somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা ভাগ কীভাবে আটকানো যেত ?

২২ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ১২:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলা ভাগ আটকানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর পরিকল্পিত বেঙ্গল প্যাক্টকে ভিত্তি করে এগিয়ে যাওয়া।

বাংলার প্রাদেশিক রাজনীতিতে চিত্তরঞ্জন দাশ সবচেয়ে বেশি জোর দেন হিন্দু মুসলিম ঐক্যের দিকটির ওপর। দেশবন্ধুর অভিমত ছিল যে, বঙ্গীয় আইন পরিষদে বলিষ্ঠ গ্রুপ সৃষ্টিকারী মুসলিম সদস্যদের আন্তরিক সহযোগিতা ব্যতিরেকে স্বরাজবাদীদের ব্রিটিশ সরকারকে বাধাদানের নীতি সফল হবে না। বস্তুতপক্ষে চিত্তরঞ্জন ছিলেন রাজনৈতিক বাস্তববাদী এবং প্রচন্ড বিরোধিতার মুখেও তিনি নিজ অবস্থান থেকে কখনও বিচ্যুত হতেন না। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অতি প্রয়োজনিয় দিকটির বাস্তব সমাধানের উদ্দেশ্য তিনি এক বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে বাংলার মুসলমানদের আস্থাভাজন হয়ে তাদেরকে নিজের পক্ষে আনার চেষ্টা করেন। এই চুক্তিটিই বেঙ্গল প্যাক্ট নামে পরিচিত। ১৯২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত স্বরাজ্য পরিষদ দলের এক সভায় চুক্তিটির শর্তাবলি গৃহীত হয়।

এ সভায় সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত হয় যে, প্রদেশে সত্যিকারের স্ব-নিয়ন্ত্রিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই এ চুক্তি কার্যকর হবে। চুক্তিটি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির ১৯২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তারিখের সভায়ও অনুমোদন লাভ করে। চুক্তিটির বিভিন্ন শর্তের মধ্যে ছিল -

১. বঙ্গীয়-আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর মাধ্যমে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।

২. স্থানীয় পরিষদসমূহে প্রতিনিধিত্বের অনুপাত হবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শতকরা ৬০ ভাগ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতকরা ৪০ ভাগ।

৩. সরকারি চাকরির শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ পদ পাবে মুসলমান সম্প্রদায় থেকে। যতদিন ঐ অনুপাতে না পৌঁছানো যায়, ততদিন মুসলমানরা পাবে শতকরা আশি ভাগ পদ এবং বাকি শতকরা কুড়ি ভাগ পাবে হিন্দুরা।

৪. কোন সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ৭৫ শতাংশের সম্মতি ব্যতিরেকে এমন কোন আইন বা সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করা যাবে না, যা ঐ সম্প্রদায়ের সঙ্গে স্বার্থের পরিপন্থী।

৫. মসজিদের সামনে বাদ্যসহকারে শোভাযাত্রা করা যাবে না।

৬. আইন সভায় খাদ্যের প্রয়োজনে গো-জবাই সংক্রান্ত কোন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে না এবং আইন সভার বাইরে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা আনার প্রচেষ্টা চালানো অব্যাহত থাকবে। এমনভাবে গরু জবাই করতে হবে যেন তা হিন্দুদের দৃষ্টিতে পড়ে তা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করে। ধর্মীয় প্রয়োজনে গরু জবাইয়ের ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করা যাবে না।

বাংলায় কংগ্রেসের অনেক প্রতিষ্ঠিত ও বর্ষীয়ান নেতা চুক্তিটির বিরোধিতা করেন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিনচন্দ্র পাল সহ অন্যান্যদের নেতৃত্বে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির হিন্দুরা এটির বিপক্ষে অনমনীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের ভয় ছিল যে, চুক্তিটি হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রভাব দুর্বল করে ফেলবে। তারা চিত্তরঞ্জন দাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে, তিনি হিন্দুদের অধিকার বিসর্জন দিয়েছেন। এমনকি অনেক মধ্যপন্থী হিন্দু নেতা মনে করেন যে, চিত্তরঞ্জন দাশ মুসলমানদের আস্থা অর্জন করার চেষ্টায় অনেকটা বেশি ছাড় দিয়েছেন। অবশ্য যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, কিরণশংকর রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, অনিলবরণ রায়, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল এবং প্রতাপচন্দ্র গুহর মত অনেক নবীন নেতা চিত্তরঞ্জনের এই পরিকল্পনার পাশে দাঁড়ান। বাংলা কংগ্রেসের হিন্দু নেতৃত্ব বেঙ্গল প্যাক্ট নিয়ে বিভাজিত হয়ে গেলেও বাংলার অধিকাংশ মুসলমানের প্রাণঢালা সমর্থন লাভ করেছিলেন চিত্তরঞ্জন। তাঁরা সর্বান্তকরণে চুক্তিটিকে স্বাগত জানান। বাংলার মুসলমানগণ অনুধাবন করেছিলেন যে, চুক্তিটির বাস্তবায়ন তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রান্তিকতার সমস্যার কিছুটা সমাধান করবে ও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের মূলে আঘাত হানবে। মুসলিম গণমাধ্যমগুলি তাদের ন্যায্য দাবিসমূহ পূরণ করার মতো ঔদার্য প্রদর্শন করায় বেঙ্গল প্যাক্ট সমর্থনকারী হিন্দুনেতাদের ধন্যবাদ জানায়।

কিন্তু ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কোকনদ সেশনে চুক্তিটি বাতিল করা হলে তাদের মোহমুক্তি ঘটে। তাদের মতে, কোকনদ কংগ্রেস যে মস্ত ভুল করে সেটি ছিল কংগ্রেস আন্দোলনের ইতিহাসে জঘন্যতম এবং এই ভুল হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ক্ষেত্রে এবং কংগ্রেসের মুখ্য উদ্দেশ্যের প্রতি চরম আঘাত হেনেছে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস যে অবস্থান নিয়েছিল, চিত্তরঞ্জন দাশ তার সমালোচনা করে ঘোষণা করেন, “তোমরা সভার সিদ্ধান্তসমূহ থেকে বেঙ্গল প্যাক্টকে মুছে ফেলতে পার, কিন্তু ভারতের জাতীয় কংগ্রেস থেকে বাংলাকে বাদ দিতে পারবে না...এ রকম শিষ্টাচারহীন রীতিতে বাংলাকে মুছে ফেলা যাবে না। যারা চিৎকার করে বলে যে ‘বেঙ্গল প্যাক্টকে মুছে ফেল’ তাদের যুক্তি আমি বুঝতে পারি না... বাংলা কি অস্পৃশ্য? এ রকম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করার বাংলার অধিকারকে কি তোমরা অস্বীকার করবে? যদি তোমরা তাই কর, বাংলা তার নিজের ব্যবস্থা নিজেই গ্রহণ করতে পারবে। তোমরা অভিমত ব্যক্ত করার ব্যাপারে বাংলার অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করতে পার না”।

ভারতীয় কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করলেও চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর শক্তি ও উদ্দেশ্যের সততার বলে ১৯২৪ সালের জুন মাসে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনে চুক্তিটির বিধানসমূহের অনুমোদন লাভের আপ্রাণ চেষ্টা চালান। মাওলানা মহম্মদ আকরম খাঁ এই অধিবেশনের সভাপতি হন। অধিবেশনে প্রায় পনের হাজার প্রতিনিধি যোগ দেন। প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে চুক্তি অধিবেশনে গৃহিত হয়। সম্মেলনে চিত্তরঞ্জন দাশ বলেন – “হিন্দুরা যদি মুসলমানের মনে আস্থা সৃষ্টি করিতে না পারে, তবে হিন্দু-মুসলিম-ঐক্য আসিবে না। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ব্যতীত আমাদের স্বরাজের দাবি চিরকাল কল্পনার বস্তুই থাকিয়া যাবে।” যদিও ভারতীয় কংগ্রেস কর্তৃক মেনে নিতে অস্বীকার করা হয়েছে, তবু ১৯২৪ সালের জুন মাসে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলন কর্তৃক তিনি চুক্তিটির শর্তাবলি অনুসমর্থন করিয়ে নিতে সক্ষম হন।

দুর্ভাগ্যবশত ১৯২৫ সালে তাঁর অকাল মৃত্যুতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথে বাধা সৃষ্টি হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কয়েকজন অনুসারীও চুক্তিটি বর্জন করেন। অনেক বাঙালি মুসলমান রাজনৈতিক নেতা মর্মাহত হন এবং তাঁরা কংগ্রেস ও স্বরাজ্য উভয় দল থেকেই দূরে সরতে থাকেন। মুসলমানদের দলত্যাগের ফলে প্রদেশের উল্লেখযোগ্য কিছু মুসলমান নেতা মৌলভী আব্দুল করিম, মওলানা আব্দুর রউফ, খান বাহাদুর আজিজুল হক, আব্দুল্লা হিল বাকি, মৌলভী আশরাফউদ্দীন, ড. এ সুরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক প্রমুখের উদ্যোগে ১৯২৬ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি গড়ে ওঠে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি দীর্ঘস্থায়ী না হলেও বাংলার মুসলিমরা পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ ও ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির প্রতিই মূলত তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রকাশ করেন। কংগ্রেস বাংলার মুসলিমদের গরিষ্ঠ অংশকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

১৯২০ র দশক থেকে বাংলার মুসলিমদের মধ্যে নতুন সত্তাচেতনা লক্ষ্য করা যায় সমাজের সব স্তরে। এই সত্তাচেতনার একদিকে ছিল সামাজিক লাঞ্ছনা ও অন্যদিকে অর্থনৈতিক বঞ্চনার বোধ। কোথাও কোথাও ধর্মভিত্তিক উগ্রতা থাকলেও মুসলিমদের সত্তাচেতনার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল সক্ষমতার দিকে স্বাধীনভাবে যাবার আগ্রহ। এই সময়কার বিভিন্ন পত্রপত্রিকার লেখালেখির দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে এগুলিতে মূলত উঠে এসেছে মুসলমানদের জন্য শিক্ষার অপ্রতুলতা, সরকারি চাকরিতে আনুপাতিক হারের কম সুযোগ, সামাজিক সংস্থার বিশিষ্ট পদগুলিতে হিন্দু আধিপত্য, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যেই জমির মালিকানার কেন্দ্রীভবন ইত্যাদি। বর্ণহিন্দু দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে নানাভাবে সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা হারানোর ভয়। এই ক্ষমতা তারা প্রথম পর্বে পেয়েছিল একদিকে ইংরেজ শাসনের প্রথম থেকেই ইংরেজী শিক্ষার সূত্রে চাকরি বাকরি ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে, অন্যদিকে মুৎসুদ্দি বাণিজ্যের মধ্যে দিয়ে অর্থবান হয়ে। দ্বিতীয় পর্বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যে দিয়ে যে জমিদারী প্রথা এল তার সুযোগও মূলত গ্রহণ করল বর্ণহিন্দু বাঙালিরা, যারা আগেই চাকরী ও ব্যবসা সূত্রে জমিদারী কেনার মতো জায়গায় পৌঁছেছিল। চাকরী, ব্যবসা ও জমিদারী - এই তিনটি ক্ষেত্রেই মুসলমানরা অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক পার্থক্য ছিল বেশ চওড়া।

মুসলিমরা যখন ইংরেজ শাসনের প্রতি তাদের বীতরাগ কাটিয়ে উঠে এই সমস্ত ক্ষেত্রে প্রবেশের উদ্যোগ নিল, তখন বর্ণহিন্দুদের মধ্যে ক্ষমতা হারানোর ভয় কাজ করতে শুরু করল। বিশেষ করে জমিদারদের বিরুদ্ধে রায়ত জোতদারদের আন্দোলন যখন জোরাল হল, তখন সেই অর্থনৈতিক ও শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে সম্প্রদায়গত নানা বিষয় বারবার মিশে যেতে থাকল। ১৯৩৭ এর নির্বাচনের পর যখন বাংলায় ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় এল, তখন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা প্রজাসত্ত্ব আইন, মহাজনি আইন (মানি লেন্ডার্স বিল) ইত্যাদি চালু করেছিল। এগুলি শ্রেণি অভিমুখ ছাপিয়ে সম্প্রদায়গত সংঘাতের রূপ নিতে শুরু করে। সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের ভিত্তিতে আয়োজিত নির্বাচনের প্রচারপর্ব থেকেই বাংলায় এই সংঘাতের সূচনা হয়েছিল। সরকার গঠনের পর বিলগুলি নিয়ে আলোচনা ও সেগুলির আইনে পরিণত হয়ে কার্যকরী হওয়ার পর্বে সংঘাত তীব্রতর হয়।

ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫ অনুযায়ী যুক্তবাংলা সহ তৎকালীন ভারতের ব্রিটিশ অধীনস্ত এগারোটি রাজ্যেই প্রাদেশিক নির্বাচন হয়েছিল ১৯৩৬-৩৭ সালে। এই নির্বাচন গোটা ভারতের রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে বাংলায় এই প্রভাব ছিল মারাত্মক। ১৯৩৬ সালে মোট তিন কোটি মানুষ ভোটাধিকার পেয়েছিলেন, যা ছিল তৎকালীন ভারতের মোট প্রাপ্তবয়ষ্ক নাগরিকের এক ষষ্ঠাংশ। ভোটাধিকারের ভিত্তি হয়েছিল সম্পত্তির মালিকানা, খাজনা দেওয়ার মত বিষয়গুলি। অর্থাৎ আর্থিকভাবে সক্ষমরাই মূলত ভোটাধিকার পেয়েছিলেন। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এক পঞ্চমাংশ প্রাপ্তবয়ষ্কের প্রত্যক্ষ রায় এই নির্বাচনে ধরা পড়ে নি। তবে আগের যে কোনও সময়ের তুলনায় এই নির্বাচনে অনেক বেশি মানুষ সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ে তাদের মতামত ভোটাধিকারের মাধ্যমে পেশ করেন। স্বচ্ছল কৃষকেরা এই নির্বাচনে প্রথম ভোটাধিকার পান।

এগারোটি প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশের মধ্যে আটটিতে - মাদ্রাজ, মধ্যপ্রদেশ, যুক্তপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, বোম্বে, আসাম, নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স - কংগ্রেস সরকার গঠন করে। পাঞ্জাব, সিন্ধ ও বাংলা এই তিন রাজ্যে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে অনেক দূরে ছিল। তবে এগুলির কোথাও মুসলিম লীগ সরকার গড়তে পারে নি। পাঞ্জাবে ইউনিয়নিস্ট পার্টি, সিন্ধে ইউনাইটেড পার্টি ও গুলাম হুসেইন এর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বাংলায় কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় নি। কংগ্রেস পেয়েছিল ৫৪ টি আসন। কৃষক প্রজা পার্টি ৩৬ টি ও মুসলিম লীগ ৩৭ টি আসন পেয়েছিল। অন্যান্য ৪৮ টি মুসলিম সংরক্ষিত আসন পেয়েছিল নির্দল মুসলিম প্রার্থীরা, যাদের অনেকে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টি ও জিন্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ - এই দুই পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দলে যোগ দেন ও দলবদলও করতে থাকেন মাঝেমধ্যে। ফলে সংখ্যাটা কমবেশি বদলাতে থাকে। ইউরোপীয়, ইঙ্গ ভারতীয়, মুসলিম, তপশিলী অন্যান্য সংরক্ষিত ও সাধারণ আসন - সব মিলিয়ে মোট ১১৩ জন নির্দল নির্দল প্রার্থী এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন।

১৯৩৬ - ৩৭ এর নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় মুসলিম লীগ তখনো পর্যন্ত এদেশের মুসলিম জনগণের একটা অল্প অংশের মধ্যেই কেবল ছাপ ফেলতে পেরেছিল। সেই পরিস্থিতি এক দশকের মধ্যে কীভাবে এতটা বদলে গেল যে স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে দেশভাগ তথা বাংলাভাগ পর্যন্ত অনিবার্য হয়ে উঠল ? মান্যতা পেয়ে গেল দ্বিজাতিতত্ত্ব ? এই লেখায় এই সংক্রান্ত কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চাইবো আমরা, দেখতে চাইবো কীভাবে এগলো ইতিহাস। এই পর্যবেক্ষণে আমাদের বিশেষ নজর থাকবে মূলত বাংলাতেই, তবে ভারতের সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাকে বোঝা সম্ভব নয়, এটা অবশ্যই মাথায় রাখার।

১৯৩৬-৩৭ এ অনুষ্ঠিত বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে মোট আসন ছিল আড়াইশোটি। ব্রিটিশ শাসকদের সুনির্দিষ্ট ডিভাইড অ্যান্ড রুল পরিকল্পনা থেকেই জন্ম নিয়েছিল সম্প্রদায়ভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা, যা কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড বা সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ নামে পরিচিত। ১৯১৯ এর মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার স্থানীয় সায়ত্তশাসনকে খানিকটা প্রসারিত করলেও তা ছিল সামান্য। নানা রাজনৈতিক চাপ ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এক দশক পরেই আবার শাসন সংস্কারের ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। প্রাদেশিক সায়ত্তশাসনকে অনেকটা বাড়ানো হয়। আবার এই বাড়তি সায়ত্তশাসনকে নিজেদের অনুকুলে রেখে সামলানোর জন্য বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষমতা বিন্যাসের পুনর্বন্টনের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় ব্রিটিশ শাসকদের তরফে। এর ফলাফল দেখা যায় ১৯৩২ সালের কমিউনাল অ্যাওয়ার্ডে। ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইনের সূত্র ধরে এই কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড অনুসারেই ১৯৩৬ - ৩৭ সালে প্রাদেশিক নির্বাচন হয় বাংলা সহ অন্যত্র।

এই নির্বাচনে বাংলার ২৫০ টি আসনের মধ্যে মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল মোট ১১৭ টি আসন। হিন্দুদের জন্য ছিল মোট ৮০ টি আসন, যার মধ্যে তপশিলী জাতির জন্য আলাদা করে সংরক্ষিত ছিল ৩০ টি আসন। ইউরোপীয়দের জন্য ছিল ২৫ টি আসন, ইঙ্গ ভারতীয়দের জন্য ছিল ৪ টি আসন। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য ৫ টি আসন, জমিদারদের জন্য ৫ টি আসন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২ টি, শ্রমিকদের জন্য ৮ টি আসন। মুসলিম মহিলাদের জন্য ২ টি ও অন্যান্য মহিলাদের জন্য ২ টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। এই আসন বন্টন জনসংখ্যার নিরিখে হয় নি, বিভিন্ন গোষ্ঠীর গুরুত্বকে শাসকেরা যেভাবে নির্ধারণ করেছিল, তার ভিত্তিতে হয়েছিল। যেমন ইউরোপীয় ও ইঙ্গ ভারতীয় গোষ্ঠীর জনসংখ্যা ছিল শতকরা এক ভাগেরও কম, কিন্তু তাদের দেওয়া হয়েছিল ২৫০ আসনের দশ ভাগ, অর্থাৎ ২৫ টি আসন।

সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের এই বন্টন বর্ণহিন্দু ভদ্রলোক বাঙালিকে ক্ষিপ্ত করেছিল। এই রাজ্যে সংখ্যাগতভাবে মুসলিমদের তুলনায় হিন্দুরা কম হলেও বাংলার রাজনীতি অর্থনীতি সংস্কৃতিতে এতদিন পর্যন্ত তাদের দাপট বেশি ছিল। পূর্ববর্তী দ্বৈত শাসনে বেঙ্গল কাউন্সিলে হিন্দুদের জন্য ছিল ৪৬ টি আসন আর মুসলিমদের জন্য ৩৯ টি। নতুন আইনে এই অনুপাত বদলে যায় মুসলিমদের অনুকুলে। মোট আড়াইশো আসনের প্রাদেশিক আইনসভায় তপসিলী আসন বাদে বর্ণ হিন্দুদের আসন এসে দাঁড়ায় এক পঞ্চমাংশে। এটা তারা সহজভাবে মেনে নিতে পারে নি। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এর বিরুদ্ধে তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করেন। বাংলার তৎকালীন গভর্নর অ্যান্ডারসন এবং পরে তার স্থলাভিষিক্ত জেটল্যান্ডও এই বন্টনের সমস্যাগুলি উপলব্ধি করেন এবং এই নিয়ে জেটল্যান্ড তার আপত্তিগুলি সুনির্দিষ্টভাবে লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউসে জানান। সেখানে তিনি বলেন এই কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড –

১) একটি অগ্রবর্তী জনগোষ্ঠীকে পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর অধীন করেছে

২) এটি সাম্প্রদায়িক তিক্ততা বাড়িয়ে দেবে

৩) বর্ণহিন্দুদের মধ্যে অবিচারের বোধ তৈরি করবে যা নানা উগ্র চেহারায় আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

বাস্তবে জেটল্যান্ডের আশঙ্কাগুলি সত্য প্রতিপন্ন হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার বা লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস জেটল্যান্ডের আশঙ্কাগুলিকে অমূলক মনে করে নি, কিন্তু বাংলার পরিস্থিতিকে তারা সর্বভারতীয় শাসননীতির নিরিখে বিচার করেছিল। খিলাফৎ আন্দোলনের পর গোটা দেশের মুসলিমদের কাছে পাওয়া ছিল তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনকর্তা উইলিংডন ব্যাখ্যা করে বলেন বাংলার গভর্নরের প্রস্তাবগুলি শুধু বাংলার নয়, গোটা দেশের মুসলিমদের সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় তৈরি করবে। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস দোলাচলতা নিয়েও বাংলা বনাম দিল্লির মতান্তরে দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসকদের মতেই সম্মতি দেয়।

সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ চূড়ান্ত হয়ে যাবার পর বাংলার হিন্দু ভদ্রলোকদের ক্ষোভ ও হতাশা প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করে।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর বাংলার কংগ্রেস সুভাষচন্দ্র বসু ও যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের অনুগামীদের মধ্যে আড়াআড়িভাবে বিভাজিত হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন প্রশ্নেই তাদের অনৈক্য ছিল স্পষ্ট। কিন্তু উভয় গোষ্ঠীই সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করে। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত গোষ্ঠীর মুখপত্র অ্যাডভান্স এবং সুভাষ চন্দ্র বসু গোষ্ঠীর মুখপত্র লিবার্টি এই বিষয়ে একই স্বরে কথা বলে। আনন্দবাজার, দৈনিক বসুমতী এবং সেকালের প্রধান সংবাদপত্র অমৃতবাজার পত্রিকা জোরালোভাবেই এই কমিউনাল অ্যাওয়ার্ডের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে। বর্ণহিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণির প্রতিবাদ ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল, তেমনি ক্রমশ তার অভিমুখ সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ এর ফলে বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত মুসলিম সমাজের দিকেও ঘুরে যায়। এর ফলে তিরিশের দশকের শেষ দিক থেকে বাংলার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকে।

[লেখাটিকে এখানে আর বড় করতে চাই না। যারা এই বিষয়ে বিস্তারিত পড়তে চান তাঁরা এই লিংক থেকে বিস্তারিতভাবে পড়তে পারবেন।
https://www.othervoice.in/article/ov-15-8-21-1 ]
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ১২:০৬
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×