এক স্কটিশ বন্ধু জাতীয়তার প্রশ্নে আইরিশ বন্ধুকে খোঁচা দিলেন একটু, তারপর অবশ্য নিজেই বিষয়টি সম্পর্কে মনত্দব্য করতে গিয়ে বললেন, বহুজাতির দেশ ব্রিটেনই একমাত্র দেশ যেখানে মাল্টি-ন্যাশনালিজম একসঙ্গে শুধু টিকে আছে বললে ভুল বলা হবে, বরং দিন দিন এর উৎকর্ষ বাড়ছে। আজকের ইউরোপে যে, নতুন করে উগ্র জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে সেটা ঠেকানোর জন্য ইউরোপের উচিত ব্রিটেন থেকে শেখা। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন অভিবাসীদের শরীরের ময়লার সঙ্গে তুলনা করেন সেখানে একজন ব্রিটিশ এমপিকে এশিয়দের নিয়ে কটাৰ করার দায়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়, এবং সেই দলটি কিন্তু আর কেউ নয়, কনসার্ভেটিভ দল, যারা এক সময় ব্রিটেনে অভিবাসী ঠেকানোর আন্দোলনে পুরোধা ছিল। কিন্তু আজ তারা এই অভিবাসী সমপ্রদায়কে অস্বীকার করতে পারছে না কারণ ব্রিটেনের আজকের অর্থনীতির অনেকটাই নির্ভর করে আছে এই অভিবাসী শ্রেণীর ওপর। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন আজ জাতি-সাম্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণ, এখন ব্রিটেনের অনন্য সম্পদ এই অভিবাসী জাতি-গোষ্ঠী। এই ব্রিটেনে এখন সকলেই নাগরিকত্বে ব্রিটিশ কিন্তু জাতিত্বে কেউ ভারতীয়, কেউ বাঙালি, কেউ ইংলিশ, কেউ স্কটিশ কেউ বা আইরিশ।
বন্ধুর কথায় আমার মনে পড়লো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। যিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্-এ দাঁড়িয়ে একটি ভাষারাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন রক্তৰয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ যে জিন্নার দ্বি-জাতি তত্ত্বকে মিথ্যে প্রমাণ করে দেওয়া সেই সত্য অবশ্য বলার অপেৰা রাখে না কিন্তু পঁচাত্তরের পরে সেই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদই ফিরিয়ে আনা হলো, বাঙালিত্বকে দেওয়া হলো কালাপানি-দণ্ড। আজকে অনেকেই বলেন যে, আপনি যে নিজেকে বাঙালি বলেন, আপনার পাসপোর্টে তো আপনি বাংলাদেশী _ এই দলটির বক্তব্য মেনে নিয়েও একথা বলতে চাই যে, নাগরিকত্বে আমি বাংলাদেশী হতে পারি কিন্তু জাতীয়তায় আমরা বাঙালি। যদি সেটা না হতে পারি তাহলে তো আমাদের কোনও অস্বিত্বই থাকে না। কারণ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ যে কাঁঠালের আমসত্ত্ব আর এটা যে পূর্বাণী হোটেলে বসে জিয়াউর রহমানের অর্থায়নে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক সনত্দোষ গুপ্তদের জঠরে জন্ম নেওয়া সনত্দান, যে সনত্দান লালনে পরে অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আরেক ধর্মবাদী আবুল মনসুর আহমদ, যিনি মনে করতেন মুক্তিযুদ্ধ জিন্নার দ্বি-জাতি তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করে নাই (আমার দেখা রাজনীতিন পঞ্চাশ বছর, পড়ুন)। আসলে আমাদের এই তথাকথিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আর কিছুই নয়, জিন্নার দ্বি-জাতি তত্ত্বের সেই বিষবৃৰের ফল, যা আমাদের জ্ঞানপাপীরা গন্ধমের মতোই খেয়ে যাচ্ছেন।
আজকে বন্ধুর জন্মদিন থেকে ফেরা অব্দি এসব নিয়েই ভাবছিলাম, আপনাদের সঙ্গে ভাবনাটি বেটে না নেওয়া পর্যনত্দ শানত্দি পাচ্ছিলাম না।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০