AIT-তে পড়ি তখন। বিশ্বকাপে বিশ্ব একাদশ নিয়ে মাঠে নামা ইতিহাসের প্রথম টীম আমাদের। AIT স্পোর্টস অথরিটি, অর্থাৎ থিফা (ফিফার থাইল্যান্ড শাখা) এর আয়োজনে আমরা একটা ছোটখাট ফুটবল বিশ্বকাপে অংশ নিলাম। আমরা মানে মাস্টার্সের ক্লাসের আমরা বাংলাদেশী ৮ জন তিনজন ভুটানীজ আর ১ জন মিয়ানমার আর ১ জন মালদ্বীপ এর। সর্বসাকুল্যে ১৪ জন প্লেয়ার আমাদের। দলের নাম আর জাতীয়তা নিয়ে ঝামেলা হলেও ম্যানেজ করে ফেললাম। আমাদের বাদ দিয়ে মাইনক্যা চিপায় পড়ে যাচ্ছিল কমিটি। আমাদের বাদ দিলে ১৫ টা টীম হয়ে যায়। বাদ দিয়ে যাবে কোথায়।
আমাদের গ্রুপে ছিল কম্বোডিয়া আর ভিয়েতনাম। তারা কেমন খেলে বিন্দুমাত্র ধারনা নাই আমাদের। এমনকি আমরা নিজেরা কে কেমন খেলি সেটাও জানিনা। আমরা তখন AIT'র অন্যতম বড়লোক টীম। আমাদের এক টিচার আমাদের জন্য বেশ বড় একটা বাজেট রেখেছেন। জার্সি,খানাপিনাসহ বাজেটের একাংশ আমাদের বাকী নারী সহপাঠীদের জন্য বরাদ্দ আছে। দর্শক হিসেবে তারা উৎসাহ দিয়ে অর্ধেক জিতিয়ে দিবে আমাদের। সুতরাং এতে তাদেরও অধিকার আছে। তাছাড়া আমাদের সংবিধানের নারী অধিকারের ব্যাপারটাওতো অস্বীকার করা যায় না। ম্যাচের শুরুতেই আমাদের বাজেট শেষ। সমস্যা নাই। দ্বিতীয় পর্বে যেতে পারলে বাজেট দ্বিগুন হবে। তখন থাই বাথ দু'হাতে খরচ করেও কুলাতে পারব না। আমাদের স্ট্রাইকার ভুটানের হ্যান্ডসাম ক্লাসমেট নাফে। আমাদের রোনাল্দো সে। খেলার আগে তার সেকি ভাব, হ্যান কারেঙ্গা,ত্যান কারেঙ্গা। পরে বুঝলাম এই ভাব ফুটবলের গোল নিয়ে না, তার আসল উদ্দেশ্য বা গোল হলো মেয়েদের কাছে ভাব বজায় রাখা।
একটা প্রস্তুতি ম্যাচ খেললাম থাইল্যান্ডের সাথে। তাদের হারিয়ে দিয়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস উঠে গেল আকাশে।
চুড়ান্ত পর্বে আমাদের প্রথম ম্যাচ ভিয়েতনামের সাথে। চিন্তার কিছু নাই। তারা তো আর ব্রাজিল/জার্মানী না যে আমাদের বিশ্ব একাদশকে টেক্কা দিবে। খেলা শুরু হলো। বিপুল জোশে আট/দশজন প্লেয়ার ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওদের ডি-বক্সে। চারদিকে তুমুল উত্তেজনা। আমাদের ম্যারাডোনা মুরাদ মাঠভর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের সেরা স্ট্রাইকার,আমাদের মেসি, মিস্টার এহসান একটা সহজ গোল মিস করল। কবি বলেছেন,আশপাশে 'মিস' থাকলে গোল মিস হতেই পারে। তাকে মোটেও দোষ দেয়া যাবে না। দর্শকসারিতে কোন এক 'মিস' থাকাতেই গোলটা মিস হয়েছে। আমাদের সব জোশ একটু পরেই ফুরিয়ে গেল। আমাদের ফিটনেস তো সেই মাপের। আমরা হ্যামেলিনের ইদুরের মত ওদের স্ট্রাইকারদের পিছে দৌড়াচ্ছি। এর মাঝে ওদের এক স্ট্রাইকারের মাঝমাঠ থেকে নেয়া আচমকা শট গোল হয়ে গেল। আমাদের গোলকিপার তখন মিস্টার জিলানী। বিদেশী মিস-দের নজরে রাখতে গিয়ে বলটা সে মিস করেছে মর্মে পরে গোপনসূত্রে জানা গেল। আর্জেন্টিনা আর স্পেনের গোলরক্ষকের সব প্রতিভা দেখা গেল তার মাঝে। কখনো কাবালেরো,কখনো ডেভিড ডি গিয়া। আমাদের পাস দিতে গিয়ে ভুলে ওদের দিয়ে ফেলে। আমি ফুল ব্যাক ছিলাম। গোলকিপারকে বল দিতেও ভরসা পাচ্ছিলাম না। পাছে গোল হয়ে যায়। হাফটাইম পর্যন্ত তিনটা গোল হয়ে গেল ওদের। তবু আমরা বেশ পজেটিভ। এক হালি তো আর হয়নি!
গোল খেয়ে, ঘেমে নেয়ে আমরা হট হয়ে আছি। ফ্যানেরা (আমাদের নারী ক্লাসমেটরা) কাছে এসে কিছুটা হাওয়া(স্বান্তনা) দিল। একটু কুল হলাম। উৎসাহ সঞ্চয় করে আবার মাঠে নামলাম। এর মাঝে ওদের স্ট্রাইকারের রোনাল্ডো মার্কা শট, একটা নিশ্চিত গোল আমি ঠেকিয়ে দিলাম কান দিয়ে। ফলাফল হিসেবে পরবর্তি বেশ কদিন কানে ভোভোঁ শব্দ শুনতে পেতাম শুধু। আমি বুঝলাম আমাদের গোলকিপার বল না ধরে ভালই করেছে। কদিন পরেই আবার পরীক্ষা। বল ধরতে গিয়ে আঙুল ভাঙলে লিখবে কিভাবে? খেলায় পাশ করার চেয়ে পরীক্ষায় পাশ করা উত্তম। তাছাড়া মহানবী বলেছেন, 'জ্ঞানার্জনে তোমরা সুদূর চীনে যাও'। কিন্তু এটা কখনোই বলেননি 'তোমরা খেলাধুলার জন্য সুদূর থাইল্যান্ডে যাও'। তাই এতগুলো গোল খেলেও আমাদের ঠিক দোষ দেয়া যাবে না। দ্বিতীয় হাফে ১ হালি গোল খাবার পরে মিয়ানমারের লন্বু ক্লাসমেট জ' ম' (Jaw Moe) কে গোলরক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হলো। দলে অতিরিক্ত প্লেয়ার না থাকায় জিলানী গোল বার ছেড়ে রক্ষনভাগে চলে আসলেন। Jaw Moe পূর্বসূরীকে অনুসরন করে চললেন। ওদের একটা চমৎকার গোল উপহারও দিল সে। মাটি কামড়ানো শট তার পায়ের ফাঁক দিয়ে ঢুঁকে গেল জালে। আমরা ভেবে দেখলাম ওর কি দোষ, লম্বা মানুষের মাটি পর্যন্ত হাত নামাতে একটু দেরী হতেই পারে। দ্বিতীয় হাফে আমাদের বেশ উন্নতি হলো। আর মাত্র দুই গোল খেলাম। ফলাফল ০-৫। কম্বোডিয়ার সাথে পরের ম্যাচে ০-৪।
বিশ্বকাপ থেকে একটু তাড়াতাড়িই বিদায় নিয়ে নিলাম। সামনেই আবার পরীক্ষা। ছোটবেলায় আমাদের বাবা-মা রা পইপই করে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন পরীক্ষার সময়গুলোতে খেলাধুলা কম করতে। গুরুজনের উপদেশ না শুনলে পাপ হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১২:২৮