১. পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকার সিঙ্গেল কলাম হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুসংবাদ। ব্যাপারটা বাংলাদেশের অনেকের কাছেই ভালো মনে হয় নাই। আমারও না।
দেশের টিভি চ্যানেলের টক শো'তেও এ নিয়ে অনেকে জ্ঞানগর্ভ মত দিয়েছেন। ফেসবুকেও। অন্যান্য মাধ্যমেও। মতামতে আবেগ আছে। গোস্বা আছে। যুক্তিও আছে। এইসব আবেগ, গোস্বা ও যুক্তি দেখে মনে হচ্ছে, সিঙ্গেল কলাম সংবাদ ছাপার দোষটা আনন্দবাজারের নয়, দোষটা গোটা পশ্চিমবঙ্গের, দোষটা পশ্চমবঙ্গীয় লেখকদের। ব্যাপারটা যেন এরকম: আমরা পশ্চিমবঙ্গ এবং সেখানকার কবি-লেখকদের আর পুছব না। তাদের সাথে কথা বলব না। তাদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখব না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ আর সেখানকার কবি-লেখকদের জন্য এ ধরনের ব্যবহার জমা রাখা কি ঠিক? কবি-লেখক-সংস্কৃতিকর্মীরা তো সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণে অন্য দেশে গিয়ে গুরুত্ব পান না। পান ব্যক্তিগত অর্জন, সৃজনশীলতার কারণে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের দেশের সাথে আমাদের সম্পর্কটা তার রাষ্ট্র, গণমাধ্যম, সমাজ ও রাজনীতির সূত্রে নয়, লেখার সূত্রে। তিনি বাংলাদেশে এলে অনেকে হুমড়ি খেয়ে পড়বেন সেটা নিতান্ত মার্কেজের গুণেই।
২. আনন্দবাজারের ওই সিঙ্গেল কলাম কাহিনীর বাইরে এসে বাংলাদেশের টেলিভিশন ও পত্রিকাগুলোর দিকে তাকালে কী দেখি? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদারদের লেখা এবং লাইভ, ফোনো লাইভ ও কমেন্ট ছাড়া যেন আমাদের হুমায়ূনকে আমরা বিশেষায়িত করতে পারছি না। আমাদের হুমায়ূন আহমেদকে বিশেষায়িত করার জন্য দাদাদের যতটা টানা হলো, ততটা টানা হয়নি বাংলাদেশের লেখকদেরও। আদৌ কি এতটা দরকার ছিল?
৩. আবার পশ্চিমবঙ্গের কোনো লেখক বাংলাদেশে এলে আমরা স্থির থাকতে পারছি না। তাদের পেছনে দৌড়াচ্ছি। তাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি, মিডিয়ায় ভালো কাভারেজ দিচ্ছি, নিজের বইটা তার হাতে তুলে দিয়ে ধন্য হচ্ছি, একটা অটোগ্রাফ বা নিজের বইয়ের ফ্ল্যাপে একটা আশির্বাদ নিচ্ছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কী নিতান্ত আতিথেয়তা? এসব কি নিতান্তই লেখকের ব্যক্তিগত অর্জন, ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীলতার প্রতি মুগ্ধতা?
৪. আনন্দবাজারের সিঙ্গেল কলাম সংকীর্ণতা দেখে যে আবেগ, গোস্বা ও যুক্তি ও অপমানবোধের সঞ্চার হয়েছে তাতে কিছু খুব সাধারণ মানবিক অনভূতির ব্যাপার। স্বজনের মৃত্যুতে কোনো প্রতিবেশী বা পরিজন যদি জানাজায় না আসে শোক প্রকাশ না করে তাহলে সাধারণ মানুষ হিসেবে মৃতের স্বজনরা রাগ করেন, অভিমান করেন। রাগ বা অভিমানের মাথায় অনেককিছু বলেনও। পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু প্রতিবেশী ও পরিজনের কাছে প্রত্যাশার। প্রত্যাশা থাকে বলেই থাকে আশাহত হওয়ার রাগ, অভিমান, বেদনা।
প্রতিবেশী বা পরিজন হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের কাছে আমরা এই প্রত্যশাটা কেন করি? প্রতিবেশী মিয়ানমারের কাছে বা ভারতের অন্যান্য ভাষা ও প্রদেশের কাছে আমাদের এই প্রত্যাশা নেই। এদিক থেকে বলাই যায় যে, পশ্চিমবঙ্গকে আমরা আমাদের কাছের প্রতিবেশী ভাবি, নিকটাত্মীয় ভাবি। শুধু কি তাই? নাকি আরো কিছু?
৫. আনন্দবাজারের পাঠকের কাছে হুমায়ূনের গুরুত্ব হয়ত সিঙ্গেল কলামের। হুমায়ূন ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো লেখক হলে এদেশের পত্রিকাগুলো কিন্তু সিঙ্গেল কলামই ছাপত। আনন্দবাজারিদের যুক্তির জায়গা থেকে এরকম বলা যায়। তবে এর বাইরে এসে যা বলা যায় তা হচ্ছে, আনন্দবাজার খুব কমই বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায়। আনন্দবাজার তার ধরন অনুযায়ী সবসময় কংগ্রেস, সিপিআইএম এবং বাংলাদেশের বিপরীতে অবস্থান করে। এই রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে আমরা কেন আনন্দবাজরের কাছে প্রত্যাশা করি? সেটা কি নিতান্তই পশ্চিমবঙ্গকে, পশ্চিমবঙ্গের ভাষা ও লেখকদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী বা নিকটাত্মীয় ভাবি বলেই। নাকি এইখানে একটা কলোনির মানসিকতা কাজ করে। আমাদের চেতনায় দাদা, ভারত, হিন্দু জমিদারি_ এসব কি এখনো লুকিয়ে-চুরিয়ে ঘাপটি মেরে আছে? দাদদের দেখলেই নিচ জাত, নিচ শ্রেণী এবং জীবিকার জন্য মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা মানুষের মতো নমষ্কারের ভঙ্গিতে হাত কি দুটো উঠে যায় না? বাইরের দৈন্যর চেয়ে আমাদের ভেতরের এসব দৈন্য কি অনেক বড় নয়?