১. নস্টালজিক বিশ্বকাপ
১৯৮৬ সাল। ফুটবল বিশ্বকাপ চলছে। ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা ফাইনালে। ক্লাসের বন্ধুদের কাছে ম্যারাডোনার জাদুকরী পায়ের গল্প(এবং হাত!) শুনতে শুনতে কান নষ্ট হবার যোগাড়। আমাদের বাসায় তখনও টিভি আসেনি। তবু যেভাবেই হোক, যত রাতই হোক, খেলাটা দেখতেই হবে। বড় ভাইয়া পাশের বাসায় বন্ধুর বাড়ি চলে যেত গুরুত্বপূর্ণ খেলা থাকলেই। তার কাছে আবদার জানিয়ে রাখলাম। ভাইয়ার হাত ধরে মাঝরাতে গেলাম খেলা দেখতে। ফাইনাল ম্যাচ। সম্ভবত সেটিই আমার টিভিতে প্রথম খেলা দেখার অভিজ্ঞতা। ঘরভর্তি দর্শক। তুমুল উত্তেজনা। অনেক ছোট ছিলাম। ৬/৭ বছর হবে। এখনও মনে আছে ধারাভাষ্যকারের উত্তেজক গলায় বারবার শোনা যাচ্ছিল রুগেরি,বুরুচাগা,রুমেনিগে,ম্যারাডোনা এইসব নাম। ফুটবল আর বিশ্বকাপের ক্রেজ ভালমত বুঝলাম '৯০ তে এসে। ততদিনে ঘরে ঘরে টিভিও চলে এসেছে। ক্যামেরুনের রজার মিলা,আর্জেন্টিনার গোলকিপার গয়কোচিয়া ব্রাজিল,ম্যারাডোনার ভিউকার্ড আর তাদের ছবি আর লেখা নিয়ে পত্রপত্রিকায় বাজার সয়লাব। বিশেষ করে ম্যারাডোনার 'ওরা আমাকে এত মারে কেন?' লেখা ভিউকার্ড টা বোধহয় বাংলাদেশের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিউকার্ড ছিল। পরে বিটিভিতে ৮২ বা ৮৬ র ব্রাজিলের খেলা দেখে তাদের খেলার প্রেমে পড়লাম। মনে আছে কোন এক পত্রিকায় এক সাংবাদিক লিখেছিলেন ব্রাজিলের সেই 'জোগো বনিতো' বা সুন্দর ফুটবল নিয়ে -"জ্যামিতির মত বিচরণ, ফুলের মত পাস,নাচের মত ড্রিবল,কবিতার মত সমাপ্তি"। এখনকার ফুটবল খেলা অনেক কৌশলের, গতিময়তায় আর যান্ত্রিকতায় ভরা। সেই ফুটবলের ঝলক উত্তরাধিকার সূত্রে এখনও অবশ্য ব্রাজিল টীমে মাঝে মধ্যে দেখা যায়।
এই ফুটবল প্রেমিক ছেলের জন্য আমার বাবা একবার একটা ৩ নম্বরী ফুটবল কিনে আনলেন। একটু বেশি পাম্প দিলেই এটা ডিমের মত হয়ে যেত। সমবয়সীরা ততদিনে যেখানে ৪ নম্বর ফুটবল দিয়ে খেলছে তখন একসাইজ ছোট ডিম্ব-ফুটবল লইয়া আমি কি করিব সেই চিন্তায় অস্থির। ওটা দিয়েই ফুটবলের নতুন অধ্যায় শুরু করলাম। দিনে খেলতাম আর রাতে স্বপ্ন দেখতাম। বিশ্বকাপে সাব্বির,কায়সার হামিদ,আসলামদের সাথে নিয়ে পেলে ম্যারাডোনার মত ৪/৫ জনকে কাটিয়ে গোল দিয়ে দিচ্ছি। স্টেডিয়াম ভর্তি লাল সবুজের পতাকা!
২. দাগ থেকেই দারুণ কিছু
আমার ফুটবলের পায়ে খড়ি হয়েছিল গ্রামের আট-দশটা শিশুর মত। শহরে থাকলেও খেলাটার সাথে প্রথম পরিচয় গ্রামেই। গ্রামের দুরন্ত শিশু-কিশোরদের কাদা মা্খানো গোলাকার বস্তু নিয়ে ছোটাছুটি দেখে ভীষণ ইচ্ছে করত সেইটায় একটু পা লাগাতে । এতে লাথি না মারতে পারলে জীবনটাই বৃথা! তীব্র উত্তেজনা আর আনন্দের কাছে হার মেনেছিল শহুরে পোশাকে দাড়িয়ে থাকা ইতস্ততঃ শৈশব। খেলবা?-অচেনা এক কিশোরের শরীরে কাদা মাখানোর সেই ডাক ছিল আসলে জীবন রাঙানোর ডাক। সত্যিই! দাগ থেকে দারুন কিছুই হয়।
৩. আট ইঞ্চি শীল্ড
রুয়েটের বিশাল মাঠটা ফুটবলের দখলেই থাকত বিশ্বকাপ এর সময়। মাঝে মাঝে এ পাড়া বনাম ও পাড়ার মধ্যে খেলা চলত। খেলার পূর্বশর্ত ছিল কমপক্ষে একটা ৬/৮ ইঞ্চির শীল্ড। খেলার আগে কত ইঞ্চি বা কয়টা শীলের (তখন শাপলার ছাপ বসানো কালো 'শীল্ড'-কে আমরা ছোটরা শীল বলতাম) খেলা হবে বা খেলায় ফাউল থাকবে কিনা ইত্যাদি বিষয় ঠিক করে রাখা হতো, যেন পরে ঝামেলা না হয়। একেকটা ম্যাচের জন্য চাঁদা তুলে কেনা হতো সেই শীল্ড। কোন টীম আমাদের মত গরীব হলে শীল্ডের দাম ভাগাভাগি করে নেয়া হত। হলুদ , আকাশী জার্সি এখনকার মত এত সহজলভ্য ছিলনা। এমনকি সেগুলো কেনার সামর্থও আমাদের ছিল না। তখন বাড়ি বাড়ি লেইস ফিতাওয়ালা আসত। একবার এক এরকম ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কয়েক গজ হলুদ ফিতা কিনলাম। আমাদের জার্সি নাইতো কি হয়েছে? গায়ে হলুদ জার্সির বদলে মাথায় হলুদ ব্যান্ড । আমার অভিনব এই আইডিয়াতে সঙ্গিরা চমৎকৃত হয়ে গেল। পরে একজন বুদ্ধি দিল, খেলার সময় পায়ের দিকে বেশি চোখ থাকে সবার। তাই এই ফিতা হাফপ্যান্টের নীচে হাটুর কাছে বাঁধাই যুক্তিযুক্ত হবে। দলের সেরা গোল দাতার জন্য থাকত পিতলের/তামার মেডেল। সারা শরীর কাদায়-ধুলোয় ডুবিয়ে কখনও সেই শীল হাতে আবার কখনও শুন্যহাতে বিফল মনোরথে বাড়ি ফিরতাম। শীলগুলো হারিয়ে গেছে। দু'একটা মেডেল এখনও আছে। কখনো কখনো মনে হয় এই শীল বা মেডেলই আমার বিশ্বকাপ। আর এ অর্জন ম্যারাডোনা,রোমারিও বা লোথার ম্যাথিয়াসের হাতের সেই ফিফা বিশ্বকাপের চেয়ে কোন অংশেই কি কম!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:৫১