার ভ্যাকসিন। অপরদিকে স্বল্পোন্নত এবং মধ্যমায়ের দেশগুলোতে দেওয়া হচ্ছে অক্সফোর্ড এর ভ্যাকসিন। কিন্তু কেন? এদিকে এখনো বিশ্বের ১৩০টি দেশে একটি ভ্যাকসিনও কেউ পায়নি। চলুন একটু বিস্তারিত জানি।
ফাইজার ভ্যাকসিনঃ
বিশ্বের উন্নত এবং ধনী দেশগুলোতে এই ভ্যাকসিন এর চাহিদা বেশি। ইজরায়েলের জনসংখ্যার % অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন সে দেশে দেওয়া হয়েছে এবং সেগুলো ফাইজার ভ্যাকসিন। করোনা আসার এক বছরও লাগেনি এই ভ্যাকসিন বানাতে এবং প্রয়োগ করতে। এখন পর্যন্ত বের হওয়া ভ্যাকসিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্যকর এই ভ্যাকসিনটি হলেও এর কিছু অসুবিধার কারণে মধ্যমায়ের দেশগুলোতে এই ভ্যাকসিন দেওয়া যাচ্ছে না।
সুবিধাঃ
কার্যকারিতার দিক দিয়ে এই ভ্যাকসিন সবচেয়ে বেশি কার্যকর। প্রায় ৯৫% কার্যকর। এতো তাড়াতাড়ি এতো কার্যকর ভ্যাকসিন আসবে এটা ভাবার মতো বিষয়। শুধু তাই না এই ভ্যাকসিন বয়স্কদের উপরেও ভালো রকম কার্যকর। তাছাড়া নতুন ইউকে এবং আফ্রিকা ভেরিয়েন্টেও ভালো কাজ করে।
অসুবিধাঃ
এই ভ্যাকসিন সবচেয়ে কার্যকর হলেও এর দাম, পরিবহন, সংরক্ষণ এবং বিতরণ খুবই ব্যয়বহুল এবং জটিল।
এই ভ্যাকসিনের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা এটিকে মাইনাস ৭৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখতে হবে। সাধারণত এতো কম তাপমাত্রার ফ্রিজার কোথাও ব্যবহার হয়না। বেশিরভাগ দেশেই এরকম তাপমাত্রার ব্যবস্থা নেই। সুতরাং এই ভ্যাকসিন নিয়ে আসতে গেলে এরকম তাপমাত্রার স্পেশাল ফ্রিজার দরকার। ভ্যাকসিন হাজারে না, লাখে বা কোটিতে দরকার। তাহলে তার জন্য কতগুলো স্পেশাল ফ্রিজার দরকার একবার ভাবুন।
ধরুন বাংলাদেশ এই ভ্যাকসিন নিতে চাচ্ছে। তাহলে সে দেশ থেকে ফ্রিজারে ভরে দেশে আনতে হবে। তারপর আবার ফ্রিজারে করে বিভিন্ন উপজেলায় পাঠাতে হবে। সেখানে সংরক্ষণ করতেও স্পেশাল ফ্রিজার লাগবে। কত খরচ হবে একবার ভাবুন। তাছাড়া এর নির্মাণ খরচও বেশি। প্রতি ডোজ বানাতেই প্রায় দেড় হাজার টাকা করে পড়ছে। সাথে পরিবহন, সংরক্ষণ আর বিতরণ খরচ এর কারণে প্রতি ডোজের দাম যা হবে তা না আমাদের দেশের সরকার একা দিতে পারবে না জনগণ নিজের টাকায় কিনতে পারবে।
ভাবুন তো এক ডোজ ভ্যাকসিনের দাম যদি ৮হাজার টাকা পড়ে। তাহলে দু ডোজ ভ্যাকসিন ১৬হাজার টাকায় কিনে দিতে পারবে এরকম ক'টা পারিবার দেশে আছে?
এসব চিন্তা করেই হয়তো স্বল্পোন্নত এবং মধ্যম আয়ের দেশে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে না। আবার এই ভ্যাকসিন আজীবন কাজ করবে না। একটা নির্দিষ্ট সময় পর কাজ করা বন্ধ করে দেবে। মানে নির্দিষ্ট সময় পর পর আবার ভ্যাকসিন নিতে হবে।
কিন্তু যেহেতু মানুষের প্রধান টার্গেট করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া সেহেতু আবার সুরক্ষার দিক বিবেচনায় এই ভ্যাকসিনের চাহিদা সবচেয়ে বেশি আর প্রয়োগও এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
অক্সফোর্ড এর ভ্যাকসিনঃ
বাংলাদেশে বা ভারতে যেই ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে তা হলো অক্সফোর্ড এর ভ্যাকসিন।
সুবিধাঃ
এই ভ্যাকসিনের প্রতি ডোজ বানাতে খরচ হচ্ছে মাত্র ২শ টাকার মতো। তাছাড়া এই ভ্যাকসিন দেশে দেওয়া অন্য সব ভ্যাকসিন এর মতো পরিবহন, সংরক্ষণ এবং বিতরণ সহজ। নরমাল চলমান ফ্রিজারেই এটি রাখা যায়। খরচ কম হওয়াই সরকার থেকে ফ্রীতেই এই ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে এবং শেখ হাসিনা বাকি ভ্যাকসিনও ফ্রীতেই দেবে বলে মনে হচ্ছে। সব খরচ মিলিয়ে পার ডোজ যা পড়ছে তা এক হাজারও না। যদিও ১৩কোটি মানুষকে দেওয়াও একবারে কম খরচের না। কিন্তু সব মিলিয়ে চিন্তা করলে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এই ভ্যাকসিন সবচেয়ে সুবিধাজনক।
WHO এর নতুন তথ্যমতে এই ভ্যাকসিনটি করোনা ভাইরাস ছড়াতে বাধা দেয়। করোনা ভাইরাস ছড়ানো রোধ করার মাধ্যমেও কোভিড কমানো সম্ভব।
অসুবিধাঃ
অক্সফোর্ড এর ভ্যাকসিনের সবচেয়ে বড়ো অসুবিধা হলো এর সুরক্ষার পারসেন্টেজ। করোনা থেকে এই ভ্যাকসিন মাত্র ৬৩% সুরক্ষা দিতে পারে। শুধু তাই না নতুন ভ্যারিয়েন্টের উপর এই ভ্যাকসিন খুব একটা কার্যকর নয়। যদিও এই সম্পর্কে যথেষ্ট ডাটা এখনো পাওয়া যায়নি। আফ্রিকার পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে আফ্রিকার নতুন ভ্যারিয়েন্টের উপর এটা তেমন কাজ করছে না। তবে যাদের উপর পরীক্ষা চালানো হয় তাদের বয়স ৬০এর উপর এবং সেটাও কম পরিমাণে। তাই এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার অবকাশ নেই। ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও আগের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলতে হবে। এদিকে ভারতে নতুন করে আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়েছে। তাই বলা যায় এই ভ্যাকসিনটি করোনার পারমানেন্ট সমাধান নয়।
তাহলে কি ভ্যাকসিন নিয়ে ভুল করেছি বা নেবো না?
না, মোটেও ভুল করেননি এবং নেবেনও। প্রথম জেনারেশনের ভ্যাকসিন হিসাবে এই ভ্যাকসিনের সাইড ইফেক্ট নেই বললেই চলে। যে মৃদু সাইড ইফেক্ট হচ্ছে তা অন্য ভ্যাকসিনেও হয়। তাই বলা যায় এই ভ্যাকসিন নিলে কোনো ক্ষতি নেই। যতটুকু উপকার হচ্ছে তাকে নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো হিসাবে ধরতে হবে।
কোভিডে হয়তো সবাই মরছে না। কিন্তু করোনা ফুসফুসের যতটুকু ক্ষতি করছে তা কোনোদিন ভালো হবে না। কোভিড ভালো হওয়ার পর অনেকেরই অনেক অসুখ বিসুখ হচ্ছে। ফুসফুসে ফাইব্রোসিস যতটুকু হচ্ছে তা ভালো হবে না কোনোদিন। ডায়াবেটিস এর মতো আজীবন ভুগতে হতে পারে, এবং আজীবন কন্ট্রোলে রাখতে স্টেরয়েড বা বিভিন্ন মেডিসিন নিতে হতে পারে। এই মেডিসিনগুলোর আবার সাইড ইফেক্ট আছে। সেগুলোর কারণে অন্য রোগ হবে এবং সেগুলোতেও ভুগতে হবে।
সুতরাং কোভিড থেকে বাঁচাই হলো প্রধান টার্গেট। প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর। তাই যতটুকু সুরক্ষা পাবেন এটাও কম না। মনে রাখবেন এই ফাইজা বা অক্সফোর্ড এর ভ্যাকসিন কোনোটাই পারমানেন্ট না। দিন দিন এদের আরও জেনারেশন আসবে অন্যরাও আরও এডবান্সড, আরও কম ব্যয়বহুল, আরও বেশি কার্যকর ভ্যাকসিন আসবে। তাই আপাতত যা পাচ্ছি এটাও কম না! বিজ্ঞান বসে নেই। ১০বছরের খাটনি এক বছরে করে ভ্যাকসিন বের করে ফেলেছে। ভরসা রাখুন বিজ্ঞানের উপর।