somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কর্ণেলকে আমি মনে রেখেছি-৩

৩১ শে জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ৮:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কর্ণেলকে আমি মনে রেখেছি-১
কর্ণেলকে আমি মনে রেখেছি-২
শব্দটা শুনে আমাদের গাড়ির চাকা থেমে গিয়েছিল। পাহাড়ী পথের এক বাকে বিডিআরের চেকপোষ্টে মেশিনগান ধরে একজন বসে আছে। আরেকজনের হাতে ওয়্যারলেস। সেই ওয়্যারলেসওয়ালা বিডিআর জোয়ানের সোজা লম্বা হালকা পাতলা শরীর দেখে আমি ভাবলাম এতটুকু যন্ত্র থেকে...। ভদ্রভাবে সে জিজ্ঞাস করলো
: আপনাদের পরিচয়।
: আমরা ছবি তুলি্ নাইক্ষ্যংছড়ির পদ্ম পুকুরের ছবি তুলবো। চট্টগ্রাম থেকে এসেছি।
: আপনার কথায তো চট্টগ্রামের টান নেই। আপনার বাড়ি কোথায়? কি করেন?
: আমার বাড়ি পাবনা। আমরা ছবি তুলে বিক্রি করি। ক্যালেন্ডারের জন্য।
: ও আচ্ছা। কোথায় উঠবেন?
: দেখি কোন একটা হোটেলে। আচ্ছা যান তবে রাতে ঘোরাঘুরি করবেন না। এলাকাটা ভালো না। আর আমার বাড়ি রাজশাহী।
: ও আচ্ছা, তাই নাকি? ঠিক আছে ভাই। যাই।
আবারো বেবি টেক্সি। একটানা শব্দ। আমার ভাল লাগছে না। এ ধরনের কোন শব্দের প্রতি আমার ভালোবাসা নেই। শুনশান নিরবতার মাঝে আমি হেটে যেতে চাই। দূরে বহু দূরে। ঝির ঝির বাতাস বইবে। কিঙবা ঘন বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির একটানা ঝরে পড়ার মাঝে আমি চলতে থাকবো । আমার পায়ে লেগে থাকবে পাহাড়ী মাটির কাদা। আমি সেই ভেঁজা মাটির গন্ধ নেব....।
না এমনটা হচ্ছে না। আমি ভাবছি।
সব নিরবতা ভেঙ্গে দিয়ে মোস্তাফিজ ভাই বললো
: সাগর ভাই মিথ্যা বললেন কেন?
: না বললে ওরা বেশ ঝামেলা করতো।
: ঠিক বলেছেন।
রাত বাড়ছে। এর পরের এক ঘন্টার মধ্যে নিকষ কালো অন্ধাকার জেঁকে ধরলো আমাদের। আমরা তখন পৌঁছে গেছি। হোটেলের ম্যানেজার একজন আব্দুল হক। আমাদের দুটো সিঙ্গেল রুম দিলো।
রাতে খেয়ে দেয়ে আগামীকালের জন্য প্রস্তুতি কি হবে তা নিলাম। প্রথমে এই এলাকাটি রেকি করতে হবে। সোর্স বের করতে হবে। যে এখানে থাকা মিয়ানমারের জঙ্গী সংগঠনের বিষয়ে খোঁজ দেবে। এরপর প্রয়োজনে বিডিআর রিজিওনে দেখা করতে হবে। ওদের কাছেও বেশ তথ্য আছে।

পাহাড়ের ভোর হয় অদ্ভুত ভাবে। নাইক্ষ্যংছড়িতে এখানো একটু বুনো ভাব আছে। সকালে এখানে বুনো গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। সেই গন্ধ বুধ ভরে নেয়া যায়। সূর্যটা এখানে বেশ হাসে। ভোরের লাল সূর্যটা মায়া মায়া রোদ ছড়িয়ে দিচ্ছে সবখানে। কি নাস্তা করা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে বেগ পেতে হলো না। হোটেলে গোল্লা গোল্রা আলু ভর্তা আর ডাল সাথে খাইস্যা আর মাছ ভাজি দিয়ে দুদান্ত একটা নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম।
মানুষের সাথে কথা বলছি। একজন এক ধরনের তথ্য দিচ্ছে। একজন জানালো এখান থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূরে বিডিআররা বার্মিজ সন্ত্রাসীদের লুকিয়ে রাখা অস্ত্র খুঁজছে। সেখানে ওদের পরিত্যক্ত অনেক ক্যাম্পের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গুলি বিনিময হচ্ছে। এরই মধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি ম্যাপ পেয়ে গেলাম। পেয়ে গেলাম দুজনকে। কথা বলবো একটি গ্রুপের লিডারের সঙ্গে। সব ঠিক হচ্ছে। কিন্তু তার আগে দেখা দরকার বিডিআর কি করছে। যা শুনছি তা কি সত্যি না মিথ্যে ঘটনা।
..................................................................
বিডিআর রিজিওন হেড কোর্য়াটারের সামনে বিকেলের পড়ন্ত রোদে এসে দাঁড়ালাম। কিন্তু কমান্ডার কি আমাদের দেখা দেবেন? কারণ এটা কোন অফিস সময নয়। তারপরও চেষ্টা। আমি এখনো বুঝতে পারছিনা সত্যিই এখানে লে: কর্নেল আওয়াল, যিনি আমার পরিচিত, তিনিই দায়িত্বে আছেন কিনা!
......................................................................
......................................................................

ঘরের সামনে উঠোন। সেই উঠোনে একটা টুলে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা বসেছিলেন। আরেকটি টুলে বসে বাবা চিত্ত কিশোর চাকমা ধুতির দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছেন। এবার ফসলের অবস্থা বেশ ভালো। রাঙ্গামাটির মহামপুর এলাকা। পাহাড়ের কোলে এবার ধানের শীষ বেশ মোটা হয়েছে। ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান হয়েছে সদ্য। ধুতির সাদা রঙ্গের দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবছেন ১৯০০ সালের হিট ট্রাক্টস রেগুলেশনের কথা। যেখানে এই এলাকাকে বিশেষ অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অথচ পাকিস্তান সরকার এখানে পাহাড়িদের দিকে কোন নজরই দিচ্ছে না। গ্রামের জুনিযর হাই স্কুলের শিক্ষক চিত্ত কিশোর জানেন তার অধিকারের কথা। তার স্ত্রী সুভাষিনী দেওয়ান বাড়ির কাজ নিয়ে বেশ ব্যস্থ।
: আচ্ছা বাবা কেন এমন হয়?
: কি ?
: এই যে পকিস্তান সরকার আমাদেরকে সম্মান দিচ্ছে না।
অবাক হয়ে গেলেন বাবা। মাত্র মেট্রিকের গন্ডি পেরোনো মেজ ছেলে কি করে মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে?
: তুই বুঝবি না।
: কেন বুঝবো না বাবা। আমি সব বুঝি। তুমি বুলু দাদাকে জিজ্ঞাস করো সে সব জানে।
বুলু, মানে শুভেন্দু প্রসাদ লারমা, ছোট্ট পরিসরে পাহাড়ের কোনায় কোনায় থাকা মানুষদের সঙ্গে কথা বলছেন। বোঝাচ্ছেন অধিকারের কথা। বাবাও শুনেছেন তার বড় ছেলের কাজ কারবারের কথা। একরাতে সুভাষিনীকেও জানিয়েছেন। সুভাষিনী বেশ গৌরবের সঙ্গে বলেছেন,
: আমার ছেলে তো ঠিকই করছে। এ কাজ তো ওদেরই করার কথা। বাবা আর কথা বাড়াননি।

মানবেন্দ্রকে কলেজে ভর্তি করাতে হবে। ও যেনো কেমন। আর দুই ছেলে কিংবা মেয়ে মিনু, জ্যোতিপ্রভা লারমা, এই তিনজনের চেযে সে আলাদা। ওর চোখে মুখে এক ধরনের দিপ্তি।
মানবেন্দ্রকে বাবা বললেন..
: কলেজে ভর্তি হও পড়ালেখা কর। আপাতত এটাই তোমার কাজ। অন্য কিছু না ভাবলেও চলবে।
: তা ঠিক। আচ্ছা বাবা দেশ আগে না মানুষ?
বাবা কোন উত্তর দিলেন না। এই প্রশ্নের উত্তর মানবেন্দ্র খুব ভালো ভাবে জানে। তার সব জানা আছে।
১৯৫৮ সালের এই হালকা শীতে বাবার গা কেমন যেনো গরম হয়ে ইঠছে। স্কুলের ছুটি না থাকলে হয়তো ভালোই হতো। বাচ্চাদের পড়ানোয় ব্যস্থ থাকলে অন্য কোন সমস্যা সমস্যা মনে হয় না। গায়ে প্রচন্ড জ্বর অনুভব করছেন চিত্ত কিশোর চাকমা। তিনি কি মানবেন্দ্র বা সুভাষিনীকে জানাবেন তার জ্বরের কথা.....
: বাবা তুমি শুয়ে থাকো। একটু বিশ্রাম নিলে জ্বর নেমে যাবে।
অবাক হয়ে রইলেন চিত্ত কিশোর। এ ছেলে মানুষের মনের কথা জানে কি করে!
এখনো দুপুর হয়নি। চিত্ত কিশোর ঘরে চলে গেলেন। কাঠের বাড়ি। নারিকেল গাছ কয়েকটা। বেশ শখ করে লাগিয়েছিলেন তিনি। এগুলো একন বেশ বড় হযেছে। ফল দিচ্ছে। মাঝে মাঝে পিঠে হয় এই গাছের নারিকেল দিয়ে। সুভাষিনী বেশ ভালো পিঠে বানাতে পারে।

*******************
বাড়ির মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ছেলেটি বললো
: দাদা দেখো কত বড় একটা মাছ পেয়েছি?
: মাছ ধরলেই চলবে নাকি পড়া লেখা করতে হবে?
পাহাড়ী ছড়ার পানিতে হাতরে মাছ ধরেছে সে। সারা গায়ে কাদা। মাছের আশটে গন্ধ। সারাদিন পনপন করে ঘুরে বেড়ায় তাদের এই ছোট ভাইটি। স্কুলের পড়ছে। টানা একটা চর মারলে ভালো হতো। তা তিনি মারবেন না। স্কুল বন্ধ । এখন কেবল বই পড়া আর মাছ ধরা।
মাছটি এখনো জীবিত। পেট ভর্তি ডিম। বোঝাই যাচ্ছে মা মাছ।
সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে পরিবারের কনিষ্ট ছেলেটি বললো;
: দাদা মাছটিকে ছেড়ে দিযে আসি।
: কেন
: না এটা ছেড়ে দিলে এখান থেকে অনেক মাছ হবে। আমরা একদিন মাছ না খেলে তো কিছু হবে না!
মাথা নেড়ে ছোট্ট ভাইটির কথায় সম্মতি দিলো সে।
দাদার সম্মতি পেয়েই দৌড়।
সন্তু বেশ ভালো দৌড়াতে পারে.........

( এটি একটি উপন্যাসের অংশ। তবে এতে অনেক ঘটনাই সত্য। কিছু নাম কারও কারও সঙ্গে মিলে যেতে পারে। এরা সকলেই উপন্যাসের চরিত্র)

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ৮:৩১
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ওহাবী-সালাফি-মওদুদীবাদ থেকে বাঁচতে আরেকজন নিজাম উদ্দীন আউলিয়া দরকার

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই জুন, ২০২৪ দুপুর ২:৩৩

১.০
ঐতিহাসিক জিয়া উদ্দীন বারানী তার তারিখ-ই-ফিরোজশাহী বইতে শায়েখ নিজাম উদ্দীনের প্রভাবে এই উপমহাদেশে জনজীবনে যে পরিবর্তন এসেছিল তা বর্ণনা করেছেন। তার আকর্ষণে মানুষ দলে দলে পাপ থেকে পূণ্যের পথে যোগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই ৩০ জন ব্লগারের ভাবনার জগত ও লেখা নিয়ে মোটামুটি ধারণা হয়ে গেছে?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৬ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৯



গড়ে ৩০ জনের মতো ব্লগার এখন ব্লগে আসেন, এঁদের মাঝে কার পোষ্ট নিয়ে আপনার ধারণা নেই, কার কমেন্টের সুর, নম্রতা, রুক্ষতা, ভাবনা, গঠন ও আকার ইত্যাদি আপনার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আর্তনাদ

লিখেছেন বিষাদ সময়, ১৬ ই জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২১

গতকাল রাত থেকে চোখে ঘুম নাই। মাথার ব্যাথায় মনে হচ্ছে মাথার রগগুলো ছিঁড়ে যাবে। এমনিতেই ভাল ঘুম হয়না। তার উপর গতকাল রাত থেকে শুরু হয়েছে উচ্চস্বরে এক ছাগলের আর্তনাদ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন তার আকাশের বলাকা || নিজের গলায় পুরোনো গান || সেই সাথে শায়মা আপুর আবদারে এ-আই আপুর কণ্ঠেও গানটি শুনতে পাবেন :)

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৬ ই জুন, ২০২৪ রাত ১০:০০

ব্লগার নিবর্হণ নির্ঘোষ একটা অসাধারণ গল্প লিখেছিলেন - সোনাবীজের গান এবং একটি অকেজো ম্যান্ডোলিন - এই শিরোনামে। গল্পে তিনি আমার 'মন তার আকাশের বলাকা' গানটির কথা উল্লেখ করেছেন। এবং এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×