১ম অংশ- Click This Link
২য় অংশ - Click This Link
৩য় অংশ- Click This Link
আমরা অনেকে মাযহাবের (ফেকাহ শাস্ত্রের) অনুসরণ করি । ফেকাহ শাস্ত্র খুলে দেখুন তাদের কি মত ছিলঃ-
(১) আলোচিত বিষয়ে বিশ্ব বিখ্যাত ফিকহ গ্রন্থ ফাতওয়া-ই-শামী-এর সিদ্ধান্ত হচ্ছে-
ভৌগলিক কারণে চন্দ্রমাসের ১ তারিখের চাঁদ কখনই প্রথম দিন সারা পৃথিবী থেকে দেখা যায় না । বরং সমগ্র পৃথিবীতে নুতন চাঁদ দেখা যেতে ২ থেকে ৩ দিন সময় লেগে যায় । এখন প্রশ্ন হল প্রথম দিন ভূ-পৃষ্ঠের যে সব দেশে নুতন চাঁদ দেখা গেল ঐ সব দেশে চন্দ্র মাসের ১ তারিখ, আবার ২য় দিন যেসব দেশে চাঁদ দেখা গেল সে সব দেশে নুতন করে ২য় ১ তারিখ, আবার ৩য় দিন যেসব দেশে চাঁদ দেখা গেল সেসব দেশে নুতন ৩য় ১ তারিখ গণনা করা হবে ? অর্থাৎ নুতন চাঁদ দেখার বিভিন্নতায় একই চান্দ্রমাসের ভিন্ন ভিন্ন তিনটি ১ তারিখ হবে ? নাকি প্রথম দিনের দেখার ভিত্তিতেই সমগ্র পৃথিবীতে বিশ্ব জনীন (Universal) একটি তারিখ গণনা হবে ? যাকে ফিকহের পরিভাষায়- اختلاف المطالع معتبر ام لا অর্থাৎ চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় হবে কিনা ? এ ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে । এ ভাবে যে, প্রত্যেক দেশের মানুষ নিজ নিজ দেখার ভিত্তিতে আমল করবে ? না কি উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য হবে না বরং সর্ব প্রথম চাঁদ দেখার ভিত্তিতে সকলের জন্য আমল করা জরুরী হবে ? এমনকি প্রাচ্যে যদি জুমার রাতে চাঁদ দেখা যায় আর পাশ্চাত্যে শনিবার রাতে চাঁদ দেখা যায় তবে পাশ্চাত্যের অধিবাসীদের উপর প্রাচ্যের দেখা অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব ? এ বিষয়ে কেউ কেউ প্রথম মতটি গ্রহণ করেছেন (অর্থাৎ এক দেশের চাঁদ দেখা অন্য দেশের মানুষের জন্য গ্রহনীয় নয়) ইমাম যায়লায়ী ও ফয়েজ গ্রন্থের প্রণেতা এ মতটি গ্রহণ করেছেন । শাফেয়ী মাযহাবের মতও এটা । তাদের যুক্তি হল চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে প্রত্যেক দেশীয় লোক নামাযের ওয়াক্তের মতই নিজ এলাকা বিশেষে সম্বোধিত । যেমন যে অঞ্চলে এশা ও বিতরের ওয়াক্ত হয়না সেখানে এশা ও বিতর নামায আদায় করতে হয়না ।
আর সুপ্রতিষ্ঠিত মত হচ্ছে দ্বিতীয়টি অর্থাৎ চাঁদ দেখার ভিন্নতা গ্রহনীয় নয় । বরং প্রথম দিনের দেখার দ্বারাই সমগ্র পৃথিবীতে এক কেন্দ্রিক তারিখ গণনা করে, একই দিনে একই তারিখে আমল করতে হবে । এটাই আমাদের হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত । মালেকী এবং হাম্বলী মাযহাবের মতও এটা । তাদের দলীল হচ্ছে আয়াত ও হাদীসে চাঁদ দেখার সম্বোধন সকলের জন্য আম বা সার্বজনীন যা নামাজের ওয়াক্তের সম্বোধন থেকে আলাদা-(ফাতওয়া-ই-শামী, খন্ড-২, পৃঃ-১০৫)
(২) বিশ্ব বিখ্যাত ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য কিতাব ফাতওয়া-ই-আলমগীরির সিদ্ধান্ত হলো-
অর্থাৎ ফিকহের প্রতিষ্ঠিত বর্ণনানুযায়ী চাঁদ ঊদয়ের বিভিন্নতা গ্রহণীয় নয় । ফতুয়াই কাযী খানের ফাতওয়াও অনুরুপ । ফকীহ আবু লাইছও এমনটাই বলেছেন । শামছুল আইম্মা হোলওয়ানী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, যদি পাশ্চাত্যবাসী রমযানের চাঁদ দেখে তবে সে দেখার দ্বারা প্রাচ্য বাসীর জন্য রোযা ওয়াজিব হবে । এমনটাই আছে খোলাছা নামক কিতাবে-(ফাতওয়া-ই- আলমগিরী, খন্ড-১, পৃঃ-১৯৮)
(৩) চার মাযহাবের সমন্বিত ফিকহ গ্রন্থ আল ফিকহ আলা মাযাহিবিল আরবায়া নামক গ্রন্থের ভাষ্য হচ্ছে-
অর্থাৎ পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে সকল স্থানেই উক্ত দেখার দ্বারা রোযা ফরয হবে । চাই চাঁদ নিকটবর্তী দেশে দেখা যাক বা দূরবর্তী দেশে দেখা যাক এতে কোন পার্থক্য নেই । তবে চাঁদ দেখার সংবাদ গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে অন্যদের নিকট পৌছতে হবে । তিন ইমাম তথা ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি,ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর মতে চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় নয় । অর্থাৎ প্রথম দিনের দেখার দ্বারাই সর্বত্র আমল ফরয হয়ে যাবে(আল ফিকহ আলা মাযাহিবিল আরবায়া, খন্ড-১, পৃঃ-৪৪৩)
(৪) বিশ্ব মানের ফিকহ গ্রন্থ আল ফিকহুস্ সুন্নাহ এর সিদ্ধান্ত হচ্ছে-
অর্থাৎ জমহুর ফুকাহা গনের সিদ্ধান্ত অতএব যখনই কোন দেশে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হবে তখনই অন্য সকল দেশে রোযা ফরয হয়ে যাবে । কেননা রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম এরশাদ করেছেন “চাঁদ দেখার প্রমাণ সাপেক্ষে তোমরা রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখার প্রমাণ সাপেক্ষে তোমরা রোযা ছাড়, ঈদ কর”; এখানে তোমরা বলে সম্বোধন দেশ মহাদেশ নির্বিশেষে সকল উম্মতের জন্য عام ব্যাপক অর্থবোধক । অতএব উম্মতের মধ্য থেকে যে কেউ যে কোন স্থান থেকে চাঁদ দেখুক উক্ত দেখাই সকল উম্মতের জন্য দলীল হবে । এ মত পোষণ করেছেন হযরত ইকরামা, কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ, সালেম এবং ইসহাক রহমাতুল্লাহি আলাইহিম । হানাফী ফকীহগণের এটাই বিশুদ্ধমত- (আল-ফিকহুস্ সুন্নাহ, খন্ড-১, পৃঃ-৩০৭)
(৫) বিশ্ব বিখ্যাত ফিকহ্ গ্রন্থ ”মুগনী”-এর সিদ্ধান্ত হচ্ছে-
অর্থাৎ কোন এক দেশের মানুষ চাঁদ দেখলে সকল দেশের মানুষের জন্যে রোযা রাখা জরুরী হবে । চাই সে দেশ কাছে বা দূরে হোক, আর যে চাঁদ দেখেনি সে শরীয়তের দৃষ্টিতে তারই মত আমল করবে যে দেখেছে । চাঁদ উদয়ের স্থান ও কাল ভিন্ন হোক (তাতে পার্থক্য নেই)- (আল-মুগনী, খন্ড-৪, পৃঃ-১২২)
(৬) বিশ্ব বিখ্যাত গ্রন্থ ”তাবয়ীনুল হাকায়েক”-এর ভাষ্য হচ্ছে-
অর্থাৎ অত্র গ্রন্থের প্রণেতা (রঃ) বলছেন যে, চাঁদের উদয় স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় নয় । যদিও কেউ চাঁদের উদয় স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন । ”ভিন্নতা গ্রহণীয় নয়” এর অর্থ হচ্ছে যদি এক দেশের অধিবাসীরা নুতন চাঁদ দেখেন এবং অন্য দেশের অধিবাসীরা না দেখেন তবে প্রথম দেশবাসীর দেখা দ্বারাই অন্য দেশবাসীদের জন্য রোযা রাখা ফরয হবে । অধিকাংশ মাশাইখ-ই এমত পোষণ করেছেন । এমনকি এক দেশের মানুষ ৩০টি রোযা রাখল, অন্য দেশের মানুষ রোযা রাখল ২৯টি, তাহলে অন্যদেরকে একটি রোযা কাযা করতে হবে ।
-(তাবয়ীনুল হাকায়েক, খন্ড-২, পৃঃ-১৬৪/১৬৫)
অতএব চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় নয় । প্রথম দিনের দেখার দ্বারাই সমগ্র পৃথিবীতে এক কেন্দ্রিক তারিখ গণনা করে, একই দিনে একই তারিখে আমল করতে হবে । এমনিভাবে বিভিন্ন জন তাদের ভাষায় বলেছেন দেখুন-
(ফতহুল কাদির, খন্ড-২, পৃঃ-৩১৮) (বাহরুর রায়েক, খন্ড-২, পৃঃ-৪৭১) (কাযীখান, খন্ড-১, পৃঃ-৯৫) (হাশিয়া-ই-তাহতাবী শরীফ, পৃঃ-৩৫৯) (মায়ারিফুস্ সুনান, খন্ড-৫, পৃঃ-৩৩৭) (ফাতওয়ায়ে ইবনু তাইমিয়্যা, খন্ড-২৫, পৃঃ-১০৭) (ফাতওয়া-ই-দারুল উলুম দেওবন্দ, খন্ড-৬, পৃঃ-৩৯৮) (মায়ারিফুল মাদানিয়্যাহ, খন্ড-৩, পৃঃ-২৩) (মিফতাহুন্ নাজ্জাহ, খন্ড-১, পৃঃ-৪৩২) (তানযীমুল আশ্তাত, খন্ড-১, পৃঃ-৪১) (ফাতওয়া-ই-রশিদিয়া, পৃঃ-৪৩৭) (বেহেশসি- জেওর, খন্ড-১১, পৃঃ-৫১০) (ফাতওয়া-ই-রাজাবিয়্যাহ্, খন্ড-৪,পৃঃ-৫৬৭) (তরিকুল ইসলাম, খন্ড-২, পৃঃ-১৮৮) বাজ্জাজিয়া, খন্ড ৪, পৃঃ ৯৫; তাতারখানিয়া, খন্ড ১ পৃঃ ৩৬৯; নুরুল ইযাহ, পৃঃ ১২৭; আল কাফী, খন্ড ১ পৃঃ ৪৬৮; বজলুল মাযহুদ ফি হল্লি আবি দাউদ, খন্ড ১১ পৃঃ ১০৭; শাইখ তুসী তাহযীব খন্ড ৪ পৃঃ ১৫৫; মিলাযুল আখবার, আল্লামা মাজলেসী খন্ড ১ পৃঃ ৬২০; তাহযীবুল আহকাম, ফয়েজ কাশানী খন্ড ৪ পৃঃ ১৫৭; ছালছাবিল আনওয়ারুল মাহমুদ খন্ড ২ পৃঃ ৭১; আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আব্দুল আ’লা সাবযাওয়ারী মুসতানাদ খন্ড ২ পৃঃ ১৩৩; আয়াতুল্লাহ খুয়ী মুসতানাদুল উরওয়া খন্ড ২ পৃঃ ১২২; ফতোয়া-ই-আযীযিয়া খন্ড ৩ পৃঃ ৪৯ (দারুল উলুম দেওবন্দ); তাফসীরে মাজেদা পৃঃ ১০৭; মারাকীহুল ফালাহ পৃঃ ২০৭; মজমুআ ফতোয়া খন্ড ১ পৃঃ ৩৮১; জরুরী মাসায়েল, মাওলানা রুহুল আমীন বর্ধমানী খন্ড ১ পৃঃ ১৪; জামেউর রমুয পৃঃ ১৫৬; নাহরুল ফায়েক মজমুআয়ে ফতোয়া খন্ড ১ পৃঃ ৩৬৯; তাহতাবী পৃঃ ৫৪০; কিতাবুল মাবছুত, আল্লামা ছারাখছী খন্ড ৩ পৃঃ ১৩৯।
প্রখ্যাত আলেম ওলামাগণ এ সিন্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এক শহরের মানুষ রমযানের চাঁদ দেখলে অন্য শহরের লোকদের জন্যও চাঁদ দেখা প্রমাণিত হবে । এমনকি পৃথিবীর একেবারে পশ্চিম প্রান্তে চাঁদ দেখা গেছে, এই সংবাদ যদি নির্ভরযোগ্য সূত্রে পূর্ব প্রান্তের অধিবাসীদের নিকট পৌঁছে, তবে তাদের উপর এই দিনে রমযানের রোযা ফরয হবে (সূত্র: দুররুল মুখতার, ২য় জিলদ, পৃষ্ঠ-১০৮; আলগিরী, ১ম জিলদ, পৃঃ-১৯৮; বাহরুর রায়েক, ২য় জিলদ, পৃঃ-২০৭; মাজমাউল আনহুর, ১ম জিলদ, পৃঃ- ২৩৯)
ইমাম আবু হানিফা রহ. এর বক্তব্য ও এটাই এবং তিনিই সঠিক ।
পৃথিবী একটা, চাঁদ একটা, কোরআন একটা, সমস্ত মুসলিম একজাতি, সবাই এক নবীর উম্মাত, তাহলে ঈদ কেন তিন দিনে করব ?
সন্দেহ নিরসনের জন্য বলতে হয় হানাফী মাজহাবসহ তিনটি মাজহাবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো: নতুন চাঁদ উদয়ের স্থানের বিভিন্নতার কোন গুরুত্ব নেই এবং সর্বপ্রথম হেলালকেই সারা বিশ্বের সকলের অনুসরণ করতে হবে ।
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর অভিমতঃ-
(চলবে)
৫ম অংশ- Click This Link
৫ম অংশে ৪ মাযহাবের ইমামদের ফতোয়া, দলিল এবং কেন তারা বাস্তবায়ন করতে পারেননি তার কিছু কথা পাবেন ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ৮:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



