এক.
”কুকুরের মতো মেরে ফেলতে হবে এদেরকে, নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে পৃথিবীর বুক থেকে।” গম্ভীর ভাবে কথাটা বললেন আর্মি চিফ ইহুদ বারাক।
”সবাইকে না। মারতে হবে শুধু শিশু এবং তার সাথে সব প্রজননক্ষম নারী। তাহলেই ভবিষ্যত প্রজন্ম আর তৈরি হতে পারবেনা।” আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে সিগারের ধোঁয়ার কুণ্ডুলী উঠিয়ে কথাগুলো বললেন প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন। মাথায় তার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিভাবে মানুষগুলোকে মেরে সাফ করে পাশের দেশটাকে নিজেদের দখলে আনা যায়। গত কয়েকদিন ধরেই এই বিষয়টা নিয়ে রবিন গভীর চিন্তায় মগ্ন। আগের প্রধানমন্ত্রীরা যা করতে পারেনি, সেটা তাকে করে যেতেই হবে।
”কিন্তু প্রতিপক্ষওতো কম শক্তিশালী নয়। যতই ওদেরকে মেরে কচুকাটা করছি, ততই যেন আগের থেকে শক্তিশালী হচ্ছে তারা।” অসহিঞ্চু ভাবে কথাগুলো বললেন আর্মি চিফ।”
”চিন্তা করোনা বারাক। এইবারেই শেষ খেলা। শুধু টার্গেট করো সাপের বাচ্চাগুলোকে। বুলেটের আঘাতে বুক ঝাঝড়া করে দাও। আর না মরলেও ক্ষতি নেই। পঙ্গু হয়ে যাক বোমার আঘাতে। যেভাবেই হোক ওদেরকে ওই ভূ-খণ্ড থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।” চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো যেন আপন মনেই বললেন রবিন।
”কিছু মনে করবেননা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এতগুলো মানুষকে মেরে ফেলবো আমরা আর তারপর বিশ্ববাসী কিভাবে দেখবে এই গণহত্যার ঘটনাটাকে? ওদের সাথে শান্তি আলোচনায় বসলে হতোনা?” ইহুদ বারাকের কণ্ঠে কিছুটা উদ্বেগ।
”আহ! কি সব ছেলেমানুষের মতো কথা বলছো তুমি বারাক?!” স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ রবিনের মুখে। ”পৃথিবীটা এখন চালাচ্ছে কে? বলো? আমরা। আমরা চালাচ্ছি বিশ্ব। আমরা পৃথিবীর সেরা এখন।” দাম্ভিকতার সুর রবিনের কণ্ঠে। ”আমরা যা করবো, সব ঠিক। শোনো অফিসার, ওই ভূ-খণ্ডগুলো সব আমাদের। আর কোথাকার কোন মানুষজন এসে সেগুলোতে বছরের পর বছর দখল করে রয়েছে?! এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? ওদের তথাকথিত ওইসব সেনাগুলোতো আসলে সন্ত্রাসী। এদের সাথে আবার আলোচনা কিসের? ওয়ার্ল্ড মিডিয়াতে ইতিমধ্যেই ওদের সেনাদেরকে সন্ত্রাসী তকমা পড়িয়েছি। মনে রেখ, আমরা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি আমাদের পবিত্র ভূমিকে উদ্ধারের জন্যে। আমি ওদের শিশুগুলোর লাশ দেখতে চাই। এই আমার শেষ কথা।” তীক্ষ্ম দৃষ্টির চোখগুলো চকচক করে উঠলো রবিনের।
”আর মন দিয়ে শোন বারাক, আমি ইতিমধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের থেকে সম্পূর্ণ সবুজ সংকেত পেয়েছি। মানুষ মারার যত আধুনিক অস্ত্র লাগে, খুব শীঘ্রই তোমার সেনাবাহিনী সেগুলো হাতে পেয়ে যাবে। কাজেই আর বিলম্ব না করে তুমি সৈনিকদের তৈরি হতে বলো।” সিগারের শেষ অংশটুকু তার ডান পায়ের জুতোর নিচে জোড়ে চেপে ধরে সেটাকে পিষে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন রবিন।
দুই.
লায়লার আজ বিয়ে। কিন্তু বিয়ে বাড়ির উৎসবের কোন আমেজ নেই লায়লাদের বাড়িতে। থাকবেই বা কিভাবে? চারিদিকে স্তব্ধ একটা পরিবেশ। সবাই বলাবলি করছে পার্শ্ববর্তী দেশের সেনাবাহিনী আবার নাকি হামলা শুরু করবে। সেই থেকে তাদের শান্ত সুন্দর এই উপত্যকা এলাকায় থমথমে একটা পরিবেশ। আর কত মানুষ মারবে ওরা? আর কত প্রাণ ঝড়ে পড়লে তাদের শান্তি হয়? দু’হাজার আট আর বারো সালের কথাতো কেউ ভুলে যায়নি যেবার ওদের সেনারা বিনা কারণে এই উপত্যকার নিরীহ মানুষগুলোকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। পুরো বিশ্ববাসী সেই ঘটনা চেয়ে চেয়ে দেখলো। কিন্তু বিশ্বের মোড়ল সমাজ কোন টু' শব্দটুকু পর্যন্ত করলোনা। বর্বর ওই হামলায় কত প্রাণ অকালে ঝড়ে পড়লো। এবারও হয়তোবা তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। কাজেই এখানকার খেটে খাওয়া মানুষগুলোর মুখে এখন এক আতঙ্ক বিরাজ করছে। লায়লাদের পরিবারেও তার স্পষ্ট ছায়া পড়েছে।
লায়লার সাথে যে ছেলেটার বিয়ে হবার কথা, সে লায়লার বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক সহপাঠী। নাম ওমর। ছাব্বিশ বছরের এক তরুণ যুবক। পরস্পরকে তারা পছন্দ করে বেশ অনেকদিন থেকে। পারিবারিক ভাবেই ওমরের সাথে লায়লার বিয়ের আজকের দিনটি কয়েক মাস আগে ঠিক করা হয়। কিন্তু যুদ্ধের এই ডামাডোলের মাঝে সবকিছুই যেন অনিশ্চিত। আজ তাই এত সুন্দর একটা দিনেও লায়লার মনটা বিষন্নতায় ভারী হয়ে আছে।
ছোটবেলা থেকেই এই উপত্যকার মানুষগুলো যুদ্ধের সাথে নিয়মিত যুঝছে। প্রতিনিয়ত অনিশ্চিত জীবন আর মুত্যু ঝুঁকি-ই যেন তাদের নিয়তিতে লেখা রয়েছে। তারা যেন পৃথিবীর বুকেই ভিন্ন একটা গ্রহের বাসিন্দা যেখানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কখনই ছিলনা। এমন কোন পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবেনা যাদের পার্শ্ববর্তী হত্যাকারী রাষ্ট্রের হাতে আপনজনরা শহীদ হয়নি। কাজ, খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা - এই অভাবগুলো যেন এখন এই উপত্যকাবাসীর দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী। যারা পারছে এই ছোট্ট দেশটি ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে। আর যারা পারছেনা, তারা হত্যাকারীদের হাতে মারা পড়ছে। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে একজন মানুষ আরেকজনকে হত্যা করলে হত্যাকারীর বিচার এবং শাস্তি হয়। আর ওদের প্রশাসন দিনের পর দিন হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মেরে চলেছে। তাদের কোন বিচার নেই? কোথায় যাবে এই অসহায় মানুষগুলো? কার কাছে তাদের আপনজনদের হত্যার বিচার চাইবে? স্রষ্টা যেন পুরো পৃথিবীকে দেখেন, শুধু তাদের বস্তিগুলো ছাড়া। এসব ভাবতে ভাবতেই লায়লার চোখের কোণ থেকে টপটপ করে পানি ঝড়তে লাগলো।
এই সময় হঠাৎ তীক্ষ্ম সাইরেনের আওয়াজে লায়লা সম্বিত ফিরে পেল। আর তারপর পরেই আহমাদ চাচা ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকলেন। উদভ্রান্তের মতো চেহারা তার। তাকে সামনে পেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কোনমতে বললেন ”লায়লা মা, এক্ষুণি বাসা থেকে বের হও তোমরা। হানাদার বাহিনী বিমান হামলা শুরু করেছে। এখানে থাকা আর এক মুহূর্তও নিরাপদ নয়। আমার গাড়ি বাইরে অপেক্ষা করছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হও তোমরা।”
আহমাদ চাচার সাথে লায়লা, তার ছোট ভাই, বাবা আর মা এক কাপড়ে বের হয়ে এল। কোনমতে গাড়িতে উঠতে উঠতে শুনতে পেল গুলি আর বোমার আওয়াজ। মানুষজন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। যে যেভাবে পারছে পালাচ্ছে। লায়লাদের গাড়িটা যত দ্রুত সম্ভব ছুটে চলেছে শহরের রাস্তা ধরে। যাবার পথেই তারা দেখলো চারিদিকে লাশ আর রক্তের ছড়াছড়ি। কিছুক্ষণ আগের এই শান্ত ছোট্ট শহরটা বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হচ্ছে চোখের সামনেই। হঠাৎ বিকট এক আওয়াজে জ্ঞান হারালো লায়লা।
তিন.
জ্ঞান ফেরার পর ধীরে ধীরে চোখ মেললো লায়লা। কোথায় আছে সে? তার চারপাশে এরা কারা? এত মানুষ কেন? মানুষের চিৎকার, কান্না আর আওয়াজে লায়লা নিজের ভেতরে এক অজানা ভয় অনুভব করলো। হঠাৎ একটা পরিচিত মুখ ঝাপসা চোখে সে দেখতে পেল। এই মানুষটা কি ওমর? হ্যাঁ, ও তো ওমর। শুকনা ঠোটে ওমরের নাম ধরে ডাকার একটা ক্ষীণ চেষ্ট করলো সে।
”এখন কেমন লাগছে লায়লা?” মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে স্নেহের কণ্ঠে হাসপাতালের বিছানায় পাশে বসা ওমর জিজ্ঞাস করলো।
”আমি কোথায় আছি ওমর?” ক্লান্ত মলিন কণ্ঠে ওমরের হাতটা ধরতে চাইলো লায়লা।
”আলতোভাবে লায়লার হাতটা নিজের হাতে রেখে ওমর বললো, তুমি হাসপাতালের বিছানায় আছো প্রিয়তমা।” তারপর একটু বিরতি দিয়ে চোখ নামিয়ে ওমর বললো, ”গত পরশু বিমান হামলা শুরু হবার পর তোমরা আহমাদ চাচার গাড়িতে শহর ছেড়ে পালাচ্ছিলে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। একটা বোমা এসে তোমাদের গাড়িতে আঘাত করে। আর তারপর...” কথাটা শেষ করতে পারলোনা ওমর। চোখ দিয়ে তার পানি ঝড়ছে।
”তারপর কি? তারপর কি হলো ওমর? কথা বলছোনা কেন? আল্লাহর দোহাই লাগে তারপর কি হলো বলো।” দুর্বল হাতে ওমরকে ধাক্কা দিতে লাগলো লায়লা।
”ওই গাড়িতে যারা ছিল তোমার সাথে, একমাত্র তোমাকেই বাঁচানো সম্ভব হয়েছে, যদিও তোমার ডান পা' টা ...।” এ পর্যন্ত বলেই ওমরের বিষন্ন কণ্ঠ থেমে গেল।
লায়লা অনুভব করলো তার ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কোন অনুভূতি নেই। বুঝতে কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগলো যে, আর কোনদিন ডান পায়ে ভর দিয়ে সে হাঁটতে পারবেনা। কিন্তু তার আর কোন অনুভূতিই এখন কাজ করছেনা। পুরো শরীরে যেন সীমাহীন ক্লান্তি, ঘুমে যেন পড়ে যাচ্ছে সে।
”লায়লা, লায়লা” বার কয়েক ডাক শুনলো সে ওমরের। চোখ খুলে কোনমতে তাকালো সে প্রিয় মানুষটার দিকে।
ওমরের কণ্ঠ শুনতে পেল আবার, ”গত পরশু আমাদের বিয়ে করার কথা ছিল লায়লা। কিন্তু পাশের রাষ্ট্রের কাপুরুষ হত্যাকারীরা সেটা হতে দিলোনা। নির্বিচারে মানুষ মারছে তারা। এরই মাঝে কয়েকশো নিরীহ মানুষ মারা পড়েছে, পুরো বিধ্বস্ত হয়েছে আমাদের সাজানো সুন্দর শহরটা। কত শিশুর লাশ রাস্তায় পড়ে আছে, সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেনা।”
ওমর একটু দম নিলো। লায়লার হাতে আলতো চাপ দিয়ে বলতে লাগলো, ”আমি তোমাকে ভালোবাসি লায়লা। তোমার সাথেই কাটাতে চাই আমার বাকীটা জীবন।” এ পর্যন্ত বলেই ওমরের চোখমুখ কঠিন হলো। ”কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন সময় এসেছে হত্যাকারীদের পাল্টা জবাব দেবার। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে আমাদের। আমাকে তাই যেতে হচ্ছে যুদ্ধে। এই যুদ্ধ আমাদের নিজেদেরকে বাঁচানোর যুদ্ধ, এই যুদ্ধ আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচানোর যুদ্ধ। আমার হাতে সময় একেবারেই কম...।”
”কিন্তু তুমি কি পারবে ওমর ওদের সাথে যুদ্ধ করে? ওদের হাতে মানুষ মারার সব ভয়ঙ্কর অস্ত্র।” ক্লান্ত ক্ষীণ স্বরে লায়লা জিজ্ঞেস করলো ওমরকে।
”আমাদেরকে পারতেই হবে। তোমরা মনে আছে লায়লা? পূর্ব পাকিস্তান নামের একটা দেশ ছিল, যে দেশের মানুষগুলো একসময় পাকিস্থানী বর্বর শাসকগোষ্ঠীর হাতে মার খেত? তারপর একটা সময় তারা ঘুরে দাঁড়ালো। নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্যে তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করলো। শুরু হলো যুদ্ধ। তারপর ইতিহাস কথা বলে তাদের স্বপক্ষে। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে তারা তাদের দেশকে স্বাধীন করেছিল, নতুন একটি দেশের জন্ম দিয়েছিল যার নাম পৃথিবীর বুকে এখন উজ্জ্বল, সেই নামটি ’বাংলাদেশ’। বাংলাদেশীরা দীর্ঘ সংগ্রামের পর তাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলে আমরা পারবোনা কেন? আমাদেরকেও সর্বাত্তক চেষ্টা করতে হবে।” এক নি:শ্বাসে কথাগুলো শেষ করলো ওমর।
ক্লান্ত শরীরে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলো লায়লা। তারপর অনুভব করলো তার হাত থেকে ধীরে ধীরে ওমরের হাতটা সরে যাচ্ছে। ওমরকে সে তার চোখের পানি দেখাতে চায়না। তাকে যেতে বাধা দিতে চায়না। শুধু মনে মনে বললো, ”আমি জানি, তুমি পারবে ওমর, তোমাকে পারতেই হবে।”
গল্পটি কানাডার টরন্টো থেকে প্রকাশিত 'সাপ্তাহিক আজকাল' পত্রিকার ২৯ আগস্ট, ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত।