সকাল এ উঠে সব গুছিয়ে আমাদের বেড়ুতে বেলা দশটা হয়ে গেল। চললাম আমরা মেলবোর্ন সিটি পেড়িয়ে, ইয়ারা নদীর নীচের টানেল দিয়ে চলে, বিশাল বড় ওয়েস্ট গেট ব্রীজ পার হয়ে আরো দূরে।
ওয়ারেবী নামের একটা জায়গাতে একটু থামলো আমাদের গাড়ী, আবার ছুটে চলল। গাড়ীতে আমাদের জিপিএস নেই। আগের দিন রাতে মেইল ওয়ে দেখে নেয়া ছিল পথঘাট। রাব্বী ভাই, যিনি গাড়ী চালান প্রতি মুহুর্তেই কনফিউজড হয়ে যান আর আমাদেরও চিন্তিত করে ছাড়েন। এরপর আমাদের দুবোনের সিদ্ধান্তে আমরা সঠিক পথেই যাই। এপর আমরা পেরুলাম জিলং। জিলং আমার নামে-চেনা শহর। "লীজ" এর বাড়ী জিলং। লীজ ইরি’র একজন বড় সাইন্টিস্ট। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি জিলং এর পাহাড়ী টিলা টিলাময় এলাকা। অত বড়বড় পাহাড় নয মাঝারী টিলা। এখানে টিলাগুলোতে বসতি গড়ে উঠছে, বাড়ী উঠছে ঝটপট। এই ছোট টিলাময শহর দেখে আমি মুগ্ধ হযে চলছি......কে জানতো আরো কত বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য!
জিলং পেড়িয়ে আমরা এঞ্জেল সী ধরে গ্রেট ওসেন রোডে উঠে পড়লাম, আমাদের ধারনা ছিল গোটা রোডটাই সাগর পাড় ধরে....তবে আমরা যেটি দিয়ে শুরু করলাম সেটা পাহাড়ের উপরের বনাঞ্চল ধরে চলছে, বা পাশে সাগর, তবে ঘন আর বিশাল বৃক্ষরাজির জন্য সাগর দেখা যাচ্ছে না। কিছু দূর যাবার পর এঞ্জেল সীর “সার্ফ কোস্ট” এ দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে সবাই দাঁড়ালাম। এই প্রথম আমাদের “সাউথ ওসেন” দেখা! আহা কি যে সুন্দর! খাড়া পাহাড়ের ঠিক পায়ের কাছে নীল সবুজ সাগরের উপচে পড়া ঢেউ! মুগ্ধতায় ঠান্ডার অনুভূতি তুচ্ছ মনে হয। অবশ্য বাতাস ছিলনা বলে শীতও কমই ছিল, সাধারনত সাগর পাড়ে তুমুল বাতাস থাকে। নাকি আসলেই উত্তেজনায় শীত উধাও হয়েছিল কে জানে!
আরো খানিকক্ষন পরে এইরকম আরো একটুকরো বীচ, দাঁড়াবার সুযোগ আছে সেখানে। বীচটা একটু নীচে, ঠিক খাড়া পাহাড়ের নীচে নয়....পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। আমি আর জাফনা চললাম বালুকাবেলায় পেছন পেছন বড়পা রাব্বীভাইও এলেন। খানিকক্ষন ছবি তুলে চোখভরা মুগ্ধতা নিয়ে আবার আমরা চরতে শুরু করলাম। চলতি পতে এই একই রকম ছোট চোট বাঁকে একই রকম পাথুরে অথবা বালুময় বীচ পড়লো প্রতিটাতে থেমে চললে নির্ঘাত আমাদের "এপালো বে" পৌছাতেই সন্ধ্যা হবে......তাই আমরা শুধু দেখেই "আহ কি সুন্দর" বলতে বলতে চলতে থাকলাম। এদিকে জাফনা বলছে 'আম্মু, তুমি যা দেখ তাই বল আহ কি সুন্দর"...। আর আমি বলি "বাহ সুন্দর লাগলে বলব না!'
সাগর পাড়ের খাড়া পাহারের গা বেয়ে সাপের মতন আকাবাকা যে পথ, সে পথ যে কি সুন্দর! দুটো পাহাড় পাশাপাশি একটি দিয়ে অনেকখানি ভেতরে ঢুকে নেমে পড়লাম, আবার পরেরটির নাগাল পেয়েই ঠিক একই পথে বিপরীত দিকে আবারো উপরে উঠে পড়ছি, আমার মুগ্ধ হবার ক্ষমতা অপরিসীম, কাজেই আমি আবার আহা উহু শুরু করলাম। এই খাড়া পাহাড় এর গায়ে যে সাপের মতন (এত বেশ আকা বাকা যে জোরে গাড়ী চালালে মাথা ঘুরতে শুরু করে, বমিও পেতে পারে) এই ওঠা এই নামা পথ, এই পথ যখন বানিয়েছে তখন কিভাবে বানালো বিস্মিত হতে হয়........একটা দেশ কত উন্নত তা তার পথঘাট দেখলে বোঝা যায়, আরো কত কত বছর পর আমাদের বান্দরবানে অথবা খাগড়াছড়িতে অথবা কক্সবাজারের পাড় ছুয়ে এই রকম পথ তৈরী হবে কে জানে!
রাব্বী ভাই এর ভাষ্যমতে এই রাস্তাঘাট বানানো হয়েছিল সব কয়েদীদের দিয়ে আর এবোরিজিনদের দিয়ে, কথাটা সত্য কিনা জানা নেই তবু মনে হয় হতেই পারে....প্রতিটা সভ্যতার পেছনেই এক নিমর্ম ইতিহাস লুকানো থাকে। আমাদের সরকার আমাদের টপটেররদের নিয়ে এইরকম প্ল্যান শুরু করলেই পারে :প।
চলতে চলতে আমরা পৌছলাম লরনে বীচে, লরনে একটা সাজানো গোছানো বীচ শহর। বীচের পাড়ে সুন্দর ছবির মতন গোছানো একটা পার্ক ওখানে দুপুরের খাবারের জন্য গাড়ী থামালাম........দেখি এক ঝাক সাদা ধবধবে কাকাতুয়া! কাকাতুয়াগুলো টুরিস্টদের পাল্লায় পড়ে শহুরে হয়ে উঠেছে, রুটি, বিস্কট, আপেল যা খাবার দিচ্ছে তাই খাচ্ছে! খাবার যার হাতে, তার গায়ে হাতে উঠে পড়ছে। তাই আমরা খাবার নিয়ে গাড়ীতেই বসলাম। ছিমছাম লরনা বীচে জাফনার অনেক দিন থাকার ইচ্ছে হোল। তবু আমরা আবার ছুটলাম সামনের দিকে কারন এপালো বে এখনো অনেক দূরে।
একই রকম মনকাড়া সাগড় পাহাড়ে মিলনমেলা দেখতে দেখতে আমরা পৌছুলাম এপোলো বে তে। এপালো বে আরো সুন্দর! বড় বালুময় বীচ। কিন্তু শখের টুয়েলভ এপোসোলের দেখা যে এখনো পেলাম না! আমাদের ধারনা ছিল টুয়েলভ এপোসল এপোলো বে তে। আসলে রাব্বী ভাই আর বড়পা বলছিল সেইরকম। আমি ঠিক জানি টুয়েলভ এপাসোল পোর্ট কেম্পবেল এ যা কিনা এপোলো বে থেকেও ৯৫ কিলোমিটার দূরে! তাই কিছু বলছিলাম না। রাব্বী ভাই এর ব্যাকপেইন, এতদূর গাড়ী চালানো উনার পক্ষে কঠিন, এমনিতেই সারাদিন গাড়ী চালাচ্ছেন, তাই আমরা এখান থেকেই ফিরবো ধারনা করছিলাম। কিন্তু উনি তখন ক্ষেপেছেন, টুয়েলভ এপোসোলস না দেখিযে ছাড়বেন না। তাই পথ জেনে নিয়ে চললেন পোর্ট কেম্পবেল টুয়েলভ এপোসোলস এর দিকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১১ সকাল ১০:৩০